শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

কনটিকির যাত্রা


মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজারের মত বাসিন্দা থাকে এই দ্বীপটাতে। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের উপরে একটা বিন্দুর মতনই মনে হবে, কেননা আয়তনে হচ্ছে মাত্র ১৬০ বর্গ মাইলের মতন। কিন্তু কি তাঁর এমন মাহাত্ম্য যে ইউনেস্কো সেই দ্বীপটাকে সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহনের গরিমা দিয়েছে। হ্যাঁ, আমি বলছি রাপা নুই বা ইষ্টার দ্বীপের কথা। কি তাঁর সেই বিশেষত্ব। হ্যাঁ এইখানেই আছে সেই সব মোইএরা বা বিশাল বিশাল পাথরের খোদাই করা মানুষের মুখগুলো, যাদের নাম মোই।

 কিনতু অবাক কান্ড আরও লাগে, যখন দেখি এই বিশাল আকারের মুর্তিদের সমূদ্রের উপরে দিয়ে নিয়ে এসে দ্বীপে বসান হয়েছে। তাও এক সার  দিয়ে। এদের মুখ তাকিয়ে আছে সমূদ্র থেকে দ্বীপের ভেতর দিকে, যেন তারা নতুন  কিছু জিনিষ এই দ্বীপে আছে কিনা তাই দেখছে।

কারা এরা বা কাদের তৈরী এই সব মূর্তি গুলো।  কোন কিছু নির্দিষ্ট করে কোথাও লেখা নেই, কিন্তু বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে এই মূর্তিগুলো করা হয়েছে দ্বীপবাসীদের পূর্বপুরুষের স্মরণার্থে। কিন্তু তাহলে আজকে এরা মুখ থুবড়ে পড়ে আছেই বা কেন? মনে হয়  দ্বীপের আদিম অধিবাসীদের মধ্যে আন্তরিক বিরোধের ফলে ঐ মুর্তিগুলোকে ইচ্ছে করে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাচ্চা ছেলেরা খেলায় হেরে গেলে যেমন তাঁর খেলনা ভেঙ্গে ফেলে, সেই রকম অনেকটা।

 বিখ্যাত নরওয়েজিয়ান লেখক থর হেয়ারডাল ( ইনি বিজ্ঞানীও বটে, কিন্তু তাঁর লেখা বই তাঁকে বিজ্ঞানীর থেকে লেখক হিসাবে বেশী সম্মান দিয়েছে।  তাঁর লেখা বই তিনটি হল কন-টিকি আর আকু আকু এবং ফাতু হিভা।)  এই সম্বন্ধে কিছু লিখেছেন, যেটা তাঁর নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। ।  বছর ষাটেক আগে আমার পড়া প্রথম বই দুটো, কিন্তু তাদের আকর্ষন আমার কাছে এখনও প্রবল হয়ে আছে। দেখি তাঁর থেকে কিছু আপনাদের জন্য জোগাতে পারি কিনা।

থর হেয়ারডালের জন্ম ১৯১৪ খৃষ্টাব্দে। ভূগোল, জীব এবং প্রানী বিজ্ঞান এবং নৃতত্বের উপরে তাঁর জ্ঞানএর সাথে তাঁর এডভেঞ্চার করার নেশা তাঁকে নরওয়ে থেকে পেরু, আবার সেখান থেকে এক নৌকো তৈরী করে প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে টুয়ামোটো দ্বীপপুঞ্জে যেতে বাধ্য করে। সেই সমূদ্রযাত্রার বিবরণ তিনি দিয়েছেন তাঁর লেখা কন টিকি বইয়ে।

থর আর তার স্ত্রী লিভ যখন মারকুইস দ্বীপপুঞ্জের ফাতু হিভা দ্বীপে হনিমুন করতে চলে গিয়েছিলেন তখন থেকে এর সূত্রপাত। অবশ্যি হনিমুনের চেয়েও সেটা ছিল আধুনিক সভ্যতা আর সমাজের উপরে থরের বিরাগ। তাই একেবারে আদিম অধিবাসীদের মতন তাঁর নব বিবাহিত স্ত্রীকে সাথে নিয়ে চলে গেছিলেন ফাতু হিভায়। প্রথম অভিজ্ঞতা তাঁর এই আদিম জীবনের মধ্যে  এসে পড়ার হয় যখন তাঁর তাবুর উপরে গাছের থেকে এক পাকা নারকেলের পতন হয় এবং তাবুর সর্বনাশ হয়। বাধ্য হয়ে তাদের আশ্রয় নিতে হয় ওখানকার অধিবাসীদের মতন এক কুড়ে ঘরে, সাহায্য নিতে হয় স্থানীয় অধিবাসীদের তাদের জীবন ধারার সাথে।

 একসন্ধ্যায় সেই পলিনেশিয়ান দ্বীপে, সমূদ্রের ধারে বসে ঢেউএর ভেঙ্গে পড়া আর তার ফেনিল জলরাশি দেখতে দেখতে  আমাকে স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন,” আচ্ছা এই দ্বীপের অন্য দিকেও কি এই রকম ভাবেই ঢেউ ভেঙ্গে পড়ছে”? আমি বললাম, “ তা কেন। ওটা তো স্রোতের উলটো দিকে, মানে পশ্চিম দিকে। ওদিকের সমূদ্র শান্ত”। সামনে আমার বসে ছিল এক স্থানীয় আদিবাসী। নাম তাঁর তেই তেহুয়া। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়ল যে তোমরা কথা থেকে এসেছ যে বেড়ালের ছবি তোমাদের পুর্ব পুরুষেরা আঁকতে পেরেছে, বেড়াল তো এখানে হয় না। তখন উত্তর পাই ‘তে ফিতি” (পূর্ব দিক) থেকে আমরা এসেছি।  বালিতে আকি বুকি কাটতে কাটতে সে বলে উঠল “টিকি।  আমাদের সর্দার আর ভগবান। তিনিই আমাদের এখানে নিয়ে এসেছেন। তার আগে আমরা সমূদ্রের ওপারে এক বিরাট পাহাড়ী দেশে বাস করতাম।“ রাতে শুয়ে আমার মনে যে কথাটা বার বার আসতে লাগলো সেটা হচ্ছে যে এই মূর্তিগুলোর আদল প্রায় সেই দক্ষিন আমেরিকার জঙ্গলের আদিম মুর্তির মত, তবে কি এগুলো সেখান থেকে বা সেখানকার লোকে বানিয়েছে।

এই চিন্তা আমার মনে নাড়া দিয়ে গেল। যেখানে কোন নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায় না সেখানেই শুরু হয় কল্পনা। সমুদ্রের ওপারে মানে দক্ষিণ আমেরিকায়। কিন্তু এই দীর্ঘ ৪৫০০ মাইল চওড়া প্রশান্ত মহাসাগর তারা পার হয়েছিল কি ভাবে? তবে কি কোন স্থল যোগসুত্র ছিল এই প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ আর দক্ষিন আমেরিকা মধ্যে, যা এখান আর নেই।

বিজ্ঞানীরা যখন কোন জায়গার সাথে তাঁর বাসিন্দাদের সূত্র খোজেন তখন তারা অন্য জীব জন্তুর সাথে আশপাশের জায়গার মিল খুজতে থাকেন। এইখানে কিন্তু দেখা গেল যে দ্বীপে সে সমস্ত জন্তুর হাড় পাওয়া যাচ্ছে সেটা হচ্ছে ইদুরের, যে ধরনের ইদুর পেরুতে পাওয়া যায়। তাছাড়া স্থানীয় অধিবাসীদের চেহারা, হাওয়াই দ্বীপ বা অস্ট্রেলীয় চেহারার সাথে না মিল রেখে ইনকাদের সাথে কিছুটা মিল পাওয়া যাচ্ছে।  দ্বীপপুঞ্জের অন্য দ্বীপের লোকেদের বংশ পরম্পরা, তারা  ইনকাদের মত দড়িতে গিঁঠ গুনে গুনে বলতে পারছিল। তবে কি ওরা ইনকাদের থেকেই এসেছে।

আফ্রিকার থেকে দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব উপকূল, আবার তার পরে আমেরিকার পশ্চিম উপকূল থেকে পলিনেশিয়ান দ্বীপগুলোর দিকে এক স্রোত প্রতিনিয়ত বয়ে চলেছে। এটা ভর করে লোকে তো জাহাজেও আসতে পারে। কিন্তু কাঠের জাহাজের প্রচলন কলম্বাসের আমেরিকা আসার আগে হয়নি। কিন্তু তাঁর আগেও তো লোকে সমূদ্রে যাত্রা করেছে। কি ভাবে দেখতে গিয়ে দেখা গেল যে বালসা কাঠের ভেলা বানিয়ে তাতে করে সমূদ্রে যাত্রা করার কথা ইতিহাসে আছে। বালসা এক ধরণের গাছ, যার কাঠ হয় অত্যন্ত হাল্কা, আগে এরোপ্লেন বানানোর কাজে এর ব্যবহার খুব ছিল। হাল্কা ধাতু আবিস্কারের পরে আর এটা ব্যবহার হয়না, তবুও কিছুদিন আগে পর্যন্ত খেলনা প্লেন (মডেল এরোপ্লেন) তৈরী হত এই কাঠ দিয়ে।

যখন ইউরোপীয়েরা এই সব দ্বীপগুলোকে আবিস্কার (?) করল তখন কিন্তু দেখা গেল যেসব জায়গাতে মানুষেরা আছে, সেখানে কিন্তু লোকে চাষ আবাদ করছে, জন্তু জানোয়ার অন্য জায়গার মতনই পোষ মানিয়ে, তাদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। তবে এটা কিসের আবিস্কার। যারা এখানে আছে তাঁর তো এই ইউরোপীয়দের আগেই এসে এটাকে আবিস্কার করেছে।

এটা দেখা গেছিল যে এই দ্বীপগুলোতে ৫০০ থেকে ১১০০ খৃষ্টাব্দের মধ্যেই বসতি হয়েছে তাঁর আগে এই দ্বীপগুলোতে মানুষেরা থাকত না। এর আদিম বাসিন্দাদের চেহারার সাথে কিন্তু পলিনেশীয়, বা নিগ্রয়েড অথবা মোঙ্গলয়েড জনগোষ্ঠির মিল নেই। বরং এদের সাথে মিল খুজে পাওয়া গেছে ভারতের (সিন্ধু নদের অববাহিকা র এলাকা) লোকেদের সাথে আর ইনকাদের সাথে। কিন্তু ভারতের থেকে এখানে কোন জনজাতির আসা সম্ভব বলে মনে হয়না।

ঘুরে ফিরে যখন সেই নিশানাটা ইনকাদের দিকেই যাচ্ছে তখন দেখা গেল যে স্পেনীয়দের আসার আগে যে ইনকাদের পিরামিড, নগর সব পাহাড়ের উপরে ছিল সেগুলো কিন্তু এই প্রজন্মের ইনকাদের তৈরী নয়। এগুলো তৈরী করে গেছেন তাদের আগের কোন এক প্রজন্ম যাদের সাথে এই প্রজন্মের ইনকাদের চেহারার মিল খুব বেশী নেই।
“এরা উত্তরদিক থেকে এসেছিলেন, আর আমাদের কি ভাবে কি  কি করতে হয়, এই সব ইঞ্জিনিয়ারিং, স্থাপত্যকলা শিক্ষা দিয়ে গেলেন। লম্বা দেখতে, মুখে সাধারণত দাড়ি থাকত আর দেখতে ফর্সা রঙ। তাঁর পর তারা আবার পশ্চিম দিকে সমূদ্রের ওপারে হঠাত চলে গেলেন”। এই খবরই কিন্তু জিজ্ঞাসা করে পাওয়া গেছিল পরের প্রজন্মের ইনকাদের কাছ থেকে। কিন্তু পেরুর পশ্চিমে তো প্রশান্ত মহাসাগর। তবে কি তারা সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন। ওদিকে পলিনেশীয়ান দ্বীপগুলোতেও দেখা গেল লোকেরা বেশ ফর্সা, লম্বা এবং সাধারনত দাড়ি যুক্ত মুখমন্ডল।

তাহলে এই টিকি কে, যিনি তাঁর সাথে সারা অনুগামীদের নিয়ে এই রাপা নুইতে চলে এসেছিলেন। খুজতে খুজতে পাওয়া গেল পেরুতে ইনকাদের সুর্যের দেবতা ভিরোকচার নাম। অবশ্যি ভিরোকচার আদি নাম ছিল টিকি কন টিকি বা ইল্লা টিকি। এও কথাতে পাওয়া গেল যে এই কন টিকির অনুগামীদেরকে টিটিকাকা হ্রদের ধারে এক কারি সম্প্রদায় যুদ্ধে হারিয়ে দ্যায়। এই টিটিকাকা হ্রদের পাড়েই কনটিকির তৈরী বিশাল বিশাল মনুমেন্ট আজ দেখতে পাওয়া যায়। যুদ্ধে হেরে কন টিকি তাঁর অনুগামীদের যাদের বাঁচাতে পেরেছিলন তাদের নিয়ে সাগর পার হউএ পূর্ব দিকে চলে যান। তাহলে বোঝা যাচ্ছে কনটিকি হছে সেই সুর্যদেবতার প্রধান পুরোহিত।
থরের একটা লক্ষ পূরন হল কিন্তু যতক্ষন না কেউ সাহস করে এই দীর্ঘ সাডে চার হাজার মাইলের সমূদ্রপাড়ি না দিচ্ছে ততক্ষন ঐ  কন টিকির কথা আর কেউ বিশ্বাস করবে না। শুরু হল তাঁর প্রস্তুতি। সমূদ্র পার হয়ে পলিনেশিয়ান দ্বীপে যাবার।


কিন্তু তাঁর আগে তিনি যে তাঁর যুক্তি দিয়ে যে প্রস্তাবনা লিখেছিলেন আর বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের কাছে পাঠিয়ে ছিলেন তাদের কাছ থেকে বিশেষ কিছু উৎসাহ পান নি। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপের এদিক থেকে ওদিকে ধ্বংসলীলা চালিয়ে বেড়াচ্ছিল।  যখন নরওয়ের উপর জার্মান সৈন্য বাহিনী হামলা করে দখল করে নিল থর তাঁর সব কিছু বন্ধ করে সেই যুদ্ধে যোগ দিলেন।

১৯৪৫ সালে যুদ্ধ থামার পরে আবার থর তাঁর ঐ পুরনো ভাবনা নিয়ে চিন্তা শুরু করলেন। থাকছিলেন তখন নিউইয়র্কের নরওয়েজিয়াব নাবিকদের জন্য তৈরী আবাসে, যেটা সস্তা  এবং নরওয়েজিয়ান খাবার পাবার একটা ভাল জায়গা।

এক বিখ্যাত বিজ্ঞানীর কাছ থেকে তিনি তাঁর পান্ডুলিপি ফেরত পেলেন আর তাঁর সাথে আখ্যা পেলেন যে প্রমাণ না দিয়ে এই সব প্রস্তাবনার কোন দাম নেই। থর নিরাশ হলেন কিন্তু হাল ছাড়লেন না,। এক দিন আর এক বন্ধু, যার সারা জীবন প্রায় সমূদ্রের উপরেই কেটেছে, তাঁর সাথে বিকেলের চায়ের সময় কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেই ফেললেন যে বালসা কাঠের ভেলাতে করে কি আমেরিকা থেকে পলিনেশিয়া যাওয়া সম্ভব। বন্ধুর কাছ থেকে হ্যাঁ উত্তর তাঁকে যে কতটা খুশী করেছিল তা কিন্তু তিনি তাঁর বইএ লিখেছেন।
 কিন্তু যখন তিনি বললেন যে তিনি ভাবছেন এই রকম একটা ভেলাতে চড়ে যাবেন তখন কিন্তু বন্ধু তাঁকে বারণ করলেন। বললেন যদিও তিনি বিশ্বাস করছেন যে ইনকাদের দল এই রকম বালসা কাঠের ভেলাতে চড়ে মহাসাগরে পাড়ি দিয়েছিল, কিন্তু তারা গেছিল দল বেঁধে। একটা ভেলা ডুবে গেলে অন্য ভেলার লোকেরা এদের বাঁচানোর কাজ করেছে।

এই রকম সময়ে তাঁর সেখা হল ন্যুট ওয়াটজিঙ্গারের সাথে। ন্যুট পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, কথায় কথায় তাঁকে থর বললেন এই ব্যপারে। ন্যুট তাতে বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। থর তাঁর আগেই, অভিযাত্রী হিসাবে নিউইয়র্কের এক্সপ্লোরার ক্লাবের সদস্য হয়ে গেছিলেন। সেখানে পিটার ফ্রুসেনের সামনে একদিন এয়ার মেটেরিয়াল কমান্ড থেকে যুদ্ধে ব্যবহৃত এবং পরে তাঁর উপরে আরও উন্নতি করে জিনিষ গুলোকে দেখান হচ্ছিল।

অভিযাত্রীদের কাছে এই জিনিষগুলোর উপকারিতা নিয়ে হেরমানের সাথে কথা হতে হতে হারমান প্রস্তাব দিল তাহলে চল না আমিও সাথে যাই। কি কি জিনিষের দরকার তাঁর একটা লিষ্ট তৈরী হতে লাগল।
অভিযানের জন্য মূল দরকারী জিনিষ টাকা। এক জায়গাথেকে আশার খবর পেলেন যে সমস্ত খবভর তাদেরকেই একমাত্র দিলতে হবে সে সুবাদে তারা তাকা দেবেন। কিন্তু কয়েকদিন বাদে সে টাকাও পাওয়া গেল না । ভদ্রলোক তাঁর কথার খেলাপ করলেন। শেষ পর্যন্ত নরওয়ে সরকারের কাছ থেকে ধার হিসাবে থর কিছু টাকা পেলেন।

নরওয়ের দূতাবাস থেকে আমেরিকার পেন্টাগনের কাছে লেখা চিঠি নিয়ে থর আর হারমান দেখা করতে গেলেন এই সামরিক দফতরে।  বিশাল দফতর যেখানে প্রায় ৩৫ হাজারের উপর লোকে কাজ করেন আর বাড়ীটাতে মাইল ষোলর মতন হবে বারান্দার লম্বাই। কিন্তু আসল কথা হল যে তারা সৈনিক দফতর থেকে তাদের দরকার মতন, আপতকালীন উদ্ধারের জিনিষপত্র, টিন বন্ধ খাবার ইত্যাদি পেয়ে গেলেন।

এবার দরকার দুটি জিনিষের। প্রথম  হচ্ছে বালসা গাছের গুড়ি প্রয়োজন  মত লম্বা। ইনকাদের সময়ে লোহার ব্যবহার ছিল না কাজেই বালসা কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি করা যাবে না। কিন্তু পেরুতে গিয়ে দেখা গেল সে জিনিষের অসুবিধা। প্রথমত পেরুর জঙ্গল থেকে সমূদ্র উপকুলে ঐ গাছের গুঁড়ি আনতে গেলে অন্য দেশ ইকোয়েডরের উপর দিয়ে আসতে হবে। ইনকাদের থেকে একটা বেশি অসুবিধা কেননা তখনতো আর সীমান্ত রক্ষার জন্য কোন কাঁটা তারের ব্যপার ছিল না।

তাঁর চেয়েও বেশী অসুবিধা সামনে নিয়ে এল সদ্য শেষ হওয়া বিশ্বযুদ্ধ।  উপকুলের কাছের সমস্ত এলাকার বালসা গাছ কেটে এরোপ্লেন তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়ে গেছে। দরকার মত লম্বা গুঁড়ি অমিল। আন্ডিজ পাহাড়ের নীচের দিকে ঘন জঙ্গলে হয়ত পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু বর্ষা নেমে গেছে বলে সেখান যাওয়া প্রায় অসম্ভব। সবাই মত দিল বর্ষা থামলে যত চাই তত বালসা পাওয়া যাবে। থরের সেটা অপছন্দ।

থর ভাবলেন বৃষ্টির জন্য উপকুলের দিক থেকে, মানে গুইয়াকুইলের দিক থেকে জঙ্গলের রাস্তা অগম্য হয়ে থাকতে পারে কিন্তু আন্ডিজ পাহাড়ের উপর থেকে অত অসুবিধা হবার কথা নয়। চলে গেলেন পাহাড়ের উপরে শহর কুইটোতে। সেখান থেকে এক মার্কিন সেনা বাহিনীর জিপে করে কখন পাহাডী গলিপথ ধরে, আবার কখনবা স্রেফ পাকদন্ডীর মতন রাস্তা দিয়ে এলেন বালসার জঙ্গলে। কাঠের সমস্যা মিটল।

আর দ্বিতীয় চিন্তা ছিল সহযাত্রী নির্বাচনের। আনুমানিক হিসাবে তাদের লাগার কথা তিন মাস, বাড়িয়ে নিয়ে সেটা চার মাস। এই দীর্ঘ সময় সহযাত্রীদের মধ্যে একটা সামাজিক সদ্ভাব না গড়ে উঠলে তাদের টিকে থাকা সম্ভব নয়। অনেক হিসাব করে নুট তাঁর যুদ্ধের সময়কালীন সাথী টরষ্টেইন আর হ্যাগল্যান্ডকে আসতে বললেন।

ভেলা বানানোর জন্য থর সাহায্য নিয়েছিলেন স্পেনীয় চিত্রকরদের যারা  ইনকাদের কাছ থেকে তাদের ভেলার চেহারাটা দেখে চিত্রবদ্ধ করেছিলেন। যাত্রার পথে প্রত্যেক চার ঘন্টা অন্তর একজন যাত্রীর জেগে থাকবার কথা, কাজেই সব শুদ্ধ যেকোন এক সময়ে পাঁচ জনের শোয়ার  জায়গা থাকা দরকার, তা ছাড়া তাদের সাজসরঞ্জাম, রশদ ইত্যাদি রাখার জায়গা দরকার। কাজেই ভেলার আয়তন করা হল ৪৫ ফুট(প্রায় ১৩ মি) লম্বা আর ১৮ ফুট (সাড়ে ৫ মি) চওড়া।  লম্বা দিকে ৯টা বালসা কাঠের গুঁড়ি, ২ ফুট (৬০ সেমী) বেধের এক সাথে বাঁধা  হল শনের দড়ি দিয়ে। প্রায় সোয়া ইঞ্চি (৩ সেমী) মোটা দড়ি নেওয়া হল। ভেলার আড়ের দিকে তাকে শক্তপোক্ত করার জন্য ১৮ ফুট (সাড়ে ৫ মি) লম্বা আর ১ ফুট (৩০ সেমি) বেধের গুঁড়ি ৩ ফুট (প্রায় ১ মি) দূর দূরে  দডি দিয়ে বাঁধা হল। ম্যানগ্রোভ গাছের কাঠ দিয়ে একটার সাথে আর একটাকে বেঁধে  ২৯ ফুট উচু (প্রায় ৯ মিটার) মাস্তুল বানাল হল যার পায়া দুটি ভেলার দুদিক থেকে উঠে ইংরাজী A মত চেহারার হল। ভেলার বালসা গুড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে দু ফিট চওড়া পাইন গাছের তক্তাগুলো গুজে দেওয়া হোল। ভেলাকে জলের সাথে সমান্তরাল রাখার জন্য। ভেলার সামনের দিকে জলের ঢেউএর জন্য বেড়ার বন্দোবস্ত করা হল।

থাকার জায়গার জন্য মাস্তুলের গায়েই বাঁশের দর্মা দিয়ে একটা সাধারণ ঘরের মাপে ১৪ ফুট লম্বা আর ৮ ফুট চওড়া ঘর তৈরী করা হল। তাতে  কলাপাতার ছাউনী দেওয়া হল, দেয়াল হল ৪/৫ ফিটের মত উচু।
এক ১৯ ফুট লম্বা ম্যানগ্রোভের কাঠে ফার গাছের তক্তা লাগিয়ে তৈরী করা হল দিশা বদল করার জন্য হাল।  স্রোতের সাথে সাথে বাতাসের সাহায্যের জন্য একটা বড় পালের ব্যবহার করা হল। ১৬ ফুট চওড়া আর ১৮ ফুট উচু পাল লাগান হল। তাতে আঁকা হল কনটিকি বা সূর্য দেবতার ছবি।


সমস্ত ভেলাটা আজ কনটিকি যাদুঘরে রাখা আছে।   যাত্রীদের কেউই আজ আর জীবিত নেই। একমাত্র যাত্রী যিনি এই অভিযান সম্পূর্ণ করে উঠতে পারেন নি তিনি হলেন এক টিয়া পাখী, লরিটা। পথে এক বিশাল ঢেউ তাকে ভেলার থেকে টেনে কোথায় নিয়ে চলে যায়। তাঁর দেহের কিছু পালক আজ ঐ যাদুঘরে রাখা আছে ভেলার সাথে।
কিন্তু ঐ আন্ডিজ পাহাড়ের উপরে আর ভেলা বানানো যাবে না। কাজেই এই গুড়িগুলোকে পাঠান হল লিমার নৌসেনার জাহাজ বানানোর কারখানাতে। সেখানেই আস্তে আস্তে তৈরী হতে লাগল কন টিকি। ন্যুট অবশ্যি একটা বিষয়ে সাহস দেখান নি যে শুধুমাত্র ছবি অনুযায়ী ভেলা বানিয়ে তাতেই যাত্রা শুরু করবেন। বহুবার তাঁর পরীক্ষা জলের উপরে করেছেন যাতে তিনি নিজে নিশ্চিত হন যে ভেলাটা সমূদ্রযাত্রার জন্য উপযোগী হচ্ছে।
ইতিমধ্যে তাঁর সহযাত্রী নির্বাচন সম্পুর্ণ করা হয়েছে। প্রথম সহযাত্রি হলেন হেরম্যান ওয়াটজিঙ্গার। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, কোম্পানির কাজে নিউইয়র্কে এসেছিলেন আর আচমকাই তারা সাথে থরের আলাপ পরিচয় তাকে এই অভিযানে সামিল করে নেয়। তাঁর সাধের চাকরী আর পরিবার পরিজন নরওয়েতে ছেড়ে অভিযানে যোগ দিলেন।
দ্বিতীয় আর তৃতীয় সহযোগী হিসাবে এলেন ন্যুট হ্যাগল্যান্ড আর টরষ্টেইন রাব্বি। এদের দুজনের সাথ থরের পরিচয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে। দুজনেই রেডিও সম্প্রচারের ব্যাপারে বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত আর জার্মান সেনাদের লুকিয়ে জাহাজ বিসমার্কের খবর পাঠানর কাজ ছিল এঁদের।
আর চতুর্থ সহযাত্রী হলেন থরের বাল্যবন্ধু এরিক হেসেলবার্গ। দক্ষ নাবিক, এর আগেই তাঁর বার কয়েক সারা পৃথিবী জাহাজে ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা আছে। তাঁর চেয়ে বড় কথা ইনি ছিলেন একজন  শিল্পী। কনটিকি ভেলার পালের উপরে আঁকা সুর্যদেবের মুখের ছবি ইনিই একেছিলেন।
আর শেষজন হলেন বেঙ্গট ড্যানিয়েলসন, উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসীদের সম্বন্ধে তাঁর গবেষনা চলছিল। হঠাত তিনি এসে থরের সাথে যোগাযোগ করে এই যাত্রায় সহযোগী হবার ইচ্ছে প্রকাশ করেন আর যোগ দেন। হয়ে গেল মোট ছজন অভিযাত্রীর পরিচয়।
হ্যাঁ আরও একজন ছিলেন যাত্রা শুরুতে, তিনি হলেন টিয়া পাখী লরিটা। তাঁর পক্ষে এই যাত্রা সম্পূর্ণ করার সৌভাগ্য হয় নি।
তারিখটা ছিল ১৯৪৭ সালের ২৮সে এপ্রিল।   লিমার শহরতলীর নৌসেনার আড্ডা কাল্লাও  থেকে কনটিকির যাত্রা শুরু হল। উপকূলের কাছে অন্য জাহাজ বা নৌকোর সাথে টক্কর না লাগে সে জন্য সমূদ্রের মধ্যে ৫০ সামুদ্রিক মাইল দূর পর্যন্ত তাকে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল। এইবার কনটিকি তাঁর নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে চলতে শুরু করল।  দীর্ঘ ১০১ দিন বাদে ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসের ৭ তারিখে  টুয়ামোটো  দ্বীপপুঞ্জের রাওরিয়াতে এসে পাড়ে ধাক্কা খেল। ক্ষতি হল মাস্তুলটা ভেঙ্গে ড্যানিয়েলসনের উপরে পড়া। ভারতের স্বাধীনতার আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি ছিল। পৌছনোর ৪ দিন বাদে পাশের দ্বীপের অধিবাসীরা এসে তাদের আর কনটিকি ভেলাটাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
কনটিকির যাত্রা সমাপ্ত হল। থর প্রমান করে দিলেন যে পলিনেশিয়ার দ্বীপ সমূহের সাথে দক্ষিণ আমেরিকার যোগাযোগ ছিল। যদিও তাঁর মূল বক্তব্য সঠিক ভাবে এখনও প্রমানিত হয়নি, কিন্তু তাকে নস্যাত করাও যায়নি।
যাত্রার পূর্ণ বিবরণ আর তাঁর সাথে তোলা ছবি নিয়ে পরে বই বার হল কনটিকি। আমার লেখা পড়ে বইখানা অন্তত লাইব্রেরি থেকে এনে পড়লে আমার আনন্দ বাড়বে। যাত্রার বিবরণ এখন কপিরাইট আইনের আওতায় থাকার জন্য দিতে পারছি না। ছবি যা কিছু দিচ্ছি  উইকিমিডিয়ার সৌজন্যে।
কনটিকির দেখাদেখি আরও অনেক সমুদ্রে অভিযান হয়েছে।  কনটিকির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এবং তাঁর সাথে পলিনেশিয়া থেকে আমেরিকায় আসার  জন্য  এক বিশেষ ডাক টিকিট বার করাও হয় ১৯৬২ খৃষ্টাব্দে।
এইখানে বলে রাখি প্রখ্যাত সাতারু মিহির সেনের উতসাহে পশ্চিমবঙ্গের অভিযাত্রিক ক্লাবের পরিচালনায় দাঁড় টানা নৌকোতে গঙ্গাসাগর থেকে আন্দামান দ্বীপের যাত্রা হয়েছিল। তাঁর পরে কথা ছিল পরাদীপ থেকে বালী পর্যন্ত এক অভিযানের। ঠিক জানা নেই সেটা হয়েছিল কিনা।


1 টি মন্তব্য: