উদ্ধার পাওয়ার পরদিনই এরিক তার সঙ্গীদের ডেকে বলে দিল যে যেহেতু তার যাত্রা
বিফল হয়েছে তাই তার সঙ্গীদের আর তার সাথে থেকে যাবার জন্য কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
কিন্তু এলেইন এবং ফ্রান্সিসের মতে এটা ঠিক কথা নয় কেননা তাদের যত্রা ছিল যে ভেলাতে
করে এত লম্বা যাত্রা সম্ভব আর সেটা তারা করেছে, কাজেই বাকী অংশটা আবার একটা ভেলা বানিয়ে শেষ করে নেওয়া
যেতে পারে।
জাহাজে ২৯ তারিখে ভালপ্যারাইসো পৌঁছানোর পরে অভিযাত্রীদের ফটোগ্রাফার আর
সাংবাদিকেরা ছেকে ধরলেও তাদের যাত্রার
সেক্রেটারী কার্লোস গার্সিয়া পালাদিওসের হস্তক্ষেপের ফলে তাদের অল্পের উপর দিয়েই
ছেড়ে দেওয়া হল। দুদিন বিশ্রাম নেবার পরে তাদের যাত্রা হল চিলির রাজধানী সান্টিয়াগোর দিকে। অবশ্যি এই যাত্রা ছিল
স্থলপথেই।
যদিও এরিকের সাথে কাগজের সম্পাদকের কথা ছিল যে যাত্রা শেষ হবার পরে তার
বিবরণ লিখে দিলে তারা ছেপে দেবে এবং তার জন্য টাকা দেবে, কিন্তু এখন আর তারা বিশেষ
উৎসাহ দেখাল না। ইতিমধ্যে এরিক নিউমোনিয়াতে ভুগে ওঠাতে সব কিছুরই দেরী হতে লাগল।
তার উপরে মাইকেল আর এরিকের মতান্তর হওয়াতে মাইকেল তার ঘরে ফিরে গেল।
জুয়ানিটো তার মার কাছে চিলির দক্ষিণতম প্রান্তের এক গ্রামে চলে গেল। আর ফ্রান্সিসের
কাছে হঠাত খবর এল যে তার স্ত্রী বিশেষ ভাবে অসুস্থ, তাই তাকেও ফেরত যেতে হল। রইল
পরে তাহিতি নুই প্রথমের পাঁচ যাত্রীর মধ্যে মাত্র দুজন।
কিন্তু এরিক তার যাত্রা শেষ করার কথা ভোলে নি। এদিকে ভেলা তৈরী করা হবে কি
দিয়ে। চিলির মতন ঠান্ডা জায়গাতে বাঁশ পাওয়া যায় না। দরকার মত বাঁশ হয় পেরু নয়তো
ইকোয়েডরের থেকে জোগাড় করে আনতে হবে। তার জন্য টাকার দরকার।
কাজেই এবার ঠিক করা হল যে বাঁশের বদলে গাছের গুঁড়ি দিয়েই ভেলা তৈরী হবে।
কিন্তু কোন গাছের ব্যবহার করা হবে। পেরুতে কনটিকির জন্য বালসা পাওয়া গেছিল, চিলিতে
পাওয়া যাবে না। অতএব রইল পড়ে হয় সাইপ্রেস নয়তো ওক গাছের গুঁড়ি, যেগুলো চিলিতে
পাওয়া যাবে। কিন্তু সাইপ্রেস সম্বন্ধে লোকেরদের মত হল ওটা দিয়ে তো কফিন বানানো হয়
কাজে তা দিয়ে নৌকো বানালে যাত্রীদের কফিনে ভরা হয়ে যাবে।
দেখা গেল যে সাইপ্রেসের তৈরী অনেক নৌকোই চিলির উপকূলের প্রত্যেক দিন যাতায়াত করছে। ইতিমধ্যে এরিক ভেলা
বানানোর সমস্ত ভার এলেইন ব্লুমের হাতে ছেড়ে দিয়ে তার স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য
পাহাড়ে চলে গেছে। তাতে লাভ হচ্ছে যে এক তো বেশ কিছটা বিশ্রাম হবে আর তার বইটার
কিছুটা অংশ লেখা হয়ে যাবে। কিন্তু ব্লুমের
কাছে ভেলার বানানোর কোন নক্সা নেই। এরিকের কথা হল যে ব্লুম প্রথম বার ভেলা বানানোর
সময় নিজে দাড়িয়ে থেকে দেখেছে, তাই তার আর নক্সার দরকার নেই।
ভেলা কোথায় তৈরী করা হবে। কনষ্টিটিউশন শহরের এক জাহাজ বানানর সংস্থা, তাদের
বিজ্ঞাপনের জন্য একটা নৌকো এঁদের বিনা পয়সাতে দিতে চেয়েছিল কিন্তু নৌকো নিয়ে তারা
যাতায়াত করবে না বলে সেটাকে নেওয়া হয় নি। কিন্তু সেই কারখানাতেই তাদের ভেলা তৈরী
কাজ করবার বন্দোবস্ত করা হল।
মজার ব্যপার হচ্ছে সেই কারখানাতে এর আগে মাত্র একবারই ভেলা তৈরী করা হয়েছিল,
আর সেটা জলে ভাসানর সাথে সাথেই নদীর জলে ডুবে গেছিল এবং এত ভারী ছিল যে সেটাকে জল
থেকে আর তোলা হয় নি। তবুও যেহেতু শহরের লোকেরা তাদের প্রীতি হিসাবে একটা ভেলা
তৈরির সমস্ত বন্দোবস্ত বিনা খরচে করে দিতে রাজী তাই ভেলা তৈরির কাজ সেখানেই দেওয়া
হল।
ডন এনরিক মুনজের সাথে শহরের কাছের জঙ্গলে গিয়ে গোটা পঞ্চাশেক গাছকে বেছে নেওয়া
হল যাতে ভেলা তৈরির কাজ শুরু করা যায়। কিন্তু প্রথমেই বাধা এল। প্রথম বার তাহিতি
নুইএর বাঁশ গুলোকে বাঁধা হয়েছিল দড়ি দিয়ে। কিন্তু সাইপ্রেস গাছের গুড়িগুলোকে বাধা
হলে ক দিনেই শক্ত কাঠের ঘষা লেগা দড়ি ছিড়ে যাবে। তাই ঠিক করা হল যে কিছু শক্ত কাঠ
দিয়ে গুড়িগুলোকে এক সাথে বিধ করে আটকে রাখা হবে। এত ঘষা খাবার সম্ভাবনা রইল না।
মাঝে মাঝে এরিক এসে তার ভেলার কাজকর্ম দেখে আবার তার বই লেখার কাজে চলে যায়।
ইতিমধ্যে এক নতুন সদস্যের আগমন হল, ফ্রান্সের নাগরিক নাম জাঁ পেলিসিয়ার। পেলিসিয়ার
সান্টিয়াগোতে সামুদ্রিক অনুসন্ধান কেন্দ্রে কাজ করে। কথায় কথায় তার এক বন্ধু , চিলির
নাগরিক, কিন্তু সাধারন চিলির লোকেদের মত নাম নয়, নাম তার ফিশার, হান্স ফিশার।
পেশায় মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু ভেলা তৈরির সময়ে এলেইনকে সাহায্য করার জন্য এঁদের
পাওয়া যাচ্ছিল না। তাদের নিজেদের কাজেই তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল। কিন্তু যখন জুয়ানিটোকে
সাথী হিসাবে পাওয়া গেল তখন এলেইনের সব চেয়ে বেশী আনন্দ হল।
ইতিমধ্যে কনষ্টিটিউশন শহরের নাগরিকদের ভেলা তৈরী দেখতে আসার ভীড় সামলানো
বেশ মুশকিল হচ্ছিল। মাঝে মাঝে এলাইনের ইচ্ছে হত যে এরিকের মত একটা বোর্ডে লেখে যে “আমরা জানি যে
আমরা পাগল, কিন্তু দয়া করে সেটাকে প্রমাণ করাতে বলবেন না”। আর এটাকে পাশে
কোথাও সাইনবোর্ড বানিয়ে টাঙ্গিয়ে রাখে।
এই ভিড়ের মধ্যেই দেখা গেল শহরের স্টেশন মাষ্টার হোরেশিও ব্ল্যাঙ্কো কে। এই
ব্ল্যাঙ্কোই কনষ্টিটিউশনের জাহাজের কারখানার উপরে চাপ দিয়েছিল যাতে ভেলাটা সেখানেই
তৈরি করার জন্য কারখানা রাজী হয়। আর ব্ল্যাঙ্কো যে কোন জিনিষের জোগাড় অল্প সময়ের মধ্যেই
করে ফেলতে পারত বলে তার উপস্থিতি খুব
কাজের হল। মালপত্রের জোগাড় এত তাড়াতাড়ি হতে লাগল যে জানুয়ারী মাসের মধ্যে প্রায় সব
জোগাড় হয়ে গেল, ইতিমধ্যে কাগজে খবর বার হল যে ফেব্রুয়ারির ১৫ই তাহিতি-নুই তার
যাত্রা শুরু করবে।
এই খবর, সংবাদদাতা কোথা থেকে পেয়েছিলেন তা জানা যায় নি, কিন্তু খবর শুনে
এরিখ বলল তাহলে তাই করা যাক। কিন্তু প্রত্যেক নৌকো, ভেলা ইত্যাদির একটা প্রাথমিক
ট্রায়াল হয়। এই ট্রায়াল করতে গিয়ে দেখা
গেল বিপদ। প্রথমত কনষ্টিটিউশনের বন্দরের মুখেই প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউ ভেঙ্গে পড়ে,
আর নদীর বালি তার মিলে একটা সমূদ্র অশান্ত চেহারা নিয়ে নেয়, তাই সেখানে ট্রায়াল
দিয়ে আবার বন্দরে ঢোকা একটা বিপদজ্জনক ব্যপার বলে ধরা হল। এরিকের সল্যুশন সাথে
সাথে পাওয়া গেল, তাহলে কনষ্টিটিউশন থেকে
কাল্লাও পর্যন্ত ১৫০০ মাইল গিয়েই প্রাথমিক ট্রায়াল দেওয়া যাক।
ফেব্রুয়ারী মাসের ১২ তারিখে ভেলাকে জলে ভাসান হল। সবাই দেখতে এসে আশ্চর্য
হল যে ভেলাটা জলে ভাসছে ডুবে যায় নি। আগেই বলেছি এর আগের যে ভেলা এই বন্দরের
কারখানাতে তৈরি হয়েছিল সেটা জলে না ভেসে সোজা জলের তলায় চলে গেছিল। কিন্তু তাহিতি
নুই জলে ভাসল, তা নয় তার ডেক কম করে জল
থেকে এক হাতের মতন উপরে রইল। শুধু তাই নয়,
মাল পত্র তোলার পরে জন পঞ্চাশেক লোকে ভেলাতে উঠে পড়ে যাত্রার আনন্দ উপভোগ করার
চেষ্টা করতে লাগল। এটা হল ভেলার আর একটা পরীক্ষা।
দেখা গেল যে এই জন পঞ্চাশেক লোকের ভারে ভেলা মাত্র ইঞ্চি দুয়েক জলে ডুবেছে।
তাহলে ভেলার জলে ডোবার আর কোন ভয় রইল না। এবার যাত্রা হবে। একটা বোট এসে ভেলাকে
টেনে নিয়ে লা পোজা নামে বন্দরে, যেটা কনষ্টিটিউশনের নদীর মোহানাতে, সেখানে পৌঁছে
দেবে।
১৫ তারিখের ভোরে সবাই লা পোজাতে পৌঁছে গেলেও ব্ল্যাঙ্কোকে দেখা গেল জলের জোগাড়ে
ব্যস্ত। কনষ্টিটিউশন শহরে জলের সাপ্লাইতে ব্যঘাত ঘটায় মাত্র ১০০ গ্যালনের মত খাবার
জল জোগাড় হয়েছে। ব্ল্যাঙ্কো বুদ্ধি দিল যে অন্তত ফায়ার ব্রিগ্রেডের কাছে জল থাকবে,
কাজেই তাদের বললে হয়। ফোন করাতে জানা গেল যে বড় কর্তা কোন বুদ্ধুদের সমূদ্র যাত্রা
দেখতে লা পোজাতে চলে গেছেন, কাজেই বিকেলের আগে কিছু করা সম্ভব নয়। কি করা যায়, যা জল আছে তাই নিয়ে যাত্রা শুরু করা হবে।
আরও আছে পরের বারে---
উত্তরমুছুনবাংলায় ভালো ভালো হাঁসির গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
বাংলায় ভূতের গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
বাংলায় প্রেমের গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন