অসিরিস আর আইসিস
বহুদিন আগের কথা। রা
মানে সুর্যদেব যখন বেশ বুড়ো হয়ে পড়েছিলেন তখন শুনলেন যে একবার যদি আকাশের দেবী
নুটের ছেলেপিলে হয় তবে কিন্তু তার রাজত্ব খতম। সেই ছেলেরাই রাজপাট সব নিয়ে নেবে।
এদিকে নুট আর পৃথিবীর দেবতা গেবের বিয়ে প্রায় ঠিক । কি করা যাবে। অনেক ভেবে ঠিক
করলেন যে নূটকে যদি শাপ দিই যে তোর
বাচ্চাকাচ্চা হবে না তবেই ঠিক হয়। অতএব যা ভাবা তাই করে দিলেন। মনের দুঃখে
নুট গেলেন থোটের কাছে। কে এই থোট? থোট হলেন রাএর ছেলে, জ্ঞানের দেবতা। তাঁকে একটা
উপায় তো বার করতেই হয়। বুদ্ধি করে থোট
গেলেন চাঁদের দেবতা সিলেনের কাছে।
এ কথা সে কথার পরে বললেন, এস আমার সাথে একটু বাজী ধরে খেলা
যাক। কি খেলা হবে, না পাশা খেলা। একটার পরে একটা দান খেলা হচ্ছে, আর সিলেনে হেরে যাচ্ছে।
শেষকালে সিলেনে তার আলো, মানে চাঁদের আলোর কিছু অংশ বাজী ধরে বসল। আর যথা
নিয়মে হেরেও গেল। সেই থেকে চাদের আলো সূর্যের আলোর থেকে কমজোর। কিন্তু আর তো বাজী
ধরার মত কিছু নেই। অতএব খেলা খতম। থোট তখন তার জেতা আলো গুলো নিয়ে বানালেন পাঁচটা
বাড়তি দিন।
আগে বছর হত তিনশ ষাট দিনে । এখন থেকে আরও পাচদিন বেড়ে হল তিনশ
পয়ষট্টি দিন। এইবার তো আর রাএর অভিশাপ কাজে আসবে না। সে অভিশাপ ছিল বছরের তিনশ ষাট
দিনের উপরে এখন তো তার অভিশাপের বাইরে আরও পাচটা দিন এসে গেছে।
এই পাচদিনের প্রথন দিনে জন্ম নিল অসিরিস, নুটের বড় ছেলে। তার
পরের দিনটাকে সরিয়ে রাখা হল হোরাসের জন্মের জন্য, মানে নুটের নাতির জন্মানর জন্যে।
তৃতীয় দিনে জন্ম নিলে নুটের দ্বিতীয় ছেলে , কালোকুলটি রঙের সেত। চতুর্থ দিনে জন্ম নিল আইসিস আর পঞ্চম দিনে
নেফদীজ। মজা হল এই যে সূর্যদেবের অভিশাপকে
পাশ কাটিয়ে নুটের সন্তানেরা হল। আর সেই
সময়ের প্রথা অনুযায়ী অসিরিস আর আইসিসের মধ্যে, আর সেত আর নেফদীজের মধ্যে পরে বিয়ে
হয়েছিল।
অসিরিস যখন জন্মালেন তখম থেবেসের
মন্দির থেকে ভবিষ্যৎবাণী হয়েছিল যে এই ছেলে সমস্ত বিশ্বে শান্তি আর আনন্দের উৎস
হবে। আর ওদিকে সেত হলেন অন্ধকারের মৃত্যুপূরীর দেবতা। আইসিস রাএর আসল নাম জেনে ফেলার পরে সমগ্র
বিশ্বের রাজপাট চলে গেল তার এবং অসিরিসের হাতে।
অসিরিসের কাছ থেকে মিশরের লোকেরা শিখল
কি করে নীলে নদের বন্যার জল সরে গেলে চাষবাস করতে হয়, কিভাবে কাঁচা মাংস খাবার
বদলে রান্না করে খাবার তৈরী করা হয়। তার পরে অসিরিস শেখালেন তাদের আইন, সমাজ,
আচরণ। মিশরের লোকে হয়ে উঠল সভ্য। এবার অসিরিসের কাজ হল সারা বিশ্বে তার শিক্ষা কে
ছড়িয়ে দেবার। এই সব করার জন্য লোকে অসিরিসের ভক্ত হয়ে পড়েছিল আর সেটাই সেত এর
হিংসার কারণ হচ্ছিল।
ওদিকে অসিরিস যখন বিদেশ থেকে দেশে ফিরে এল তখন সেতই প্রথম
তাকে সাদরে বরণ করে নিল। এটা কিন্তু ছিল ছল। সেতএর বাহাত্তর জন সহকারী মিলে ঠিক
করে নিয়েছিল যে অসিরিসকে মারতেই হবে। সেত রাগে দুঃখে পাগল, ভাবে কি করে অসিরিসের
মৃত্যু হবে। ভেবে চিন্তা করে এক উপায় বার করল।
ঠিক অসিরিসের দেহের মাপ অনুযায়ী একটা
সুন্দর কাঠের কারুকার্য করা বাক্স বানান হল। আর তার পরে অসিরিসকে এক ভোজসভার
নিমন্ত্রণে ডাকা হল। খাওয়ার পরে সেই বাক্স এনে হাজির করা হলে সেত বলে আমি জানিনা
যে এটা কোন সৌভাগ্যবানের মাপের হবে, কিন্তু যারই হক না কেন এটা তারই হবে। সেতএর লোকেরা একের পর একে হুড়োহুড়ি করে চেষ্টা
করতে লাগল। কারুরই ঠিক মাপে হয় না। শেষে কৌতুহলের বশে অসিরিস বলে উঠল, আমি দেখি।
এই বলে সে বাক্সটার মধ্যে ঢুকতেই দেখা গেল একেবারে ঠিক মাপের। অসিরিস বলে তাহলে
এটা আমার। সেত বলে নিশ্চয়ই সারা জীবনের
জন্য। এই বলে বাক্সটাকে পেরেক মেরে বন্ধ করে দিয়ে সীসের চাদরে মুড়ে নীল নদের জলে
ফেলে দিল। নীল নদের দেবী হাপী, সেই বাক্সটাকে নিয়ে গেলেন সমূদ্র পারে ফিনিসিয়ার
উপকূলে।
অসিরিসের মৃত্যু হল, কিন্তু না তা নয়। তার আত্মা বেচে রইল। ওদিকে অসিরিসের
দেহ নিয়ে বাক্সটা বিবলসের উপকূলের একটা গাছের গোড়ায় গিয়ে পড়ল, গাছটাও পরম মমতার
সাথে সেই বাক্সটাকে তার নিজের ভেতরে লুকিয়ে নিল যাতে সেত তার কোন খবর না পায়।
ইতিমধ্যে ফিনিসিয়ার বিবলসের রাজা
সস্ত্রীক একবার ঐ উপকূলে এসে গাছটাকে দেখে খুব মুগ্ধ হন আর বলেন এটাকে কেটে আমার
প্রাসাদে নিয়ে এস যাতে এটা দিয়ে আমার প্রাসাদের ছাতের জন্য একটা সুন্দর স্তম্ভ
বানান যায়। তাই করা হল। ইতিমধ্যে আইসিস তার শিশু পুত্র হোরাস কে নিয়ে কেঁদে কেঁদে
সারা বিশ্ব অসিরিসের জন্য পাখী হয়ে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। তার সেই কান্না সাহারার
সিমূম ঝড়ের হাওয়ার আওয়াজের মত হয়ে ঘুরতে লাগল। শেষে সেতের ভয়ে তিনি গিয়ে বুটো
দেবীর বাসস্থান এক দ্বীপে আশ্রয় নিলেন, আর তার হাতে হোরাসের দায়ীত্ব সঁপে দিলেন।
আরও নিরাপত্তার জন্য সেই দ্বীপটাকে তার মূল থেকে আলাদা করে দিলেন যাতে সেটা
সমূদ্রে ভাসতে থাকে আর কেউ তার ঠিকানা জানতে না পারে।
তার পরে শুরু হল অসিরিদের দেহটাকে আরও ভাল করে
খোঁজা। অনেক এদিক ওদিক খোঁজার পরে দুটি শিশু আইসিসকে খোজ দিলে যে ঐ রকম একটা
বাক্সকে তারা নদীরে জলে ভেসে যেতে দেখেছে। আইসিস গেলেন নদী ধরে সমূদ্রের পারে,
সেখানে অনেক খোঁজ করার পরে আবার দুটি শিশু তাকে খবর দিলেন বাক্সটা কোন দিকে গেছে।
আইসিস খুসী হয়ে বলে দিলেন যে শিশুরা এর পর থেকে সত্যি কথাই বলবে।
আইসিস অসিরিসের দেহ খুজতে খুজতে গিয়ে
বিবলসে হাজির হলেন। এক ঝর্ণার ধারে বসে
ভাবছেন কোথায় খোঁজ পাওয়া যায়, এর মধ্যেই বিবলসের রানীর চাকরাণিরা এক দিন ঐ ঝর্নাতে
স্নান করতে এলে আইসিস তাদের চুলে ভাল করে বিনুনী করে সাজিয়ে দিলেন। তারা
রাজপ্রাসাদে পৌছালে রাণি তাদের বিনুনী দেখে এবং গায়ে সুগন্ধ পেয়ে সব জিজ্ঞেস করলে
তারা সব কথা বলে। রাণিমা গিয়ে আইসিসকে প্রাসাদে নিয়ে আসেন। আর তার ছোট ছেলে
ডিক্টিসকে দেখভাল করার কাজ দিয়ে দেন।
ছোট্ট ডিক্টিসকে আইসিসের খুব পছন্দ
হয়ে গেছিল। তাই তাকে তিনি অমর করে দিতে চাইছিলেন। সেই হিসাবে রোজ রাত্রে ডিক্টিসের
শরীরে আগুন লাগিয়ে তার নশ্বর দেহটাকে একটু একটু করে পুড়িয়ে দিতে লাগছিলেন। কিন্তু
রাণীমা একদিন দেখে ফেলায় ঘরে ঢুকে পড়েন আর আইসিসের দেবীচেহারা দেখে ফেলেন।
ডিক্টিজকে অমর করার এই কাজ আর সমাপ্ত হয় না। ইতিমধ্যে আইসিস রাণীমার কাছে সেই
স্তম্ভটা চান। রাণিমা খুসীমনে সেটা তাঁকে দিয়ে দেন।
স্তম্ভ থেকে অসিরিসের দেহ ভর্তি
বাক্সটা বার করে নিয়ে স্তম্ভটা আইসিস
রাণিমাকে ফেরত দিয়ে দিলেন যাতে তার প্রাসাদের ছাতের কোন ক্ষতি না হয়।। আর বাক্সটা
নিয়ে আইসিস মিশরের দিকে রওয়ানা দিলেন। নিশরে পৌঁছে দেখেন তার অবর্তমানে তখন সেত
রাজত্ব করছে। তাই সেই বাক্সটাকে এক ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রেখে হোরাসকে আনতে বুটোর কাছে চলে গেলেন।
ওদিকে সেত একদিন শূয়োর মারার জন্য তার
লোকজন দলবল নিয়ে ঐখানেই এসে পড়ল। কুকুরেরা ঝোপের ভেতর থেকে সেই বাক্সটাকে আবিস্কার
করলে, সেত রাগে লাল হয়ে উঠল। ক্ষেপে গিয়ে কুড়ুল দিয়ে অসিরিসের শরীরটাকে বিয়াল্লিশ
টুকরো করে নীল নদে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল যাতে নদের কুমিরেরা তার দেহটাকে খেয়ে নেয়।
কিন্তু কুমীরেরা কি বুঝে সেটা আর খায়নি। খালি সেহের একটা টুকরো এক মাছে খেয়ে
নিয়েছিল। সেই থেকে মিশরের লোকেরা সেই মাছটা আর খায় না।
আইসিস আবায় কষ্ট করে অসিরিসের দেহের
টুকরোগুলো জোগাড় করে তাকে কাপড় জড়িয়ে আসল চেহারার মত করে লুকিয়ে রেখে দিল।যদিও
দেহের সমস্ত টুকরো গুলো পাওয়া যায় নি তবুও আইসিস তার যাদু ক্ষমাতার বলে সেটাও তৈরী
করে নিলেন।এদিকে সেত গর্ব করে বলে বেড়াতে লাগল যে ভগবানের মৃত্যু হয় না, কিন্তু
আমি অসিরিস ভগবানের দেহটাকে টুকরো টুকরো করে তাঁকে মেরেছি। কিন্তু এবার তার স্ত্রী
নেফদীজ আর সেতের সংগ দিল না, সে চলে গেল অসিরিসের দলে। এবং আইসিসের খোঁজার ব্যপারে
আইসিসকে সাহায্য করতে লেগেছিল। আর অসিরিসের দেহটা আবার জোড়া দিয়ে তৈরী করার পরে
তার আত্মা চলে গেল মৃতদের রাজত্বে। অপেক্ষা রইল সেই দিনের যে দিন হোরাস আর সেতের
লড়াইএ হোরাসের জয় হবে।
হোরাস বড় হয় আর তাঁকে অসিরিসের আত্মা
এসে নানান ভাবে জ্ঞান দ্যায়। একবার এই রকম জিজ্ঞেস করা হল যে পৃথিবীতে সবচেয়ে মহান
কাজ কি। হোরাসের উত্তর ছিল যে বাপ-মার প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধ লড়ে তার প্রতিকার
করা। আবার জিজ্ঞাসা করা হল যে তাতে সবচেয়ে কোন জন্তুর দরকার পড়তে পারে, হোরাসের
উত্তর ছিল ঘোড়ার, কিন্তু কেন সিংহ নয় প্রশ্ন করা হলে হোরাস বলে যে সিংহ তো
সাহায্যের দরকার হলে কাজে আসবে, কিন্তু ঘোড়া শত্রুকে ধাওয়া করে তাকে ধরতে কাজে
লাগবে। অসিরিস বুঝলেন সময় হয়েছে সেতের
বিরুদ্ধে হোরাসের লড়াইতে যাবার।
লড়াই শুরু হল। সেত এক বিশাল বুনো শূয়োরের
চেহারা ধরে এসে হোরাসকে আক্রমন করল, কেননা অসিরিস আর রাএর দেওয়া জ্ঞানের মধ্য এই
ব্যপারে হোরাসকে কিছু বলা ছিল না। হোরাস তার চোখে আঘাত পেয়ে যন্ত্রণাতে কাতর হলে
সূর্যদেব রা তার আলো কমিয়ে অন্ধকার করে দেন আর হরাসের যন্ত্রনা উপশম হয়। কিন্তু
ততক্ষনে সেত যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়েছে।
এই রকম ভাবে দফায় দফায় যুদ্ধ হতে থাকে
কিন্তু কেউই শেষ পর্যন্ত জেতে না। অসিরিস তার দিনের অপেক্ষায় থাকে যেদিন সেত
একেবারেই পরাজিত হবে আর সে আবার গিয়ে মিশরের লোকেদের সুখ শান্তির বৃদ্ধি করবে।
আমরাও সেই দিনের অপেক্ষায় থাকি যে দিন
ন্যায় আন্যায়ের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে অন্যায়কে পৃথিবীর বুক থেকে একেবার সরিয়ে দিতে
পারবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন