দাক্কিণাত্য বলতে আমরা যে জায়গাটাকে বুঝে নিতে পারি তার
উত্তর সীমা হচ্ছে নর্মদা এবং মহানদী এবং দক্ষিনে পেরিয়ার নদী এবং নিলগিরি
পর্বতমালা। পুর্ব এবং পশ্চিম দিকে পুর্বঘাট এবং পশ্চিনঘাট পর্বতমালা এই জায়গাটাকে
প্রায় দুর্ভেদ্য করে রেখেছে। একমাত্র গুজরাটের দিক থেকে একে আক্রমণ করার
সুযোগ আছে। এই কারনে পশ্চিমঘাট পর্বতের উপরে অনেক দুর্গ গড়ে উঠেছিল।
অস্মক মহাজনপদের (খৃষ্টপুর্ব সপ্তম থেকে তৃতীয় শতাব্দী)
সময় থেকে আমরা অন্ধ্র প্রদেশের লিখিত ইতিহাস দেখতে পাই। অস্মক জনপদের জায়গা
নির্ধারন করা হয়েছে নর্মদা এবং গোদাবরীর মাঝে। অন্ধ্রের লোকেদের ঋষি বিশ্যামিত্রের
বংশধর বলে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণে এবং জাতক কাহিনীতে বলা হয়েছে।
খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে বর্তমান হায়দ্রাবাদের
এলাকাতে মৌর্য্য শাসন ছিল। সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পরে মৌর্য্য সামন্তদের মধ্যে
সাতবাহনেরা স্বাধীনতা ঘোষনা করে এবং সাতবাহন রাষ্ট্র বা অন্ধ্র রাষ্ট্রের পত্তন
করেন। প্রায় ৪৫০ বছর ধরে এদের শাসন দাক্ষিনাত্য এবং মধ্য ভারতে চলে। সাতবাহনদের
শাসনের পরে আসে অন্ধ্রের ইক্ষাকু বংশ। এদের শাসন চলে প্রায় ১০০ বছর। এদের রাজধানী
ছিল বর্তমান নলকোন্ডা জেলার নাগার্জুনকোন্ডাতে।
এর পরে আসে চালুক্য রাজাদের কল্যানীরা আর তাদের পরে আসে
কাকতীয় বংশ। চালুক্যদের সামন্ত ছিল কাকতীয়েরা। ওয়ারাঙ্গল ঘিরে এদের রাজত্ব ছিল।
কাকতীয় রাজত্বের শ্রী এবং সম্পদ দেখে আলাউদ্দিন খিলজীর সেনাপতি মালিক ফকরুদ্দিন ওয়ারাঙ্গল
আক্রমন করেন কিন্তু কাকতীয়দের হাতে খিলজির সেনা বাহিনী পরাজিত হয়। ১৩০৯ খৃষ্টাব্দে
মালিক কাফুর আবার কাকতীয় সাম্রাজ্যের উপরে আক্রমন করেন। ওয়ারাঙ্গল দূর্গের পতন হয়,
হত্যা এবং লুটপাট বন্ধ করার জন্য কাকতীয় রাজা প্রতাপরুদ্র মালিক কাফুরকে প্রচুর ধন
সম্পত্তি দিয়ে শান্ত করেন। খিলজী বংশের পতনের সময় রাজা প্রতাপরুদ্র আবার স্বাধীনতা
ঘোষনা করেম। ১৩২৩ খৃষ্টাব্দে গিয়াসুদ্দিন তুঘলক তার পুত্র উলুঘ খান কে ওয়ারাঙ্গল আক্রমন
করতে পাঠান, কিন্তু পরাজিত হয়ে উলুঘ খান ফিরে যান। এক মাসের মধ্যেই উলুঘ খান আবার
সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ওয়ারাঙ্গল আক্রমন করেন। এইবার রাজা রুদ্রপ্রতাপ হেরে যান।
লুটপাট হত্যা অত্যাচারে উলুঘ খান তার পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে শুরু করেন । শোনা যায়
কোহিনুর মণি এই সময় দাক্ষিনাত্য থেকে দিল্লিতে উপঢৌকন হিসাবে যায়। আরও বলা হয় যে
লুঠ এবং উপঢৌকনের জিনিষ দিল্লী নিয়ে যাবার জন্য ২০০০০ ঘোড়া এবং ১০০ হাতীর দরকার
হয়েছিল। প্রতাপরুদ্র বা রুদ্রপ্রতাপ বন্দী অবস্থাতে দিল্লীর পথে আত্মহত্যা করেন।
প্রতাপরুদ্রের ৭৫ জন নায়ক বা সর্দার ছিলেন। যদিও এরা একে
অন্যের উপরে ইর্ষা বা লোভ প্রতিপালন করতেন তবুও এই আক্রমনের সময় ওয়ারাঙ্গল রক্ষা
করতে তার প্রানপন যুদ্ধ করেন। অনেকে বন্দী হবার পরে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে তুঘলক
শাসনের হয়ে কাজ করতে থাকেন (হরিহরণ এবং বুক্কা , যারা পরে হাম্পিতে বিজয়নগর
রাজ্যের পত্তন করেন, উল্লেখযোগ্য) ।
১৩২৩ খৃষ্টাব্দে সমগ্র দাক্ষিণাত্য (হয়শালা এবং কাম্পিলি
সাম্রাজ্য সমেত) দিল্লীর সুলতানের শাসনে আসে। উলুঘ খান, মহম্মদ বিন তুঘলক নামে
দিল্লীর সুলতান হন। এই সময় তুঘলকী শাসনের বিরুদ্ধে একজন নায়ক, মুন্সুরী প্রলয়নায়ক
বা প্রলানীডু র মত এক খাম্মা বীরের নেতৃত্বে দেবনায়ক, কাম্মানায়ক এবং রাজানায়ক এক
সাথে হয়ে তুঘলকী শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য নেমে পড়েন। ১৩২৮ সালে ওয়ারাঙ্গল তুঘলকী
শাসন মুক্ত হয়। ওয়ারাঙ্গলের মুক্তি দেখে কাম্পিলি, হয়শালা, দ্বারাসমুদ্রম, আরাভিডু
ও স্বাধীনতা ঘোষনা করে। সুলতান নিজে এদের দমন করবার জন্য এক বিশাল সৈন্যদল নিয়ে
আসেন কিন্তু নায়কদের আক্রমনে ফিরে যান। সমগ্র দাক্ষিনাত্য তুঘলকী শাসন মুক্ত হয়।
১৩৪৫ খৃষ্টাব্দে মহম্মদ বিন তুঘলকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা
করে হাসান গাঙ্গু বাহমণি সান্রাজ্যের পত্তন করেন। আলাউদ্দিন বাহমন শাহ নাম নিয়ে
তিনি তার রাজ্যর রাজধানী বিজাপুরে নিয়ে আসেন। তার কিন্তু প্রথম থেকেই ইচ্ছে ছিল যে
সমগ্র সাক্ষিনাত্য তার শাসনে আসুক।
১৩৫১ খৃষ্টাব্দে মহম্মদ বিন তুঘলকের মৃত্যুর পরে
আলাউদ্দিন তেলেঙ্গানা এলাকা দখল করার জন্য আক্রমণ করেন। লুটপাঠ চালানর পরে আবার
তিনি গুলবর্গাতে ফিরে যান এবং ১৩৫৯ খৃষ্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। ইতিমধ্যে মুন্সুরী
নায়কদের মধ্যে কে বড় এবং তাদের শাসনের বিস্তার নিয়ে ঝগড়া লেগে যেতে শুরু হয়েছিল। রেচেরিয়ার নায়ক সিঙ্গামা ভার্মা রেড্ডীর শাসনের
অন্তর্গত আদ্দাঙ্কি আক্রমন করলে কায়াপ্পার কাছে মধ্যস্থতা করা জন্য ভার্মা রেড্ডী আসেন।
কায়াপ্পা, সিঙ্গামাকে আক্রমণ বন্ধ করতে হুকুম দেন। যদিও আক্রমন থামে তবুও সিঙ্গামা
এটাকে ভাল ভাবে মেনে নিতে পারেন নি। সিঙ্গামা পরে আলাউদ্দিনকে ওয়ারাঙ্গল আক্রমন
করার জন্য আগ্রহান্বিত করেন।
আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পরে মহম্মদ শাহ সুলতান হলে কায়াপ্পা
এবং বিজয়নগরের রাজা বুক্কা মহম্মদ শাহের সাথে যুদ্ধে হেরে যান।
কিন্তু কায়াপ্পার মনে মনে তেলেঙ্গানা এলাকা থেকে সুলতানী
অধিকার সমাপ্ত করার ইচ্ছে নিয়ে আবার বাহমণি সাম্রাজ্য আক্রমন করেন, এবং এতে সাথ দেন বিজয়নগরের বুক্কা। বুক্কা ইতিমধ্য
মারা গেলে বিজয়নগরের সহায়তা কমে আসে। তাছাড়া রচকন্ডা এবং দেবরকন্ডা নায়করা বাহমণি
সুলতানকে সাহায্য করার ফলে যুদ্ধে কায়াপ্পা জিততে পারেন না। শেষ কালে ঠিক হয় যে গোলকোন্ডা
হবে দুই রাজ্যের সীমানা, এই সন্ধিতে কায়াপ্পা কে প্রচুর উপঢৌকন এবং ক্ষতিপূরণ
মহম্মদ শাহকে দিতে হয়।
ওয়ারাঙ্গলের দুর্বলতা দেখে রেচেরিয়ার সিঙ্গামা নায়ক ওয়ারাঙ্গল
দখল করে, কায়াপ্পা যুদ্ধ মারা যান। এর পরে ভুবনগিরির নায়কেরা ওয়ারাঙ্গলের শাসনে আসেন।
কিন্তু আসলে তারা বাহমণি সাম্রাজ্যের অধীন ছিলান।
অবশেষে ১৫২২ খৃষ্টাব্দে বিজয় নগরের রাজা কৃষ্ণ দেব রাও বিবদমান
কলিঙ্গ এবং রেড্ডীদের নিয়ে সমস্ত অন্ধ্র দেশকে একত্রিত করেন। এদিকে কায়াপ্পার মৃত্যুর
পরে আস্তে আস্তে নায়কেরা ওয়ারাঙ্গল ছেড়ে বিজয়নগরে চলে যান এবং তাদের বিজয়নগরে
যাওয়ার ফলে বিজয়নগর শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
১৫৮৯ সালে মহম্মদ কুলী কুতব শাহ কুতব শাহী বংশের পত্তন করেন। বর্তমান
হায়দ্রাবাদে তার রাজধানী বানান এবং তার নাম দেন বাঘনগর বা বাঘানগর। বলা হয় যে
বাঘমতী নামে এক নর্তকীর প্রেমে পরে কুতব শাহ তাঁকে বিবাহ করেন এবং তার পরে তার নাম
হয় হায়দারমহল। তার থেকেই শহরের নাম হয় হায়দ্রাবাদ। কারুর মতে কুলী কুতব শাহের
পুত্র হায়দারের নামে হায়দ্রাবাদ শহরের নামকরণ করা হয়। কারুর মতে ফার্সী শব্দ
হায়দার (অর্থ বীর) এবং আবাদ (অর্থ শহর) থেকে হায়দরাবাদ বা হায়দ্রাবাদ (বীরের শহর)
কথাটি এসেছে। গোলকোন্ডা দূর্গে জায়গার অভাব দেখে সুলতান মুসী নদীর ধারে এক খোলা
জায়গা নির্ণয় করেন যাতে তার শহর তার নক্সা
অনুযায়ী বানান যায়। ১৫৯১ সালে চারমিনারের নির্মান করা হয় যাতে শহরের প্রগতির দিকে
নজর রাখা যায়, এবং মুসী নদীর বন্যার হাত থেকে সময় মত সঙ্কেত পাওয়া যায়।
ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে হাদ্রাবাদের প্রগতি
ছিল দর্শনীয়। প্রত্যেক কুতব শাহী সুলতানেরা ছিলেন বিদ্বান এবং স্থাপত্যকলার প্রোৎসাহক। গলকন্ডার থেকে লোকেরা এসে হায়দ্রাবাদে থাকা শুরু
করল। বহিরাগতেরা হায়দ্রাবাদকে ইরানের ইস্পাহানের সাথে তুলনা করতে শুরু করল তার
কারন ছিল হায়দ্রাবাদের বাগিচা এবং সৌন্দর্য।
ষোড়শ শতাব্দীর সময়ই হায়দ্রাবাদ দিল্লীর সম্রাটের নজরে
পড়ে। আউরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের অভিযানের সময় হায়দ্রাবাদ দখল নেবার মনস্থ করেন,
কিন্তু দুর্ভেদ্য গোলকোন্ডা দুর্গের কারনে হায়দ্রাবাদ দখল করা সমীচীন মনে করেন না।
তবুও কুলিচ খান আর ফিরোজ জঙ্গ এর নেতৃত্বে ১৬৮৬ সালে গোলকোন্ডা দুর্গ অবরোধ করেন কিন্তু কোন লাভ হয় না।
ব্যার্থ হয়ে ফিরে যাবার কিছু পরে আবার ১৬৮৭ সালে গোলকোন্ডা অবরোধ করলে আবদুল্লা
খানের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে দুর্গের পতন হয়। হায়দ্রাবাদ মুঘল শাসনে আসে। কিন্তু
চল্লিশ বছরের মধ্যে ১৭০৭ সালে আউরঙ্গজেবের মৃত্যু হলে হায়দ্রাবাদের গভর্ণরেরা
প্রায় স্বায়ত্বশাসিত অবস্থায় চলে আসেন। ১৭২৪ সালে কুলিচ খানের পৌত্র মীর
কামারউদ্দিন সিদ্দিকী হায়দ্রাবাদের দখল নেন এবং আসফ জাহী বংশের শাসনের প্রতিষ্ঠা
করেন। যেহেতু মুঘল আমলে মীর সিদ্দিকি, নিজাম-উল-মুল্ক উপাধি পেয়েছিলেন, তাই এই বংশ
নিজাম নাম নিয়ে শাসন করতে থাকেন ।
পরপর সাত জন নিজামের শাসন কালে হায়দ্রাবাদ পশ্চিমী
উপনিবেশ শক্তি থেকে যদিও সাধারণ ভাবে মুক্ত ছিল তবুও ইংরেজ দের বাৎসরিক কর দিতে
হত। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলে তৎকালীন নিজাম ভারতে যোগ না দিয়ে স্বাধীন ভাবে
থাকবার ইচ্ছে প্রকাশ করেন এবং সেই সময় রাজাকারেরা নিজামের শাসনের পক্ষে লড়াই শুরু
করে দ্যায় কেননা জনসাধারণ চাইছিলেন যে হায়দ্রাবাদের ভারতে অন্তর্ভুক্ত হোক।
স্থানীয় জনসাধারন যখন উদ্বাস্তু হয়ে তামিলনাডু এবং অন্ধ্রে চলে আসা সুরু করল তখন
১৯৪৮ সালে ভারতীয় সেনা হায়দ্রাবাদ অভিমুখে কুচ শুরু করে এবং চার দিনের মধ্যে
নিজামী সেনা আত্মসমর্পন করে।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত হায়দ্রাবাদ এক আলাদা প্রদেশ
হিসাবে ভারতে থাকে। ১৯৫৮ সালে সমগ্র ভারতে ভাষার উপরে প্রদেশের শ্রেণি বিন্যাস হলে
হায়দ্রাবাদের বিলুপ্তি ঘটে। হায়দ্রাবাদকে ভেঙ্গে অন্ধ্র প্রদেশ তৈরী হয়। নিজামের
হায়দ্রাবাদের মারাঠিভাষী অঞ্চল মহারাষ্ট্রে এবং কন্নড় ভাষী অঞ্চল কর্নাটকে
সম্মিলিত হয়।
আতি সম্প্রতি অন্ধ্র প্রদেশ আবার ভেঙ্গে তেলেঙ্গানা এবং
সীমান্ধ্র দুটি প্রদেশের সৃষ্টি করা হয়াছে।
উত্তরমুছুনবাংলায় ভালো ভালো হাঁসির গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
বাংলায় ভূতের গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
বাংলায় প্রেমের গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন