(১)
৬৯
সালের মার্চ মাসে আমি চলে এলাম রায়পুরে। আর দিন দশেকের মধ্যে কোয়ার্টার পেয়ে গেলাম
বলে এপ্রিলেই চলে গেলাম ছেলে বউকে নিয়ে আসতে।
মাল পত্র যদিও আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম তবুও আমার কপালদোষে সেগুলো এসে
পৌঁছেছিল প্রায় দুমাস বাদে। ততদিন একটা কড়াই আর ছোট্ট হাঁড়ি সম্বল ছিল।
রান্না
করব কি ভাবে। রান্নার ষ্টোভটাও যে ওয়াগনে, তবে? উপায় একটা সব জায়গাতেই পাওয়া যায়।
যে কোয়ার্টার পেলাম তাতে রান্নাঘরে সিমেন্টের উনুন তৈরী করা আছে। কাঠকয়লার অভাব
নেই, সহজলভ্য। অতএব সেই উনুনে কাঠকয়লার আঁচে রান্না চালু হল।ভাগ্যে বিছানাটা
ফ্যামিলির সাথেই এসেছিল। নয়ত রাতে যে কি ভাবে শোয়া হত সেটা এখনও ভাববার বিষয় হয়ে
থাকে।
আজকে
ছত্তিশগড় কি রকম বদলেছে সেটা ঠিক বোঝাতে পারব না, কারণ রায়পুর ছোট্ট শহর এখন হয়েছে
ছত্তিশগড়ের রাজধানী, সেখানে হয়েছে রেলের জোনাল হেডকোয়ার্টার। অতএব ৭০/৭১ এর
রায়পুর, বিলাসপুর যেটাকে আমি মনে রেখেছিলাম তাঁকে পরে আমি আর চিনতে পারিনি। যেখানে
আমার যৌবনের আট বছর কেটে গেছে, সুখ দুঃখের
মধ্যে দিয়ে সংসারের বৃদ্ধি হয়েছে, কাজে উন্নতি হয়েছে, সেই রায়পুর, বিলাসপুরকে, আমি
বিশ বছর বাদে ৯০/৯২ সালে খুজে পাইনি।
কি কি বদলে গেছে? ফাফাডি নাকা পার হবার পরে ছিল আমার কোয়ার্টার। সামনে
ছিল বিশাল মাঠ। দূরে দেখতে পেতাম, উড়িষ্যার থেকে আসা মজদূরেরা মাটির ঘর বানিয়ে আছে।
দেয়াল আর মেঝে মাটির, ছাত খাপড়া বা দেশী টাইলের।
এদের
মেয়ে বউয়েরা আমাদের ঘরে কাজ করতে আসত। এদের ডাকা হত ‘রোতাইন’ নামে, ছত্তিশগড়ী ভাষায় মানে হল ঝি। কথাটা এসেছে মনে হয়
রাউত কথার থেকে। আর বাড়ীটার পেছনে ছিল বড় রাস্তা (জব্বলপুরে যাবার জন্য), পার হলে
রেলের লাইন পর্যন্ত সবজির ক্ষেত। এখন সামনে আরও নতুন কোয়ার্টার উঠেছে আর পেছনের
সব্জীক্ষেতে হয়েছে রেলের অফিস।
এদিক
ওদিকে এখন ফ্লাই ওভারের মেলা। আর শহরের সীমানা বাইরের দিকে বাড়তে বাড়তে দুদিকে
প্রায় তিন চার কিলোমিটার দূরে চলে গেছে। জনসংখ্যা মনে হয় দশগুণ বেড়ে গেছে। আগে
শহরের মধ্যে যাতায়াতের জন্য ছিল সাইকেল রিক্সা। আর তাঁকে টানবার জন্য চালকদের অধিকাংশ ছিল
কোরাপুট, কালাহান্ডী জেলার অধিবাসীরা। এখন এই রিক্সার সাথে পাল্লা দিয়ে দেখলাম
বেড়েছে প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা।
রায়পুর
শহরের গায়েই আগে দেখেছিলাম এক ধরণের ধানের ক্ষেত, যেখানে গাছটার রঙ ছিল বেগুনী। না
পোকা লাগে নি। গাছগুলো ছিল একটু বেঁটে। খুব বেশি হলে এক হাতের মতন উচু হবে। নাম শুনেছিলাম
“কালীমুছ”। সুগন্ধী, তবে ফলন অল্প। সে ক্ষেত বা সেই ধানের
চাষ আর নেই।
এত
দিন হুটকথায় বদলী হয়েছি, এবার শুরু হল অনেকদিন এক জায়গায় থাকার
পালা। রায়পুরে থাকতে হল ৭৩ এর মাঝামাঝি পর্যন্ত আর তার পরে আরও চার বছর মানে ৭৭
পর্যন্ত বিলাসপুরে। রায়পুরেই দেখা পেলাম এক ধরনের লোকেদের যাদের স্থানীয় কথায় বলা
হত “মুশাহরা”। অত্যন্ত দরিদ্র, নামের কারণ এঁদের খাবার। এরা
সাধারণত মুশা বা ইদুর মেরে সেটাকে ঝলসে নিয়ে খেত। ধান কাটা হয়ে গেলে এদের দেখা
পাওয়া যেত ক্ষেতের আসে পাশে ইদুরের গর্ত খুঁজে তাতে খুচিয়ে খুচিয়ে ইদুর বার করতে।
সাধারন
লোক মানে ছত্তিশগড়ি লোকের মত সাদাসিদে সরল
লোক খুব কম দেখতে পেয়েছি। অনেকটা সেই পুরুলিয়ার লোকেদের মত। ঠিক জানিনা, হয়তো দারিদ্রতা
সরলতার পরিপোষক। মানে যেখানে যেখানে দেখেছি সাধারণ মানুষের আর্থিক ক্ষমতা কম,
সেখানেই কিন্তু দেখেছি তাঁদের মধ্যে অন্য লোকেদের বিশ্বাস করার একটা প্রবণতা আছে।
আর তার প্রতিদান যদি আপনি দিয়েছেন তবে তারা যে কি চোখে আপনাকে দেখবে সেটা বলে
বোঝান যাবে না।
আমার
এক জন খালাসী (মজদূর) একদিন আমার কাছে হঠাত নিয়ে এল একটা রূপোর পৈছে (কোমরে শাড়ীর
উপরে বেল্টের মতন করে পরা হয়)। ওজন হবে কম করে দু কিলোর মতন। কি ব্যপার এটা রেখে
তাকে দুশ টাকা দিতে হবে, তার মার সম্পত্তি ওটা। আমি তাকে এই মারি সেই মারি করে
তখুনি বাড়ী পাঠালাম, তুই আগে গিয়ে তোর মার কাছে তার জিনিষ ফেরত দে। আর এই নে টাকা।
কেন তোর টাকার এত দরকার পড়েছে। প্রথমে বলতে চায়নি, কিন্তু পরে বলেছিল যে কোন
মহাজনকে সুদের টাকা দেবার জন্য। তখনকার
দিনে ঐ গহণার দাম ছিল কম করে হাজার দুয়েক, কি তার চেয়েও বেশী।
ইতিমধ্যে বাবা আর মা তাঁদের কলকাতার বাস গুটিয়ে চলে
গেছেন শান্তিপুরে। দেশের মাটীতে শেষ বয়সটা কাটাবার কথা চিন্তা করে। তার ছেলে দুজন(
আমার বাকি দুই ভাই )কলকাতায় চাকরী করে, আমি বাইরে চাকরী করি আর বোনেদের বিয়ে হয়ে
শ্বশুর বাড়ী চলে গেছে। মানে দুই বুড়োবুড়ী একা থাকবে। কি আর বলা যায়। আমি বছরে সপরিবার একবার করে যাই, এক মাসের মতন
থেকে আসি। বাকী ভাই বোনেরা সুযোগ পেলেই ঘুরে যায়। আর বাবা
আর মা দুজনে মিলে বাড়ীর লাগোয়া বাকী সাত আট কাঠা জমিতে তাদের নাতী নাতনীরা এসে আম
জাম খাবে, এই ভেবে বাছাই করা কলমের ফল গাছ লাগিয়ে তার পরিচর্যা করেন।
শান্তিপুর জায়গাটা গঙ্গার গতিপথ বদল হওয়াতে গঙ্গার বালি
মিশ্রিত পলি দিয়ে তৈরী। আমাদের বাড়ী তৈরির সময় (বাবা যে নতুন বাড়ী তৈরী করেছিলেন )
ভিত খুড়তে গিয়ে নৌকোর ভাঙ্গা বৈঠার টুকরো বালির মধ্যে পাওয়া গেছিল। আসলে বালি বলতে
যে জিনিষটা সাধারণত বাড়ি তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়, সেটা গঙ্গার পূর্ব পাড়ে বিশেষ
পাওয়া যেত না। যে বালিটা পাওয়া যেত সেটা সাদা মিহি বালি। কাজেই সেটা কেবল পলেস্তারার
কাজে ব্যবহার হত। গাথুনীর কাজে বালির বদলে ইট ভাঙ্গা সুরকী আর চুণের কাজ বেশী হত।
আমাদের বাড়ী ছিল কাদা দিয়ে গাথা, ইটের পাকা বাড়ী। ছাদ
কাঠের কড়ি বরগার উপরে চুন সুরকীর পেটা। দেওয়ালে অবশ্যি চুন বালির পলেস্তারা।
শান্তিপুরে দেখেছি পঙ্খের কাজ। এটা হচ্ছে কলি চুণ দিয়ে দেওয়ালে পলেস্তারা, যাকে
মেজে পালিশ করে দেওয়া হত। শুখোনর পরে এটা প্রায় মার্বেলের মত দেখাত। এর উপরে ম্যুরালের মতন করে রঙ দিয়ে আলপনা আঁকা হত। এই বাড়ী তৈরির সময়, আমি ছুটি নিয়ে গিয়ে কাজ
দেখতাম। যে হেড মিস্ত্রী ছিল তার নাম ছিল “বজ্জাত”। বয়স তখন প্রায় পঞ্চাশ পঞ্চান্নর কাছাকাছি। তার
কাছেই এই পঙ্খের কাজ করার প্রশেস জেনেছিলাম। সে বলেছিল যে আজকাল আর এই কাজের
মিস্ত্রী পাওয়া যায় না, কেননা এত দাম দিয়ে আর কেউ বাড়ী বানায় না। শান্তিপুরে এই
রকম পঙ্খের কাজ করা বাড়ী বেশ কয়েকটা ছিল।
উত্তরমুছুনবাংলায় ভালো ভালো হাঁসির গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
বাংলায় ভূতের গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
বাংলায় প্রেমের গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন