বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৪

বাংলার ইতিহাস (৪র্থ খন্ড)


কিন্তু বৃটিশদের এক নবাবের নামের দরকার ছিল কেননা তারা তখন আইনত ব্যবসাদার হিসাবেই ছিল। মীরকাশিমের পরে কে মসনদে বসবে তা ঠিক করতে কোম্পানি এক সভা ডাকে সেখানে দাবীদার থাকে দুজন, এক মীরণের শিশুপুত্র আর দ্বিতীয় মীরকাশিমের দাসী পুত্র। বৃটিশেরা মাত্র পাঁচ মিনিটের বৈঠকের মধ্যে স্থির করে নেয় যে মীরকাশিমের দাসীপুত্র সুজা কে মসনদে বসান হবে। আর তাঁর কাজ কর্ম দেখাশুনা করার জন্য কোম্পানির তরফ থেকে আসে মহম্মদ রেজা। মহম্মদ রেজা এই সময় মহারাজ নন্দকুমারের থেকে বৃটিশদের কাছে বেশী প্রিয়পাত্র ছিলেন। বার্ষিক বেতন মহম্মদ রেজার জন্য নির্ধারিত হয় সোয়া লক্ষ পাউন্ড। এটুকু মনে রাখলেই হবে যে মুঘল সম্রাটকে বার্ষিক সাড়ে তিন লাখ পাউন্ড দেওয়া হত পেন্সন হিসাবে।

এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার যে যদিও আমরা ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসনের কথা বলি, কিন্তু সেই সময় ইউরোপ থেকে বিভিন্ন দেশের বণিকদল এসে তাদের ব্যবসার জন্য বাংলাদেশে তাদের কুঠি স্থাপনা করে এবং পরে সেই কুঠিগুলি তাদের রাজ্যের কেন্দ্র হিসাবে কাজ করতে থাকে। ফরাসীরা এসে তাদের কেন্দ্র বানায় চন্দননগরে, ওলন্দাজেরা বানায় চুচুড়াতে এবং পর্তুগীজেরা বানায় হুগলীতে। এদের মধ্যে চুচুড়া ১৭৯৫ খৃষ্টাব্দে ফ্রান্সের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে বৃটিশেরা অধিকার করে ।

হুগলিতে ১৫৮০ খৃষ্টাব্দ নাগাদ পর্তুগীজ ব্যবসায়ীরা আসেন। পর্তুগীজদের ব্যবসার সাথে আর এক প্রধান কাজ ছিল ধর্মান্তকরন। সেই সময় তাদের এই ধর্মান্তকরন এত বেশী কার্যকরী ছিল যে এটা জানা যায় যে সারা বাংলাতে যখন প্রায় ২০ হাজারের মত খৃষ্টান ছিলেন সেখানে শুধুমাত্র হুগলীতেই প্রায় দশ হাজারের মতন খৃষ্টধর্মালম্বী ছিলেন। ব্যান্ডেলের বিখ্যাত চার্চ পর্তুগীজদের তৈরী। ব্যান্ডেল পরে বৃটিশদের অধিকারে চলে আসে। খালি ভারতের স্বাধীনতা পর্যন্ত চন্দননগরে ফরাসি শাসন ছিল এবং বিপ্লবীরা এই এলাকাতে এসে আত্মগোপন করতেন।

রবার্ট ক্লাইভ ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে তার দ্বিতীয় বারে ভারতে আগমনের পরে অযোদ্ধার নবাব এবং মুঘল বাদশার সাথে এলাহাবাদে এক সন্ধি করেন যাতে বাংলা বিহার এবং ওড়িষ্যার প্রকৃত শাসনভার ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায়, বাদশারা খালি এক পেন্সনের মত টাকা কোম্পানির কাছ থেকে পেতে শুরু করেন।

এই সময় বাংলা দেশে জমিদারদের প্রত্যেক বছর এক নীলামের মাধ্যমে বন্দোবস্ত দেওয়া হত। নাম ছিল পুনিয়া। এই প্রথাতে যে জমিদার সব চেয়ে বেশী দাম বলার ক্ষমতা রাখত সেই জমিতে চাষ করার অধিকার পেত। তার অবশ্যম্ভাবী ফল ছিল গরীব চাষীকে প্রায় বিনা মজুরীতে কাজ করতে হত। দেনার দায়ে কৃষক ঘর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে কি আত্মহত্যা করেছে এই রকম অবস্থা প্রচুর ছিল।

১৭৭০ খৃষ্টাব্দে বাংলাদেশে অনাবৃষ্টির ফলে কোন রকম চাষ আবাদ হয়না। গ্রামের লোকে না খেতে পেয়ে শহরের দিকে আসতে শুরু করে। অনাহারে লোকের মৃত্যু শুরু হয়ে যায়। এটা মনে করা হয় যে গ্রামগঞ্জে প্রায় আদ্ধেক লোকে অনাহারে মারা গেছিল। এক ইতিহাস লেখকের মতে কলকাতা শহরে একশ লোক লাগানো হয়েছিল মৃতদেহ তুলে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেবার জন্য। এটা অতিশয়োক্তি হলেও এই দুর্ভিক্ষে বাংলার জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। এটাই সেই বিখ্যাত ৭৬ এর মন্বন্তর যাতে অনুমান করা হয় প্রায় এক কোটির মত লোকে মারা গিয়েছিল। কিন্তু কোম্পানির তরফে লোকের দুর্দশা দূর করার কোন প্রচেষ্টাছিল না। বরং তারা ব্যবসার খাতিরে প্রথমে নুনের ব্যবসায়ে ট্যাক্স দ্বিগুন করে দ্যায়। নুনের ব্যবসা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। উত্তর ভারতে সন্ধব লবন আর করকচের ব্যবহার চালু হয়ে যায়। সুপারী এবং তামাকের ব্যবসা মনোপলি করে কারুর কাছে তামাক বা সুপারী পাওয়া গেলে তাকে শাস্তি দেবার বন্দোবস্ত করা হয়।

এই ১৭৭০ খৃষ্টাব্দে জলপাইগুড়ি এবং মুর্শিদাবাদ জেলাতে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ হয় যেটা প্রায় ১৮০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত চলতে থাকে। যদিও এটাকে ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামের এক অধ্যায় বলে ধরা হয় তবুও কিছু ঐতিহাসিক এটা মুলত লুঠেরা সন্ন্যসী এবং বৃটিশ ফৌজের মধ্যে লড়াই বলে মনে করেন। এটা মনে রাখতে হবে এই সময়ে মন্বন্তরের ফলে দেশে লোকজন বিশেষ ছিল না। ফৌজ তাদের যুদ্ধ কৌশল দেখানোর সুযোগ পেয়েছিল, তা সত্বেও প্রায় ত্রিশ বছর লেগে গিয়েছিল এদের দমন করতে। এই সন্ন্যাসীরা ছিল উত্তর ভারতীয় এবং নাগাসম্প্রদায়ের লোক।

১৭৭০ সালেই বাকুড়া এবং মেদিনীপুর অঞ্চলে চুয়ার সম্প্রদায়ের লোকেরা বিদ্রোহ করে। নেতৃত্ব দেন দুর্জন সিং। জমিদার শ্রেণী এবং মহাজনদের অত্যাচারের সাথেকোম্পানির আমলাদের যোগসাজশের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ হয়। প্রথমে দুর্জন সিং এর নেতৃত্বে ১৭৯০ পর্যন্ত এবং আবার ১৭৯৯ থেকে ১৮১৬ পর্যন্ত অঞ্চল সিং এর নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ চলে। শেষের দিকে কোম্পানির সৈন্যদলের সাথে এদের চোরাগোপ্তা গেরিলা নীতির লডাইএ কোম্পানির সৈন্যদের পেছতে হয়। কিন্তু পরে শালবনী অঞ্চলের জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে এদের লুকোনর জায়গার অভাব করে দিলে শেষ পর্যন্ত এদের পরাস্ত হতে হয়।

মুলত কোম্পানি ভারতবর্ষে ব্যবসার জন্য মুঘলদের কাছ থেকে ফরমান পেয়েছিল। এবং লন্ডনের ডিরেক্টরেরা তাই জানতেন এবং ভাবতেন। কোম্পানীকে তাদের ব্যবসার জন্য কিন্তু ইংল্যান্ডে ট্যাক্স দিতে হত। ক্লাইভের সময় থেকেই দেখা যায় যে কোম্পামীর প্রতিনিধিরা তাদের নিজের ব্যবসা চালু করে দিয়েছেন এবং বেআইনি ভাবে তাদের নিজস্ব সম্পত্তির পরিমাণ বাড়িয়ে চলেছেন।

১৭৭০ খৃষ্টাব্দে বাংলা দেশে লুই বোণার্ড প্রথম নীল গাছের চাষ শুরু করেন। নীল রঙের চাহিদা পুরো ইউরোপ জুড়ে ছিল কেননা সেটা সাধারণত পুরাতন প্রথাতে প্রাণিজ উৎপাদন ছিল। কিন্তু নীল গাছের প্রধান অসুবিধা ছিল যে বর্তমান ইউল্যালিপটাস গাছের মত জমির উর্বরা শক্তি কমিয়ে দিত কাজেই প্রত্যেক বছর একই পরিমাণ উৎপাদনের জন্য অধিক জমিতে চাষ করতে হত। বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী এই নীল চাষের জন্য গরীব কৃষকদের প্রথমে টাকা ধার দিয়ে তাদের হাতে আনতে থাকেন। এই ধার দেওয়ার ব্যবস্থাকে বলা হত দাদন দেওয়া। কিন্তু অনেক বেশী সুদের হার হবার ফলে কৃষকেরা একবার এই ঋনের কবলে পড়লে প্রায় ক্রীতদাস হয়ে যেত। নীল চাষ করার জন্য এবং তার ফসল গুদামজাত করার জন্য জায়গায় জায়গায় নীলকুঠি তৈরী হল। হেষ্টিংসের সময় পার্লামেন্টে এই অত্যাচার নিয়ে হেষ্টিংসের বিরুদ্ধে প্রস্তাব এলেও সেটা কিন্তু পাশ হয় নি কারণ যারা এই সম্বন্ধে বলবার তাদের প্রায় প্রত্যেকের এই ব্যপারে নিজস্ব স্বার্থ ছিল।

হেষ্টিংসের পরে আসেন লর্ড কর্ণওয়ালিশ। এর আগেই বৃটিশদের সাম্রাজ্য বিস্তার বাংলা থেকে সরে গিয়ে দাক্ষিণাত্যে চলে যায়। বৃটিশদের শাসন ব্যবস্থা তিন প্রেসীডেন্সীতে সীমাবদ্ধ থাকে। (১) কলকাতা প্রেসীডেন্সী (২) মাদ্রাজ প্রেসীডেন্সী এবং বম্বে প্রেসীডেন্সী। ক্লাইভের পরেই কলকাতা প্রেসীডেন্সীকে প্রাধাণ্য দেওয়া হতে থাকে, এবং কোম্পানি মুল প্রতিনিধি কলকাতায় বসে গভর্ণর জেনারেল নামে বৃটিশদের স্বার্থের দিকে নজর রাখতে শুরু করেন।
আগেই বলেছি জমিদারদের প্রত্যেক বছরে নীলামের মারফত চাষ করার পাট্টা নিতে হত যেটা রায়তয়ারী বা মহালয়ারী বলে জানা যেত। অবশ্যি তার নাম ছিল পুনিয়া। কর্ণওয়ালিশ এসে এই ব্যবস্থাকে বদল করে দেন। ১৭৯০ খৃষ্টাব্দে তিনি এটাকে প্রথমে দশ বছরের জন্য ব্যবস্থাতে রূপান্তরিত করেন। পরে ১৮০০ খৃষ্টাব্দে তিনি জমিদারদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্যে নিয়ে আসেন। এতে জমিদারদের একটা স্থিতি এলে চাষীদের দুর্গতি কিছুটা কমে। 

কিন্তু কর্ণওয়ালিশের পরে ওয়েলেসলি এসে তার সম্প্রসারণ নীতি দিয়ে বৃটিশদের সাম্রাজ্য বিস্তারে মন দেন।তার বশ্যতামূলক সন্ধি বা মৈত্রী নীতির জোরে তার কথা অনুযায়ীদেশীয় রাজন্যদের থাকতে হত। অমৃতসরের সন্ধিতে এরই জোরে পাঞ্জাবের মহারাজাকে তার কাশ্মীর অঞ্চল ডোগরাদের বিক্রী করতে বাধ্য করা হয়।ওয়েলেসলীর পরে আসেন ডালহৌসি। তিনি তারবিখ্যাত ডকট্রিন অফ ল্যাপ্স এর জোরে অপুত্রক রাজাদের দত্তক নেওয়া বন্ধ করে সেই রাজ্য বৃটিশদের অধিকারে নিয়ে আসা শুরু করেন। সিপাহী বিদ্রোহ বা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ এখানেই শুরু হয়।


১৮৩৩ খৃষ্টাব্দেএক আইনের জোরে ভারতীয় কৃষকদের উপর নীলকর, জমিদার এবং মহাজনদেরঅত্যাচার প্রায় আইনসিদ্ধ করে নেওয়া হল। নীলকরেরা কৃষকদের ধান তামাক ইত্যাদি চাষ করার বদলে নীল চাষ করতে বাধ্য করা শুরু করল। নদীয়া, বীরভূম, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, যশোহর, পাবনা এলাকাতে অন্য চাষ প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। 

1 টি মন্তব্য: