আমরা মহাভারতে পড়েছি অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ দেশের কথা, যারা কুরুক্ষত্রের
যুদ্ধে পান্ডব বা কৌরবদের পক্ষ নিয়ে লড়েছিল। কিন্তু এই জায়গা গুলো কোথায় ছিল? আমরা
মগধ, কৌশালী এই সব রাষ্ট্রের নাম সহজে বুঝে তাদের স্থান নির্দেশ করতে পারি। বঙ্গ
দেশ বলতে আমরা বাঙ্গলা দেশ হয়তো মনে করতে পারি কিন্তু তাহলে অঙ্গ দেশ কোথায় ছিল?
আসলে অঙ্গ, বঙ্গ এবং সুমা এই তিনটে রাজ্যের নাম আমরা পাই খৃষ্ট পুর্ব একাদশ
শতাব্দীতে, যাতে এদের স্থান নির্দেশ করা হচ্ছে আর্য সভ্যতার সীমানার বাইরে, এবং
সেই অনুযায়ী আমরা অঙ্গ রাজ্যকে পাচ্ছি উত্তর বাংলাতে, বঙ্গ রাজ্য কে পাচ্ছি দক্ষিন
বাংলাতে এবং সুমা রাজ্যকে পাচ্ছি পশ্চিম বাংলার এলাকাতে। এখানে প্রথমেই একটা কথা
মনে রাখা দরকার যে বাংলা বলতে কিন্তু আমি অবিভক্ত বাঙ্গলার কথা সব সময় বলছি।
বৈদিক যুগে আর্যরা এই তিনটি দেশের সাথে আরও একটি দেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন
যেটি হচ্ছে পুন্ড্র বা পৌণ্ড্র রাজ্য। সেই সময় বলা হচ্ছে যে এই রাজ্য গুলি নিষাদ
সম্প্রদায়ের অধীনে এবং আর্যেরা এই সব জায়গাতে এলে পরে ফিরে গিয়ে নিজেদের শুদ্ধিকরণ
করতেন। মহাভারতের কথা অনুযায়ী ঋষি উতথ্যের পুত্র ছিলেন দীর্ঘতামস। দীর্ঘতামস এবং
রাজা বলীর রানী সুদেষ্ণার তিন পুত্র অঙ্গ, বঙ্গ এবং কলিঙ্গ। এই তিন জন তিন রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।
ভাষা হিসাবে এই সব জায়গাতে দ্রাবিড়ীয় ভাষা এবং তিব্বতীয়-বর্মী ভাষার
সংমিশ্রণ ভাষার প্রচলন ছিল। এই সব ভাষার
কিছু নিদর্শন আমরা কিন্তু এখনও কোল, ভীল, সাওতালী ভাষার মধ্যে দেখতে পাই।
আবুল ফজলের মতানুযায়ী বঙ্গ দেশের নাম ছিল বাং। তখনকার দিনে রাজত্বের সীমানা
নির্ধারণ করে উচু মাটির দেয়াল দিয়ে গিরে রাখা হত যাকে বলা হত আল। আমরা এখনও ক্ষেতের
সীমানা নির্ধারনের জন্য এই আলের ব্যবহার করি। বাং শব্দের সাথে আল শব্দ যোগ করে বাঙ্গাল শব্দ এসেছে , যেটার থেকে
বাংলা ভাষা নাম হয়েছে।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার মতে বাংলা ভাষা আদি অবস্থাতে ওড়িয়া এবং আসামী
ভাষার সাথে একত্রিত বা মিশ্রিত ছিল। তার থেকে প্রথমে ওড়িয়া এবং তার পরে আসামী ভাষা
আলাদা হয়ে যায়। এই কারণেই চর্যাপদকে
বাংলার সাথে আসামী এবং ওড়িয়া ভাষাবিদেরা তাদের আদি অবস্থা বলে মেনে নেন।
শ্রী সুনীতি কুমার চ্যাটার্জীর মতে বাংলা মগহী প্রাকৃত থেকে মগহী অপভ্রংশ
হিসাবে খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীতে উৎপন্ন হয়েছিল। আবার মহম্মদ শাহিদুল্লার মতে খৃষ্টীয়
সপ্তম শতাব্দীতে গৌড়ীয় ভাষা থেকে উৎপন্ন হায়েছিল।
ব্যকরণগত দিক থেকে যদিও বাংলা ভাষা ইন্দোইউরোপীয় ভাষা, তবুও এর উপরে
দ্রাবিড়ীয় এবং তিব্বতী-বর্মী ভাষার প্রভাব সুস্পষ্ট ভাবে পড়েছে।
এবার আমরা দেখতে থাকি একে একে এই রাজ্যগুলির সম্বন্ধে আমরা কি জানতে
পেরেছি। প্রথমে আমরা নিচ্ছি পৌণ্ড্র দেশ কে। বর্তমান বাংলা দেশ থেক শুরু করে
বর্তমান বিহারের পূর্ণিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই রাজ্য।
মৎস্য দেশের লোকেদের ধারণা ছিল যে পৌণ্ড্র দেশের লোকেরা ম্লেচ্ছ এবং তারা
ক্ষত্রিয় থেকে শূদ্র জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে এবং
বৈদিক সংস্কৃতির বাইরে আছে। মহাভারতে আমরা পৌণ্ড্র রাজা পৌণ্ড্রক বাসুদেবের
নাম পাই, যিনি জরাসন্ধের সাথে কৌরবদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। ইনি কৃষ্ণ বাসুদেবের
হাতে মারা যান।
সুমা রাজ্য সম্পর্কে আমরা বিশেষ করে কিছু জানিনা, তবে পান্ডুপুত্র ভীম এবং
অর্জুন, সুমা এবং পার্শ্ববর্তী প্রসুমা রাজ্য দুটিকে জয় করেছিলেন। সুমার অবস্থান
ছিল উত্তর-পশ্চিম বাংলা এবং বিহারের কিছু অংশ।
এবার আমরা দেখি অঙ্গ রাজ্য সম্বন্ধে কি জানতে পারা গেছে। অঙ্গ রাজ্যের
অবস্থান ছিল বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ, তরাই অঞ্চল, নেপাল এবং ঝাড়খন্ডের সাথে পুর্ব
বিহার। বাল্মিকী রামায়ণের বাল কান্ডে বলা হয়েছে যে ইক্ষাকু বশের রাজা দশরথের কন্যা
শান্তা কে অঙ্গদেশের রাজা রমাপদ (একে
অনেকে চিত্ররথ নামেও জানেন) দত্তক হিসাবে নেন, এবং ঋষী ঋষ্যশৃঙ্গর সাথে শান্তার
বিবাহ হয়। এই ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষি পরে রাজা দশরথের পুত্রেষ্ঠি যজ্ঞের পুরোহিত ছিলেন।
অবশ্য এর জন্য দশরথের কুলপুরোহিত বশিষ্ঠের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। বৈদিক সংস্কৃতি এই
অঙ্গ রাজ্যের সীমানা পর্যন্ত এসেছিল।
মহাভারতে যেখানে কর্ণ রাজা নন বলে অর্জুন তার সাথে শক্তি পরীক্ষায় রাজী
হচ্ছেন না সেখানে দুর্যোধন তাঁকে অঙ্গ রাজ্যের রাজা বলে অভিষিক্ত করেছেন। আবার পরে কর্ণ কে অঙ্গ এবং বঙ্গ দুই রাজ্যের
রাজা বলা হয়েছে ।
এবারে আমরা আসি বঙ্গ রাজ্যে। বঙ্গ দেশের নাম কি করে বঙ্গ হল তা নিয়ে কিছু
সন্দেহ আছে। কারুর মতে বোঙ্গা অর্থাৎ
সূর্যদেবের পুজারী হিসাবে এখানকার অধিবাসীদের জন্য জায়গার নাম বোঙ্গা থেকে বঙ্গ হয়েছে।
আবার কারুর মতে বঙ্গ কথাটা এসেছে ভঙ্গ থেকে। আগেই বলেছি আবুল ফজলের মতে জায়গাটার
নাম ছিল বাঙ্গ। বঙ্গ রাজ্য ছিল বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে। এখানকার অধিবাসীদের
সম্বন্ধে বলা হয়েছে এরা সমুদ্রের দক্ষ নাবিক ছিলেন। মহাভারতে বলা হয়েছে যে এখানকার অধিবাসীরা যুদ্ধে ব্যবহৃত
হাতীদের চালানতে দক্ষ ছিলেন।
রামায়ণে বলা হয়েছ যে রাম অঙ্গ,
বঙ্গ, কলিঙ্গ জয় করেছিলেন। আবার মহাভারতে অর্জুনের বনবাসের সময় বঙ্গ দেশে আসার কথা
বলা আছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বঙ্গ দেশ কৌরবদের সাথে যোগ দিয়েছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বঙ্গ দেশের রাজা ভগদত্তর
সাথে ঘটোৎকচের যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে যেখানে ভগদত্ত তার পাহাড় প্রমাণ মাপের হাতী
দিয়ে দুর্যোধনের রথকে ঘটোৎকচের দৃষ্টির আড়ালে রাখছিলেন।
আবার বঙ্গ দেশের রাজা বিজয় সিংহের খৃষ্ট পুর্ব ৫৪৪ সালে সিংহল জয়ের কথা
আমরা মহাবংশতে পাই। শ্যাম মালয়, ইন্দোনেশিয়াতে বঙ্গদেশের অভিযানের কথা আমরা এই
সমস্ত আখ্যানে পাই।
খৃষ্ট পুর্ব ষষ্ট এবং পঞ্চম শতাব্দিতে আমরা কিন্তু গঙ্গাঋদ্ধি নামে এক
রাজ্যর কথা দেখতে পাই যেটা ছিল বর্তমান
পশিম বঙ্গ এবং বাংলদেশের এলাকাতে। এর উল্লেখ আমরা পাই মেগাস্থিনিসের খৃষ্ট পুর্ব
চতুর্থ শতাব্দীর লেখায়। টলেমীর লেখাতে আমরা পাচ্ছি যে গঙ্গাঋদ্ধি রাজ্য গঙ্গার মোহানাতে
অবস্থিত।
ডক্টর আর সি মজুমদারের
লিখিত পুস্তকে ডিওডোরাস সিকুলাসের বৃতান্ত থেকে আমরা জানতে পারি রাজা পুরুর ভাগ্নে
আলেক্সান্ডারের আগমনের কথা শুনে রাজ্য ছেড়ে গঙ্গাঋদ্ধিতে পালিয়ে গেছেন এবং
আলেক্সান্ডার তার পেছনে তাড়া করেন নি কারন ছিল গঙ্গাঋদ্ধি রাজ্যের সৈন্য বলের
ক্ষমতা, যাতে কম করে ৪০০০ হাতী এবং ২০০০০ অশ্বারোহী সেনা, এবং ২০০০০০ পদাতিক
সৈন্য ছিল এবং রাজ্যের পশ্চিম সীমা দিয়া
গঙ্গা নদী ছিল যা আলেক্সান্দারের পক্ষে অতিক্রম করা সহজ বলে মনে হয় নি।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের
সময় এই গঙ্গাঋদ্ধি বা গঙ্গারদেহি রাজ্য কলিঙ্গ রাজ্যের সাথে এক হয়ে তাদের
সাম্রাজ্য চেন্নাই পর্যন্ত বিস্তার করে। কিন্তু এই গঙ্গাঋদ্ধি রাজ্যের রাজধানী
সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় নি। অনুমান করা হচ্ছে যে বর্তমান চন্দ্রকেতুগড় ছিল
রাজধানী।
এবার আমরা আসছি ইতিহাসের
বাংলা দেশের কথায়। সবাই এটা হয়তো মনে করছেন যে উপরের লেখাটুকুর সাথে ইতিহাসের কোন
সংস্রব নেই। তা নয়। ইতিহাস একথা মেনেছে যে মহাভারতের যুদ্ধ হয়েছিল এবা তাতে সারা
ভারতবর্ষের রাজ্যগুলি বিশেষতঃ দাক্ষিনাত্য বাদ দিয়ে বাকিটা যোগ দিয়েছিল, এবং
আলেক্সান্ডার ভারত জয়ে বেড়িয়ে পুর্ব ভারত থেকে ফিরে যান।
বাকীটা পরে লিখছি।…….
লেখার জন্য ইন্টারনেট, কৃত্তিবাসী রামায়ন এবং
কাশীদাসী মহাভারতের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।