ঘাসের ভেলায় সমুদ্রে পাড়ি
সময়টা ছিল ষাটের দশকের মাঝামাঝি। কনটিকির যাত্রা শেষ
হবার পরে থর হেয়ারডালের চিন্তা আসে যে দক্ষিণ আমেরিকার থেকে যেমন ইনকাদের পলিনেশিয়াতে
যাওয়া সম্ভব হয়েছিল সেই রকম নিশ্চয়ই আফ্রিকা থেকেও ক্যারিবিয়ান দ্বীপসমুহে যাওয়া
সম্ভব ছিল। কিন্তু ইউরোপের লোকেদের ধারণা ছিল যে কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরী জাহাজের
সাহায্য ছাড়া কোন মহাসাগর পারাপার করা সম্ভব নয়। আর কাঠের ব্যবহার তক্তা হিসাবে
তখনই সম্ভব যখন ধাতুর ব্যবহার শুরু হয়েছে। কাজেই সাগরের পাড়ি দেবার চিন্তা থাকা ঐ
প্রাগৈতিহাসিক যুগে সম্ভব ছিল না। কিন্তু থরের
চিন্তা এল নিশ্চয় কিছু গাছের মত কোন জিনিষের ব্যবহার করা হয়েছিল যেটা একসাথে করে
তক্তার বদলে ব্যবহার করা হয়েছিল।
যেহেতু আফ্রিকাতে বালসা গাছ হয় না তাই তার নজর গেল আবার
ঐ দক্ষিণ আমেরিকার টিটিকাকা অঞ্চলে পাওয়া যায় টোটোরা ঘাসের দিকে। তাদের জল নিরোধক ক্ষমতার জন্য টিটিকাকা
হ্রদের উপরে উরু সম্প্রদায়ের লোকেরা এই ঘাস দিয়ে তৈরী দ্বীপের উপরে ঘাসের তৈরী
বাড়ীতে বসবাস করে এবং তারা এই ঘাস দিয়ে তৈরী নৌকোতে চড়ে শিকার করে। দেখা গেল যে আফ্রিকাতে
পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায় যে প্যাপিরাস গাছ বা ঘাস, সেটাও ঐ একই গোত্রের গাছ, কাজেই অনুমান
করা হল যে তার ক্ষমতাও একই রকমের। কিন্তু
প্যাপিরাস ঘাসের বিশেষজ্ঞেরা এই ব্যপারে একেবারেই সহমত ছিলেন না। তাদের মতে
এই দীর্ঘ তিন হাজার মাইলের জলযাত্রা প্যাপিরাসের পক্ষে সম্ভব নয়, কেননা স্বাদু
জলেই প্যাপিরাস দিন পনেরর মধ্যেই পচে যায়্ তো নোনা জলের প্রভাব আরও ভয়ঙ্কর হবে।
ঐ বৈজ্ঞানিকেরা
একটুকরো প্যাপিরাসকে জলে ফেলে দিয়ে প্রমান করতে চাইলেন যে সেটা জলে ডোবে। তার
উত্তরে থরের বক্তব্য ছিল, এই প্রমাণ দ্বারা এটাই বোঝা যায় যে লোহার তৈরী জাহাজও
জলে ডোবে।
অনেক ভাবনা চিন্তার পরে মিশরের সরকার রাজী হলেন যে গিজার
কাছে এই রকম একটা জাহাজ তৈরী করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। থর জোগাড় করে নিলেন চাদ
এর থেকে বুদুমা জাতির আদিবাসী দের জাহাজ বানানোর জন্য। কারণ হল এই জাতির লোকেরা
এখনও দক্ষিন আমেরিকার উরু জাতির মত ভাসমান দ্বীপে বাস করে। কিন্তু জাহাজ তৈরী করতে
একটা নক্সা চাই, আর সেই অনুযায়ী প্যাপিরাস ঘাসের জোগাড়ও চাই।
সুইডেনের বিয়র্ণ ল্যান্ডষ্ট্রম একটা নক্সা বানিয়ে দিলেন
যে কি রকম দেখতে হওয়া উচিত এই জাহাজের। হিসাব করে দেখা গেল কম করে তিন লাখের মত
প্যাপিরাস ঘাসের কান্ডের দরকার পড়বে, কোথায় পাওয়া যাবে? ঠিক করে ফেললেন ইথিয়োপিয়ার
টানা হ্রদে এসব গাছগুলোকে আবাদ করা হবে। কিন্তু আনা হবে কি ভাবে, কারণ তখন আরব-ইস্রায়েল
যুদ্ধ চলছে সুয়েজের আশে পাশে। কিন্তু থরের মত লোক এই সব কিছুতে পিছোতে রাজী থাকেন না। ৫০০০ বছর বাদে আবার সেই
প্যাপিরাসের জাহাজ তৈরির কাজে তিনি হাত লাগালেন।
শুধু তৈরী নয়, তার পরে সেটাকে নিয়ে মরক্কোতে যাওয়া, যেখান থেকে আটলান্টিক
মহাসাগর পাড়ি দেবার যাত্রা শুরু করা হবে।
এই জাহাজ তৈরির সময় থর মাঝে মাঝে গিজার সমাধিগুলোতে গিয়ে
দেখে আসতেন যে তার কাজের সাথে পুরনো দিনের জাহাজের ছবির কতখানি মিল আছে।। একটা
জিনিষ তাকে ভাবাচ্ছিল। পুরনো দিনের ছবিতে একটা দড়ির টানা জাহাজের সামনে থেকে পেছনের
হাল পর্যন্ত দেখানো হচ্ছিল। থর বা তার কারিগরেরা কিন্তু সেটার কোন উপযোগীতা খুঁজে
বার করতে পারলেন না। অতএব ওটাকে বাদ সেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। তার কারণ
প্যাপিরাসের কান্ডগুলোকে তো এমনিতেই
বেঁকানো সম্ভব হয়েছে।
তারিখটা ছিল ১৯৬৯ সালের ২৮সে এপ্রিল। ঠিক বাইশ বছর আগে
এমন দিনে শুরু হয়েছিল কনটিকির যাত্রা। এবার থর তার ভেলার নাম দিলেন রা,
মিশরীয় পুরাণের সূর্য দেবতা। মরক্কোতে এসে
পৌছাল রা।
৪৫ ফুট লম্বা রা প্রথম। সাথে যাচ্ছে থর কে নিয়ে আট জন
অভিযাত্রী। যাত্রিরা হলেন থর হেয়ারডাল, নর্মান বেকার, কার্লো মাউরি, ইউরি
সেঙ্কেভিচ, সান্টিয়াগো জেনোভে, জর্জেস সুরিয়াল এবং আবদুল্লা জিব্রাইনে। আটজন আট
দেশের লোক।
মরক্কোর সফি বন্দরে রা কে সমুদ্রে ভাসান হল তার সব
মালপত্র ভরবার জন্য। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২৫ মে রা তার যাত্রা শুরু করল।
কিন্তু প্রথম দিনেই বিপদ, থরের নজরে এল যে দিকনির্দেশের জন্য দুটো হালই ঢেউএর
ধাক্কায় ভেঙ্গে গেছে। এখন আর রা কে ডাইনে বায়ে করার কোন উপায় নেই, স্রোতের উপরই এর
যাত্রাপথ নির্ভর করছে। অন্য সহযাত্রীরা যদিও ভয় পেয়েছিলেন যে তাদের অভিযান হয়তো
বিফল হবে, কিন্তু থরের মনে অন্য চিন্তা এসে গেল। এখন তাহলে তাদের অবস্থাটা হচ্ছে
সেই প্রাচীন নাবিকদের মত, যারা ভাঙ্গা মাস্তুল আর পালের জাহাজে শুদ্ধু সমূদ্রের
স্রোতের উপর নির্ভর করে তাদের প্রাণ বাচিয়েছে। তাহলে এখন রা আরও একটা পরীক্ষাতে
নেমে পড়েছে, কি ভাবে নাবিকেরা আগেকার দিনে
তাদের প্রাণ বাচাত।
রা এর বর্তমান
অবস্থা দেখে নর্মান বেকারের চক্ষু স্থির, বেচারা ফ্লুতে ভুগছিল তাও তার দায়িত্বে
ছিল রা কে ডাইনে বায়ে ঘুরিয়ে চালানোর। এখন আর তার কোন কিছু করার দরকার নেই। ঢেউ জাহাজের পাশে এসে থাপড়া মারছে আর উপর দিয়ে
জল বয়ে যাচ্ছে। অভিযাত্রীদের অবস্থা জাহাজের যাত্রী না হয়ে জাহাজের মালপত্রের মত
হয়ে গেছে।
রা এর পরের বিপদ এল আফ্রিকার উপকূলের ক্যানারী
দ্বীপসমূহের পুর্ব দিকে কেপ জুবি পার হবার সময়। হাল ভাঙ্গা অবস্থাতে রা সোজা
পশ্চিম দিকে রওয়ানা দিল। সোজা আটলান্টিক পার হবে বলে। মজার জিনিষ দেখা গেল যে পাল
তোলা নৌকোর মতন কিন্তু রা এর সামনের দিকটা
জলের থেকে উপরে থাকছে আর শুখনো আছে, কিন্তু পেছনের দিকে মানে হাওয়া যে দিক থেকে
আসছে সে দিকে সে জলের কাছে নীচু হয়ে যাচ্ছে, আর সমুদ্রের জল প্যাপিরাসের কান্ডগুলোকে
ভিজিয়ে মোটা করে তুলছে। বাধ্য হয়েই সমস্ত মালপত্রকে আবার আগে পিছে করে সাজাতে হল
যাতে জাহাজ আবার জলে সমান ভাবে ভাসে। মে মাসে ৩১ তারিকে জুবী অন্তরীপ পার হয়ে রা
এগিয়ে চলল।
ইতিমধ্যে জোগাড়যন্ত্র করে একটা কাজ চালানোর মতন হাল তৈরী
করা হয়ে গেছে। জাহাজের উপর দিয়ে আর জল বয়ে যাচ্ছে না। কিন্তু এই বার বোঝা গেল যে
জাহাজের সামনে থেকে পেছন পর্যন্ত যে দড়িটাকে ছবি গুলোতে দেখান ছিল তার কি কাজ।
ওটার কোন কাজ বুঝতে না পেরে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দড়িটা জাহাজের পেছন দিকটাকে টেনে উপরে তুলে
রাখে। এখন যত দিন যাচ্ছে ততই জাহাজের
পেছনের দিক জলের নিচের দিকে যাচ্ছে।
জুলাই মাসের প্রথম দিকে রা প্রায় আধাআধি রাস্তা পার হয়ে
এসেছে। বারবাডোজ আর মাত্র দেড় হাজার মাইলের মত দূর। ইতিমধ্যে এটা দেখা গেছে যে এই
প্যাপিরাসের তৈরী জাহাজ চালানর জন্য দক্ষতার প্রয়োজন। কিন্তু ক্রমশ রা জলে ডোবার
উপক্রম হতে লাগল।
শেষে জুলাই মাসের ১৮ তারিখে রা এর উপরে আর ভরসা করা গেল
না। এবার জাহাজ ছেড়ে অন্য কিছুর আশ্রয় নিতে হয়। কিন্তু কোথায় সেটা । জলে রা এর
চারদিকে হাঙ্গরেরা ঘোরাফেরা করছে, অবশেষে এক ইয়াট এসে তাদের উদ্ধার করে নিল। রা
প্রথম তার যাত্রা সমাপ্ত করতে পারল না।
থর কিন্তু এত সহজেই হার মেনে নেবার লোক ছিলেন না। আর যখন
রা প্রথম এর অসাফল্যের কারন জানতে পারা
গেছে তখন আবার দ্বিতীয়বার অভিযান করতে বাধা কোথায়। শুরু করে দিলেন রা দ্বিতীয়ের
তৈরীর ব্যবস্থা করতে।
১৯৭০ সালে আবার থর ফিরে এলেন মরক্কোতে আর একবার সেই
প্যাপিরাসের তৈরী জাহাজ নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দেবার ইচ্ছে নিয়ে, এবার আর চাদের থেকে
বুদুমা আদিবাসীদের সাহায্য নয়। নৌকো তৈরী করতে সাহায্য করবে দক্ষিণ
আমেরিকার সুরিকুই থেকে আসা টিটিকাকা দ্বীপের আয়মারা সম্প্রদায়ের লোকেরা, যারা এখনও
তোতোরা ঘাসের তৈরী নৌকোতে টিটিকাকা হ্রদের উপরে যাতায়াত করে। সমস্ত কাজটাই গোপন ভাবে শুরু করা হল কারণ থর
জানতেন যে এবার যদি বিফল হন তবে তার নামে লোকে ধিক্কার দেবে হঠকারী বলে। এবার আর প্যাপিরাস দিয়ে তৈরী নয় এবার বানানো
হচ্ছে সেই তোতোরা ঘাস দিয়ে।
কিন্তু এই যে মাঝখানের সময়টা গেছে সেই সময় থর পুরনো
সমাধির গাত্রচিত্র দেখে, আর যারা এই ধরনের নৌকো বানায় তাদের সাথে আলোচনা করে তার
জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। সাথে ছিল রা প্রথমের বিপর্যয়ের থেকে শিক্ষা। এবার
আর কিছুই ভাগ্যের উপরে ছাড়া হবে না এই ছিল মূল মন্ত্র।
১৯৭০ সালের ১৭ই
মে, রা দ্বিতীয়ের যাত্রা হল শুরু। রা প্রথম থেকে ৭ ফুটের মতন লম্বায় ছোট। জাহাজের চওড়া হচ্ছে ষোল ফিট। আর উচ্চতাতে ৬ ফিটের
মত। প্রথম বারের মত এবার ৯ জন সহযাত্রী
সাথে রওনা দিলেন। এবার আর জিব্রাইনে সাথে নেই, তার বদলে এসেছেন জাপানী কার্ল ওহারা
আর মরক্কোর মাদানী উহান্নী।
জলে নামানোর পরে দেখা গেল রা দ্বিতীয় রাকে প্রথম রা য়ের চেয়ে চালানো সহজ হয়েছে। কিন্তু মালপত্র তোলবার পরে
দেখা গেল নৌকোর মাত্র তিন ফুটই জেগে আছে
জলের উপরে।
এবার আর জুবী অন্তরীপ হয়ে যাত্রা নয়। আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেবার জন্য সোজা পশ্চিম
দিকে যাত্রা শুরু করা হল।
কিন্তু দু সপ্তাহ পেরোতে না পেরোতেই দেখতে পাওয়া গেল রা
দ্বিতীয় জল সহ্য করতে পারছে না। তার তিন ফুট যে জলের উপরে ছিল তার থেকে দু ফুটের
মতো এখন জলের নীচে। এখন আছে মাত্র এক
ফুটের মত উপরে জেগে। আর এক সপ্তাহ পার হতে
না হতে দেখা গেল সেটাও জলের নীচে, সমূদ্রের জল এখন নৌকোর উপর দিয়ে বয়ে চলছে। তাহলে
কি রা তার দ্বিতীয়বার যাত্রা শেষ করতে পারবে না। নৌকোর ভার কমাতে যাত্রীরা তাদের
মালপত্র ফেলে দিতে শুরু করলেন। এমন কি তাদের লাইফবোট কেও ফেলে দেবার কথা চিন্তা
করতে লাগলেন।
এইতি মধ্যে কেপ ভার্ডে দ্বীপসমূহ কাছেই চলে এসেছে। যাত্রীরা
ভাবতে শুরু কর দিলেন যে এবার তাহলে সেখানেই যাওয়া যাক। আপাতত যাত্রা পথ বদল করে
জাহাজকে কিছুটা দুরুস্ত করে নেওয়া যাক। সকালে
দেখা গেল কেপ ভার্ডে দ্বীপকে দেখা যাচ্ছে সামনের দিকে একটু বা দিক ঘেসে। থর কিন্তু
তার জাহাজকে সোজা পশ্চিম দিকেই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। দুপুরে দেখতে পাওয়া গেল
দ্বীপ একেবারে বা দিকে মাত্র মাইল আষ্টেক দূরে। আর সন্ধ্যের দিকে দেখা গেল দ্বীপ প্রায়
ষোল মাইল পেছনে পড়ে আছে।
এখন আর ফেরার উপায় নাই। যতক্ষণ ভেসে থাকার আশা আছে ততক্ষণ
এই রা তেই থেকে এগিয়ে চলতে হবে। যাত্রীরা নিজেদের মধ্যে ভোট নিলেন যে যাত্রায়
ক্ষান্তি দেওয়া হবে না আগে এগিয়ে যাওয়া হবে। তাতে মাত্র একটাই ভোট পড়ল যাত্রা
চালিয়ে যাবার পক্ষে। কে পক্ষে ভোট দিলেন তা আর কারুর জিজ্ঞাসার ইচ্ছে ছিল না কেননা
একমাত্র থরই এই রকম চিন্তা তখনও রেখে যাচ্ছিলেন।
জুলাই মাসের ১২ তারিখে তারা দূরে ডাঙ্গা দেখতে পেলেন। আর
তার পরে কোন রকমে গিয়ে বারবাডোসের বন্দরে রা দ্বিতীয় পৌছাল। ৩২৭০ মাইলের যাত্রা
শেষ হল। সময় লাগলো ৫৭ দিন। থর প্রমান করতে পারলেন যে মহাসাগর কোন বাধা নয়।
উত্তরমুছুনবাংলায় ভালো ভালো হাঁসির গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
বাংলায় ভূতের গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
বাংলায় প্রেমের গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন