শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৫

শিলাপ্পটিকরণ -- একটি পায়জোড়ের কাহিনী

শিলাপ্পটিকরণ
একটি পায়জোড়ের কাহিনী

(দ্বিতীয় খন্ড)

কিন্তু আর পুহারে থাকা নয়। কেননা আবার তো সব নতুন করে শুরু করতে হবে, কোভালন ঠিক করল যে এবার তাহলে পান্ডিয়ানদের রাজ্যের মাদুরাইতে যাওয়া যাক। সেখানে একটা নতুন কিছু শুরু করা যাবে। চোলা আর পান্ডিয়ান রাজ্যের মাঝে ছিল ঘন জঙ্গল আর পাহাড়। সে সব পেড়িয়ে যেতে হবে কিশোরী কান্নাগী আর তাঁর স্বামী কোভালনকে। পথে কত রকমের বিপদ আসতে পারে। কিন্তু এখানে দেখা হল তাঁদের এক মুনির সাথে, নাম তাঁর কাভুন্নী।
এই কাভুন্নী বললেন সাথে তিনি আসবেন আর রাস্তায় যদি কিছু দরকার পড়ে তবে সাহায্যও করতে পারবেন। এগোতে থাকে তারা, এবার দেখা হল এক ব্রাহ্মনের সাথে, সে পরিচয় দিল যে তাঁর নিবাস হচ্ছে কুটাকু পাহাড়ের মানকাটু গ্রামে। এখানে সে এসেছে পান্ডিয়ান রাজাদের শাস্ত্রে অধিকার দেখে। মাদুরাই যাবার রাস্তা জানতে চাইলে সে বলে তোমার সামনে তিনটা পথ আছে একেবারে শিবের ত্রিশূলের ফলার মতন। কিন্তু সব গুলোতেই আগে চলে তুমি অনেক বিপদের সামনে পড়বে। একটাতে তোমাকে কোন পরী আটকে রাখার চেষ্টা করবে, অন্যটাতে তুমি এই গরমে রোদে চলতে পারবে না রাতের অন্ধকারেই প্রকৃতি ঠান্ডা হলে যেতে পারবে। আর ঐ রাতেই এক জঙ্গল পার হয়ে তোমাকে পাহাড়ে চড়তে হবে আর তাঁর পরেই পাবে মাদুরাই নগরী। কোভালন বাঁদিকের রাস্তা ধরে আগে এগোলে দেখে এক পরী এসে তাঁকে বলছে যে মাধবী তাঁকে বলে গেছে যে সে কিন্তু এখনো কোভালনের জন্য অপেক্ষা করছে। কোভালন এখানে বসুক, মাধবী তাঁর কাছেই আসছে। কিন্তু কোভালন বোঝে যে এসব তাঁকে লক্ষভ্রষ্ঠ করানোর জন্য। সে এক মন্ত্রোচ্চারণ করতেই সেই অপরূপা সুন্দরী পরী কোথায় মিলিয়ে গেল। অবশেষে সে গিয়ে পৌছাল এক শিকারীদের দলের সামনে। তারা তখন এক মন্দিরের সামনে নেচে গেয়ে পূজো দিচ্ছে, যাতে ভাল করে শিকার পায়। কান্নাগীকে দেখে তাঁদের মনে হল যেন তাঁদের আরাধ্যা দেবী এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। এই রূপেই তো তারা তাঁদের দেবীকে পুজা করে। তারা সসম্মনে নিজেদের ঘরে কান্নাগী আর কোভালনের থাকার বন্দোবস্ত করে দিল।
সকাল হতেই কোভালনের ইচ্ছে যে মাদুরাই এর উপকন্ঠে যখন সে এসে পৌঁছে গেছে তখন শহরে গিয়ে ঐ পায়জোড়টাকে বিক্রী করে আসে। কান্নাগীর কাছ থেকে পায়জোড়ের এক পাটি নিয়ে সে চলে গেল নগরে এক স্বর্ণকারের কাছে।
এই সেই স্বর্ণকার যে আগে কোন সময়ে ভাঞ্জি নগরে এক শ্রেষ্ঠ স্বর্ণকারের অধীনে কাজ শিখত। সেই সময়ে তাঁর মনে আছে যে তাঁর গুরু এক অপূর্ব পায়জোড় বানিয়েছিলেন। সেটা ছিল মণিমুক্তো বসান, আর তাঁর ভেতরে ছিল চুনী পাথর ভরা। চলতে গেলেই পাথরে ঠোকা লেগে এক মধুর আওয়াজ করত। জিনিষটা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল এতই, যে শেষ পর্যন্ত গুরুদেব তাঁকে বলেছিলেন যে তোমার নিজেকে বশ রাখার ব্যপার শিখতে হবে। হায়, সেই পায়জোড় কোন এক মহিলা এসে কিনে নিয়ে গেছিল।

পান্ডিয়ান রাজা নেদুঞ্চেরিয়ান গানবাজনার প্রতি বেশ আকৃষ্ট ছিলেন। প্রায়ই তাঁর সভাতে নৃত্যগীতের আসর বসত। আর নর্তকীরা ভাল ভাল উপহার পেয়ে সম্রাটের জয়গান করতে করতে চলে যেত। কিন্তু নেদুঞ্চেরিয়ান আসলে ঐ নর্তকীদের থেকে কাউকে খুঁজতেন। আর হল তাই, তিনি তাঁর স্ত্রী মহারানী কোপারুনদেবীর জায়গাতে একনর্তকীকে ভালো বাসতে শুরু করে দিলেন। মহারানী এই কথা জানার পরে, তাঁদের দুজনের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্কটা একটু খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।। সম্রাট নেদুঞ্চেরিয়ান  এক স্বর্ণকারকে ডেকে একজোড়া পায়জোড় বানিয়ে দেবার আদেশ দিলেন। এই সেই স্বর্ণকার যে আগে ভাঞ্জিতে কাজ শিখেছিল আর এখন এসে মাদুরাইতে রাণী কোপারুনদেবীর গয়ণা বানানোর কাজ করতেন।

এখন যে সময় সম্রাট তাঁর রাণীকে ঘুষ হিসাবে ঠিক করে নিয়েছিলেন যে একজোড়া ভাল দেখে পায়জোড় উপহার দিয়ে মানভঞ্জন করাবেন, ঠিক সেই সময়ে ঐ স্বর্ণকারের মাথায় সেই আগের দেখা পায়জোড়ের কারুকার্যের চেহারাটা ঘুরছিল, তাই সে ঠিকই করে নিল (নিজের অজান্তে) যে এখন যে পায়জোড়টা তৈরী করা হবে সেটাও সেই আগের দিনের পায়জোড়ের হবহু নকল হবে। আর তাতে সে বসাবে মুক্তোর দানা। বানিয়ে ফেলা হল, আর রাজা মশাইয়ের কাছে সেটাকে নিয়ে গিয়ে দেখান হল। রাজামশাই খুসী। বললেন রাণীমার পায়ে ঠিক মত হচ্ছে কিনা দেখে নেওয়া হোক। তাই হল অপূর্ব দেখতে লাগল। আর স্বর্ণকারের মাথায় আবার সেই পুরনো ভূতটা চেপে গেল। এত সুন্দর জিনিষ সে বানাচ্ছে কিন্তু সেটা তাঁর নিজের জন্য নয়। তাহলে এইটাকে স্বর্ণকারকে চুরি করতেই হবে। সুযোগ পেতেও অসুবিধা ছিল না, কেননা রাণী কোপারুনদেবীর গয়নার সমস্ত কাজ সেই করত। কাজেই কোন এক সময়ে সেটা চুরী করেও নিতে পারল।
রাজপ্রাসাদে হুলস্থুল কান্ড। রাণীমার গয়ণা চুরি। রাজা মশাই তো খুব রাগ করলেন। আর রাণীমা তো রাজাকে গালি দিতে লাগলেন কেননা তাঁর ধারণা ছিল ঐ স্বর্ণকারই চুরি করেছে, কিন্তু রাজামশাই সেটা মানতে চাইছিলেন না। শেষে সব লোকজনদের লাগিয়ে দেওয়া হল যে যদি কেউ চোরের খবর দিতে পারে তবে তাঁকে পুরস্কার দেওয়া হবে।

এদিকে কোভালন যখন তাঁর পায়জোড়টাকে নিয়ে স্বর্ণকারের কাছে গেছে, তখন সে গয়ণাটাকে দেখে অবাক। এই সুযোগ। এটা দেখে সহজে কেউ বুঝবেই না যে এটা রাণীর পায়জোড় নয়। এটা সেই তাঁর গুরুর বানানো পায়জোড়ের একটা পাটী।

কথায় কথায় কোভালনকে সে অপেক্ষা করতে বলে সোজা চলে গেল রাজা মশাইয়ের কাছে।
ক্রমশঃ

বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৫

শিলাপ্পটিকরণ --একটি পায়জোড়ের কাহিনী

একটি পায়জোড়ের কাহিনী

(তামিল মহাকাব্য থেকে)
আমার এই কাহিনী সময়কাল তখন, যখন দক্ষিণ ভারত তিন বিরাট সাম্রাজ্যের অধিকারে ছিল। আর সে তিনটি রাজ্য ছিল চোলা, পান্ডিয়ান আর চেরা সাম্রাজ্য। চোলা ছিল দক্ষিণ ভারতের পূর্ব উপকূলে, যে জায়গাটা আমরা আজ তামিলনাডু বলে জানি আর চেরা ছিল পশ্চিম উপকূলে, যে জায়গাটা আজ কেরল নামে জানা যায়। পান্ডিয়ান ছিল এই দুই সাম্রাজ্যের মাঝে, এখনকার তামিলনাডুর পশ্চিম ভাগটা।
পুম্পুহার বা ছোট করে বললে পুহার ছিল এই চোলা সাম্রাজ্যের বন্দর নগরী আর রাজধানীও। নানা দেশ বিদেশ থেকে বণিকেরা তাঁদের জাহাজ নিয়ে আসতো বাণিজ্যের জন্য। মণি মুক্তা, বিশেষ করে মুক্তার কারবারে পুহার ছিল বিশেষ খ্যাত। আর এই পুহারে তখন রাজত্ব করতেন সম্রাট কারিক্কল। দেশ তাঁর ছিল শান্তিপুর্ণ। কারুর কোন অপরাধ করার সাহস হত না। কারণ পুহারে এক দৈত্য ছিল যার লাজ ছিল কেউ অপরাধ করলে তাঁর শাস্তি দেওয়া। আর রাজা, তারও নিস্কৃতি ছিল না। শহরে এক দেবী মূর্তি ছিল বলা হত কাঁদুনে দেবী। কেউ কোনদিন তাঁকে কাঁদতে দেখেনি কিন্তু বলা হত যদি রাজা কোন অন্যায় করেন তবে এই দেবীর চোখে জল দেখা যায়।
এই পুম্পুহার নগরটাকে অবশ্যি কাবেরীপুম্পট্টিনাম নামেও জানা যেত কেননা নগরটা ছিল কাবেরী নদীর মোহানাতে। নগরের দুটো ভাগ। একটা বন্দর নগরী যেখানে বড় বড় গুদামঘর, জাহাজ নৌকার বাঁধার জেটি আর বিদেশি বণিকদের থাকার জন্য বড় বড় প্রাসাদ। আর অন্য ভাগে ছিল রাজার প্রাসাদ, আর সাথে স্থানীয় নাগরিকদের থাকবার জন্য ঘরবাড়ি। এই ভাগটার নাম ছিল পাট্টিনাপাক্কম।
এখানে থাকতেন এক ধণী বণিক বলা যায় বিরাট ধণী, মুক্তার ব্যবসায়ি নাম ছিল তাঁর মাসাত্থুভন। মুক্তার ব্যবসায়ে তাঁর ছিল বিরাট দখল আর জ্ঞান। ছেলে তাঁর একটি মাত্র নাম তার কোভালন। বয়স হবে প্রায় ষোল। বাবার কাছে থেকে মুক্তার কি ভাবে গুণ বিচার করে তাঁকে আলাদা আলাদা শ্রেণীতে ভাগ করতে হয় তাই নিয়ে কাজ শিখছিলেন। সে শিক্ষা এখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
আর তাঁর বাবা চাইছেন এবার সে কি ভাবে দরদাম করে ব্যবসা করত হয় তাই শিখুক। কোভালনের তাতে বেশ রুচিও এসে গেছিল, তবে তাঁর আরও ভাল লাগত যখন যবন বনিকদের জাহাজ কিছু বিশেষ ধরনের কারুকার্য করা জিনিষ নিয়ে আসত, তার দরদাম করে কিনতে। কিন্তু কিনত কেন? করে তো ব্যবসা মুক্তার।
ঐ নগরেই আর একজন নামী ব্যবসায়ি থাকতেন, নাম ছিল তাঁর মানিক্কম। আর মানিক্কমের ছিল একটি সুন্দরী কন্যা নাম ছিল তাঁর কান্নাগী। বয়স হবে এই বারোর মতন। এই কান্নাগী আর কোভালনের মধ্যে ছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। আর কোভালন যে এই সব জিনিষ কিনত, সেগুলো কিন্ত কান্নাগীকে দেবে বলেই কেনা হত।
দুজনের বাবা মা মনে মনে ভাবছিলেন যে যখন এঁদের মধ্যে এতই মিল, তখন আর তাঁদের আলাদা থাকার কি দরকার। একটা বিয়ে লাগিয়ে দিলেই হয়। চলে গেলেন তারা জ্যোতিষীর কাছে । দিনক্ষণ শুভ মূহুর্ত বিচার করে তারিখ ঠিক করতে, আর সেটা ঠিক হল আগামী রোহিনী নক্ষত্রে যখন চব্দ্র আসবে তখন। এমন কিছু আর বেশি দেরী নয়।
ওদিকে কান্নাগীর মা কিন্তু বেশ সঞ্চয়ী বলতে হবে কেননা, সেই কবে থেকে তিনি কান্নাগীর বিয়ের জন্য গয়ণার জোগাড় করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। আর এই সব গয়ণার মধ্যে ছিল এক জোড়া পায়জোড়। চেরা রাজ্যের রাজধানী ভাঞ্জী থেকে কেনা। দুবলা পাতলা কান্নাগীর জন্য পায়জোড় জোড়ার ওজন বেশিই হবে কেননা সেটাতে চূনী পাথর বসান ছিল আর ভেতরেও চুণী পাথর রাখা ছিল যাতে চললে পড়ে সেই পাথরগুলো একে অপরের সাথে ঠোকা লেগে একটা সুন্দর আওয়াজ করে।
বিয়েটা তাঁদের হয়েই গেল। বয়স মনে হচ্ছে অল্প ছিল কিন্তু তখনকার দিনে এই বয়সেই তো বিয়ে হয়ে যেত। এখন সংসার শুরু করার আগে দুই কিশোর কিশোরী নিজেদের মধ্যে খেলা করেই বেড়াত। কিন্তু কোভালন তাঁর বউ কান্নাগিকে এত পছন্দ করত যে তাঁর ব্যবসা করার জন্য বাইরে যাবার দরকার পরে সেটা প্রায়ই ভুলেই যেত। কিন্তু যেদিন সে বাইরে নিজের কাজে যেত, মানে সেই জাহাজগুলোর বণিকদের সাথে দরদাম করতে যেত, সেদিন কান্নাগীর জন্য কিছু না কিছু কিনে আনত। একটা কথা কোভালন প্রায়ই বলত যে কান্নাগির তো আর কোন কাজ নেই, সারা কাজ দাসীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে আর ওদিকে কোভালনকে রোদে পুড়ে কাজ করে যেতে হয়। আসলে এ সব ঠাট্টা ইয়ার্কী হিসাবেই দুজনের মধ্যে হত। ইতিমধ্যে মাসাত্থুভন কোভালন আর কান্নাগীর জন্য একটা আলাদা বাড়ি বানিয়েও দিল যাতে তারা আলাদা করে সংসার চালু করতে পারে। তখন কোভালনের বয়স হবে এই উনিশের মতন।
এর বেশ কিছুদিন বাদে নগরে এক নর্তকীর আগমন হল। নাম তাঁর মাধভী। বিখ্যাত নর্তকী চিত্রপথীর মেয়ে। পাঁচ বছর বয়স থেকে নাঁচ আর গানের শিক্ষা নিচ্ছিল। এখন তাঁর সময় হয়েছে নৃত্যকলা সবার সামনে দেখানোর। কিন্তু প্রথন অনুষ্ঠান তো রাজামশাইয়ের সামনেই করতে হবে। নগরে সাজ সাজ রব, অনুষ্ঠানের জন্য আলো, পর্দা, বসবার জায়গা সব কিছু বাস্তুশাস্ত্র মেনে তৈরী করা হল। চিত্রপথীরও  পরীক্ষা কেননা, সে কিরকম শেখাতে পেরেছে সেটাও সবাই জানবে। কথায় আছে তারা হল ঊর্বশীর বংশধর। মাধবীর অবশ্যি তাঁর নিজের নাঁচ আর গান কি ভাবে কি করবে তাঁর চিন্তাতেই ব্যস্ত।
কোভালনের আর একটা গুন ছিল। ব্যবসার সাথে সাথে সে গান বাজনার চর্চাও করত আর নাচের জন্য তালবাদ্যের খুব বড় বাজিয়েও ছিল। ঠিক হল এই মাধবীর অনুষ্টানে কোভালন বাজাবে। যথানিয়মে ঠিক দিনে অনুষ্ঠান শুরু হল, আর সবার কাছ থেকে প্রশংসা পেয়ে নাচ আর গান শেষ হল। সম্রাট কারিক্কল মাধবীকে এক হাজার আট স্বর্ণমূদ্রা দিয়ে সম্মান জানালেন।
কিন্তু কোভালনের মনে মাধবী যে আলোড়ন তুলেছিল তাঁর ফল কিন্তু কান্নাগীর জীবনে সুখের হল না। সঙ্গত করার নামে কোভালন প্রায় সারাটা সময় মাধবীর সাথেই কাটাতে শুরু করে দিয়েছিল। এমন কি তাদের দুজনের একটা মেয়ে হয়েছিল যার নাম দেওয়া হল মণিমেখলাই বা সমূদ্রের দেবী।
দিন যায় কোভালন আর মাধবী একসাথেই থাকে আজকাল, কান্নাগী একা একা ঘরে বসে ভাবে কবে কোভালন তাঁর ঘরে ফিরে আসবে। কোভালনের মা বাবাও আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল কোভালনকে ফেরানর জন্য কিন্তু সব কিছু চেষ্টা করেও কোভালনকে তাঁর নিজের ঘরে কান্নাগীর কাছে ফেরান গেল না।
ইতিমধ্যে কোভালনএর মতিভ্রম হতে লাগল। নিজেকে এক বিরাট ধণী ব্যবসায়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন সে শুরু করে দিল বেহিসাবী খরচ করতে। কেউ এসে তাঁর কাছে অর্থ সাহায্য চাইলে খালি হাতে ফিরে যেত না।
পুহার নগরে একটা উতসব হত ইন্দ্র উতসব। এই দিনে সবাই তাঁদের সাধ্যমত অন্যকে দান করত। কোভালন এই উতসব উপলক্ষে প্রায় দাতাকর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু তাঁর পুঁজিও শেষ হয়ে আসতে লাগল। নিজের যা কিছু সঞ্চয় ছিল সব একে একে বিক্রী করে দেবার পরে হাত পড়ল কান্নাগীর গয়নাতে। সেগুলোও বিক্রী করতে শুরু করে দিল। আসে কান্নাগির থেকে গয়ণা নেয়, বিক্রী করতে চলে যায়, আর তাঁর পরে গিয়ে থাকে সেই মাধবী আর মনীমেখলাইয়ের সাথে। শেষকালে এক ইন্দ্র উতসবের সময় দেখা গেল কোভালনের কাছে আর খরচ করে নাম কামানোর মত কিছুই অবশিষ্ট নেই। আর তাই নিয়ে মাধবীর সাথে হল মতের অমিল।
এ ছাড়াও ইন্দ্র উতসবের সময় মাধবীর একটা গান শুনে কোভালনের মনে হল যে মাধবী তাঁর অসাক্ষাতে অন্য কাউকে ভালবাসছে। তাঁর প্রতি মাধবীর আর ভালবাসা নেই। মাধবীকে কোভালন সোজা আক্রমণ করলে মাধবী বলে যে সে এখনও কোভালনকেই ভালবাসে। কিন্তু কোভালনের সেটা বিশ্বাস হয় না। কোভালন মাধবীকে ছেড়ে কান্নাগীর কাছে ফিরে আসে। কান্নাগীও তাঁকে আগের সব ঘটনা ভুলে আপন করে নেয়।

ওদিকে মাধবী যখন দেখে যে কোভালন তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে সে কোভালনকে লিখে জানায় যে কোভালন ভুল করছে, কিন্তু তাতে কোন লাভ না হওয়াতে মাধবী ঘর ছেড়ে নিরুদ্দেশে চলে যায়। 
চলবে-=-=

সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৫

তিনটি চতুর্দশপদী

(1)
আজকে সকালে বিজলীওয়ালী বাই
এসে বললেন মুখটা করে গোমরা
রোববার তো সব্বার ছুটি চাই
বাকী কেন থাকি আমরা।

কি বিপদ যদি নেয় ছুটী
কত কাজ রয় যে থাকে পড়ে
করবে কি আজ রবিবারী আড্ডাটা মাটী
নেটের তো নাগালই নাই ঘরে।

এদিকে নোটিশ দিয়ে বাই পগার পার
ছন্দ মিল করছে মাথায় ভন ভন
লিখে পোষ্টালে লাইক পাব এন্তার
ভেবে না পাই হবে কি উপায় এখন।

মনে হচ্ছে হল দয়া তেনার

এসেছেন ঘরে সেবা দিতে আবার।।

(2)

আজ কেন মনে হচ্ছে আমার লিখতেই হবে সনেট
হয়নি লেখা কিছুই গত বেশ কিছুদিন ধরে
এবার না লিখলে ফেবুর বাজারে আমার কমে যাবে যে রেট
আদা জল খেয়ে লেগেছি লিখতে মনেতে জোর করে।

লিখেছিলাম দু একটা লিমেরিক আর অ্যাক্রস্টিক
কাল ঘাম ছুটে গেছিল সেটুকু লিখতে
তবুও শুনলাম সেগুলো হয়নিকো ঠিক
ঘুঁটের মেডেলও কেউ দেবে নাকো তাতে।

ছড়া লেখা কিন্তু খুব সোজা, অন্তমিলের বাড়াবাড়ি
রামের সাথে বাম, যদুর সাথে দুধু
তাই ছড়ারই দেখবে বাজারে ছড়াছড়ি
অন্য কিছুর নামে ঢুঢু।।

এবার আমি যখন লিখছি চতুর্দশী কাব্যি
প্লীজ গোল কোরোনা, দিচ্ছি মাথার দিব্যি।।

(3)
দেখতে দেখতে কেটে গেল আশিটা বছর
পিছু ফিরে  দেখি আর মনে লাগে ভয়
পেরিয়ে এলাম কি এতটা লম্বা সফর
যদিও সাথে তাঁর চলে গেল অমূল্য সময়।

বন্ধুদের সাথে যৌবনের পিচ্ছিল পথে
কিভাবে যে কেটেছিল দিনগুলি
প্রেম ভালবাসা, অনুরাগ অভিমান সাথে
না চেয়েও পেয়েছিনু ভরিয়া অঞ্জলি
লেখাপড়া খেলাধুলা হাসিখুসী সেই সব দিন
কিছু তাঁর আবছা স্মৃতির পটে হয়ে গেছে ম্লান
কিছু কিছু মনে হয় এইতো সেদিন
নতুন জামাজুতোর পাই যে আঘ্রাণ

কিন্তু সময় এসেছে কাছে, এবার নিতে হবে বিদায়
বন্ধু আমার হাঁসো প্রাণ ভরে, কোরো নাকো হায় হায়।। 

বৃহস্পতিবার, ৯ জুলাই, ২০১৫

পাঁচফুল রাণী (তৃতীয় খন্ড)

পরের দিন সকালে রাজকুমার দরজা খুলে দেখতে গেছেন যে আগের দিন যে পাখীগুলোকে রঙ করেছিলেন সেগুলো শুখিয়েছে কিনা। আর দরজা খোলার সাথে সাথে ঐ হাজারটা টিয়া পাখী ক্যাঁচর ম্যাঁচর করতে করতে ঘরের ভেতরে ঢুকে এল। সে এক ভীষন হৈ হট্টগোলের ব্যপার,আর চেঁচামেচী শুনে রাজকুমারের বউ,শ্বশুর মশাই আর শ্বাশুড়ী ঠাকরুন জেগে উঠে কান্ড দেখে হতভম্ব।

শ্বাশুড়ী ঠাকরুন বলেন, দেখ বাবা, তোমার ঐ হাজার টিয়াকে খেতে দেবার মত সামর্থ, আমার বা তোমার শ্বশুর মশাইয়ের কাছে নেই। ওরা তো রাক্ষসের মত খায়। তা তুমি যদি ওদের রাখতে চাও তাহলে তোমাকে কিন্তু আলাদা কোথাও থাকতে হবে যে

রাজকুমার বলেন, ঠিক আছে তাই হবেএই বলে রাজকুমার আর তার বৌ, মানে সেই মিস্ত্রীর মেয়ে, গিয়ে উঠলেন এক নতুন ঠিকানায়। আর সাথে রইল সেই হাজার টিয়া। অবশ্যই শ্বাশুড়ী ঠাকরুন তাদের প্রথম কদিন চালানর জন্য কিছু না কিছু আনাজপত্র সাথে দিয়ে দিয়েছিলেন।

এদিকে রাজকুমার কয়েকদিনের মধ্যে বুঝতে পারল যে ঐ টিয়াপাখীর দল তো তার খাবারে ভাগ বসাচ্ছে না। তারা সকাল বেলায় উড়ে চলে যায় নিজেদের খাবারের জোগাড় করতে, আর সন্ধ্যে বেলায় ফেরার সময় ঠোঁটে করে একটা ধানের শিষ বা গমের গুচ্ছ, কি অন্য কিছু ফল বা আনাজ নিয়ে আসে রাজকুমারের জন্য।

অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রাজকুমারের অনেক পয়সা হয়ে গেল আর সে হয়ে গেল শহরের এক বিরাট ধনী কাঠের মিস্ত্রী। আর এভাবে কিছু দিন চলার পরে এক রাত্রে রাজকুমার এক স্বপ্ন দেখল। কি সেই স্বপ্ন।

রাজকুমার দেখে, অনেক অনেক দূরে লোহিত সাগর পার হবার পরেও আরও সাতটা সমুদ্রের ওপারে এক রাজ্য আছে। আর সেখানকার রাজার যে মেয়ে, তাঁকে সবাই পাঁচফুল রাণি বলে ডাকে। আর সেই কারণেই তাঁদের রাজ্যের নামও হয়ে গেছে পাঁচফুল রাণীর দেশ।

ঐ যে পাঁচফুল রাণী, সে থাকে রাজ্যের একদম মধ্যিখানে এক প্রাসাদে, যেখানে যেতে গেলে সাতটা চওড়া খাল পার হয়ে তার পরে সাতটা উঁচু উচু বেড়াও পার হতে হবে। পাঁচফুল রাণীকে যদি কেউ দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে, তবে তার ওজন পাঁচটা পদ্মফুলের চেয়ে বেশি হবে না। আর সেই পাঁচফুল রাণী প্রতিজ্ঞা করেছে যে, তাঁকে বিয়ে করার জন্য সেই যোগ্য পাত্র হবে, যে লাফ দিয়ে ঐ সাত সমূদ্র পার হয়ে সাত খাল আর সাত বেড়া পার হয়ে তার কাছে আসতে পারবে।

রাজকুমারের ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে চিন্তা করতে শুরু করে দিল, যে সে যা দেখেছে তা সত্যি কিনা। কেননা এই রকম রাজ্যের নাম তো কেউই শোনে নি। এর মধ্যে তার বৌ উঠে দেখে, রাজকুমার বসে বসে কি সব ভাবছে। জিজ্ঞেস করাতে রাজকুমার তাঁকে সব কথা বললে। আরও বললে যে, এই রকম রাজ্য যে কোথায়, সেটা কিন্তু কেউ জানে বলে মনে হয় নাবৌ বলে, আমি হলে এই টিয়াদের জিজ্ঞেস করতাম, যে তারা এই সম্বন্ধে কিছু জানে কিনা

রাজকুমার ভাবে কথাটা সত্যি বলেছে তার বউ। আর তাই সে ঠিক করল, হাজার টিয়ার মধ্যে যে সব চেয়ে বুড়ো তাঁকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে। সন্ধ্যে বেলায় টিয়ারা যখন ঘরে ফিরল, তখন রাজকুমারের জিজ্ঞাসা করলে, বুড়ো টিয়ে বলে হ্যাঁ, তুমি যা দেখেছ তা সত্যি। লোহিত সাগর পেরিয়ে আরও সাতটা সমুদ্র পার হবার পরে সাতটা খাল আর সাতটা বেড়া পার হয়ে তবে তাঁকে পাওয়া যাবে, কিন্তু অনেক বড় বড় লোকেরা চেষ্টা করেও পারেনি, তাই ঐ পাঁচফুল রাণীর এখনও বিয়ে হয়নি।

টিয়া আরও বলে, মেয়েটা তার বাপ মার খুব প্রিয় বলে, তারা রোজ গিয়ে তার ওজন দেখে আর রোজই পায়, যে পাল্লার একদিকে পাঁচটা পদ্মফুল আর অন্য দিকে পাঁচফুল রাণীকে বসালে তাদের সমানই পাওয়া যাবে। রাজকুমার বলে, তাতে কি হয়েছে, আমিও একবার যাব। কিন্তু কি ভাবে ঐ সাতটা সাগর পার হওয়া যাবে?

টিয়া বলে, তার জন্য চিন্তা নেই। আমরা দুজনে পাশাপাশি একসাথে ডানা নেড়ে উড়ে গেলে, তুমি আমাদের ডানার উপরে বসে থাকতে পারবে। আমরা তো খালি বাইরের দিকের ডানা দুটোই নেড়ে যেতে পারব। খালি রোজ সন্ধ্যে বেলায় আমাদের কোন গাছের মাথায় বসতে হবে।, তা তুমি রাতের বেলায় গাছে থেকে যেতে পারবে তো?

রাজকুমার তার বউকে যখন বললে যে সে টিয়ার কাছ থেকে রাস্তা জেনে নিয়েছে আর ঐ পাঁচফুল রাণির দেশে যাবে, তখন তার বউ বলে, যাবে তো যাও, আর গিয়ে ঐ পাঁচফুল রাণিকে বিয়ে করে নিয়ে আসতেও পার। কিন্তু রাস্তাঘাটে মারা পড়ো না। আর বেশি দেরী করবে নাএই সব বলে বউ তাঁর হাতের সোনা রূপোর চুড়িগুলো খুলে একটা গরম কাপড়ের পোঁটলার সাথে বেঁধে দিল। ভাবল এগুলো রাস্তায় যদি কোন টাকা পয়সার দরকার পরে তবে রাজকুমারের কাজে আসবে।

 চলবে--

মঙ্গলবার, ৭ জুলাই, ২০১৫

পাচফুল রাণী (দ্বিতীয় খন্ড)


লোকটা চলে যাবার পরে মিস্ত্রী ভাবতে বসল, কি করে একজোড়া খড়মের জন্য সে দশটা সোনার মোহর পেতে পারে। এমনিতে তো সে এক এক জোড়া খড়মের জন্য দু তিন টাকার বেশি দাম কোনোদিন পায়না। অন্য খড়মগুলো দেখে আর ভাবে ওটা এত সুন্দর হল কি করে। ভাবতে ভাবতে মেয়েকেও জিজ্ঞেস করলে, মেয়ে বলে, “তবে ঐ খড়মজোড়া নিশ্চয়ই রাজকুমারের বানানো। এই বলে সে তার বাবাকে রাতে খাবার তৈরী করার সময়ে খড়ম জ্বালিয়ে রান্না করার কথা বললে।

মিস্ত্রী মনে মনে ভাবে যে এই রাজকুমার তো তাহলে খুব কাজের লোক। একে অন্য কোথাও কেন যেতে দিই। এই বলে সে রাজকুমারকে বলে, “তুমি কি আমার মেয়েকে বিয়ে করবে”? রাজকুমার ভাবে মিস্ত্রীর মেয়ে তো দেখতে খুব সুন্দরী আর ভাল করে রান্নাবান্নাও জানে। তাই সে আর আপত্তি করল না। বলে দিল, হ্যাঁ করব। যথা নিয়মে বিয়ে হয়েও গেল।

রাজকুমার তো গিয়ে আশ্রয়য় নিল এক খেলনা বানানোর মিস্ত্রীর ঘরে। আর সেখানে একজোড়া খড়ম বানাওয়ে দিল যেটা অনেক চামে রাজার জন্য কিনে নিয়ে গেল। মিস্ত্রী তাঁকে তাঁর সহকারী হিসাবে ঘরে থাকতে দিল।
এদিকে রাজকুমার রোজই কিছু খড়ম বানায় বাজারে বিক্রী করা জন্য। সেগুলো বানাতে তার অল্পই সময় লাগে। আর তার পরে বসে বসে খেলনাপাতি তৈরী করে। কি খেলনা, না টিয়া পাখী বানায়। তার দুটো ডানা, দুটো পা, দুটো চোখ, ধারাল ঠোঁট, ঠিক যেন আসল টিয়া। তার পরে সেগুলোকে রঙ করে বাইরে রোদে শুখোনর জন্য রেখে দিত। একবার রাজকুমার তার তৈরী ঐ পাখিগুলো দিনের শেষেও সুখোয়নি বলে রাতেও বাইরে রেখে দিয়েছিল।
সেই রাতে মহাদেব আর পার্বতী বেড়িয়েছেন, সারা পৃথিবীর কোথায় কি হচ্ছে তাই দেখবার জন্যে। আর ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌছেছেন সেই শহরে, যেখানে আমাদের রাজকুমার আর তার মিস্ত্রী শ্বশুরমশাই থাকেন। মহাদেব আর পার্বতী দেখলেন বাইরে অনেক কাঠের তৈরী টিয়াপাখী পড়ে আছে। সবগুলো একেবারে যেন জীবন্ত পাখী, কিন্তু তাঁদের প্রান নেই, তারা কাঠের তৈরী।

পার্বতী মহাদেবকে বললেন, “দেখ কি মজা হবে যদি ঐ সব পাখীগুলোকে প্রাণ দিয়ে দেওয়া যায়। কাঠের পাখী হাওয়ায় উড়ে বেড়াবে। মহাদেব বললেন, “ভাল মোটেই হয় না, কেননা সেটা যে সাধারণত হয় না। কিন্তু সত্যিই কি তুমি কাঠের টিয়াতে প্রান দেওয়া পছন্দ করবে। পার্বতী বললেন, “ আমি তো স্রেফ মজা দেখার জন্য বলছিলাম। মহাদেব বললেন, “তথাস্তু”, আর তার পরে ওখানে যে হাজারের মত কাঠের টিয়া ছিল, তাঁদের সবগুলোকে প্রাণ দিয়ে দিলেন। আর তার পরে উড়ে চলে গেলেন অন্য কোথাও।

চলবে--

সোমবার, ১ জুন, ২০১৫

পাঁচফুল রাণী

পাঁচফুল রাণী
(ভারবর্ষের রূপকথা)

এক রাজ্যে রাজার দুটো বৌ ছিল। কিন্তু রাজা মশাই তার ছোট বউকে বেশী ভালবাসতেন। বড় রাণীর একটা ছেলে ছিল। কিন্তু সে ছোট বউয়ের ছেলে নয় বলে রাজামশাই তাকেও মোটেই ভালবাসতেন না। মনের দুঃখে একদিন সেই ছেলে তার মাকে বলে, দেখ মা, আমাকে তো বাবা মোটেই ভালবাসেন না। তাহলে আমি নাহয় অন্য কোন রাজ্যে গিয়ে আমার ভাগ্যে কি আছে তাই দেখে নি

বড়রাণী তখন রাজামশাইকে জিজ্ঞেস করে, ছেলেটা বিদেশে তার ভাগ্য পরীক্ষা করতে যাবে, তোমার মত আছে তোরাজামশাই বলেন, আমার তো কোন আপত্তি নেই, কিন্তু ঐ ছেলে যে রকম অকাজের তাতে ও যে কোথাও গিয়ে কিছু করতে পারবে তা আমার মনে হয় না। আর আমি কিন্তু ওকে নষ্ট করার জন্য একটাও পয়সা দিতে পারব না
বড় রাণী ছেলেকে ডেকে বলে, তোমার বাবা মত দিয়েছেন। কাজেই এবার তুমি তোমার জামাকাপড় গুছিয়ে নিতে পার।  আমি তোমার জন্য খাবার করে দিচ্ছিএই বলে রাণি তার জন্য কিছু রুটী বানিয়ে দিলেন। আর প্রত্যেকটা রুটীর মধ্যে একটা করে সোনার মোহর রেখে দিলেন, যাতে রুটীটা ভাঙ্গলেই সে মোহরটা বেড়িয়ে আসে। ছেলে সব কিছু নিয়ে তার যাত্রা শুরু করে দিল।

চলতে চলতে সে তার বাবার রাজ্য পার হয়ে গিয়ে পৌছাল অন্য এক রাজার রাজ্যে। এখন সে হচ্ছে রাজার ছেলে, তাই নিয়ম অনুযায়ী যে দেশে যাবে সেই দেশের রাজাকে বলা উচিত যে অন্য এক রাজার ছেলে হিসাবে সে এসেছে। কিন্তু সেটা না করে, রাজকুমার গিয়ে হাজির হল রাস্তার ধারেই এক ঘরে। ঘরটা ছিল এক কাঠের মিস্ত্রীর, আর সেখানে ঢুকে সে রাতটা থাকার জন্য আশ্রয় চাইল।

মিস্ত্রী ব্যাস্ত ছিল তার কাজে। তাও সে বলে উঠল, হ্যাঁ বেটা, তুমি যদি আমাকে সাহায্য করতে চাও তবে এখানে থাকতে পার। আর যদি তোমার খাবারের দরকার থাকে, তবে ঘরে আমার স্ত্রী আর মেয়ে আছেতাদের কাছে তুমি চাইলে তারা তোমাকে খাবার বানিয়ে দেবে। রাজকুমার ঘরে ঢুকে ঐ মিস্ত্রির মেয়েকে বলে, আমি অনেকটা পথ চলে এসেছি, তাই খুব ক্লান্ত। তুমি আমার জন্য কিছু খাবার রান্না করে দাওনা, আমি তার জন্য তোমাকে পয়সা দেব

মেয়ে বলে, আমি তো রান্না করে দিতে পারি কিন্তু ঘরে যে একটুকুও কাঠ নেই, আর জঙ্গলও খুব দূরে। এই রাতের বেলায় আমি কি জ্বেলে রান্না চড়াব। রাজকুমার বলে, আমি বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। এই বলে মিস্ত্রী যে সমস্ত কাঠের খড়ম বানিয়েছিল তার থেকে এক জোড়া নিয়ে, তাই দিয়ে আগুন জ্বেলে দিল। আর মেয়ে তার রান্না শেষ করে রাজকুমারকে খেতেও দিল।

পরেরদিন সক্কাল বেলায় রাজকুমার উঠে আগে জঙ্গলে গিয়ে কাঠ কেটে নিয়ে এল। আর তার পরে সুন্দর দেখে এক জোড়া খড়ম বানিয়ে অন্য খড়মের সাথে রেখে দিল। মিস্ত্রী ঘুম থেকে ওঠার আগেই এই সব কাজ শেষ। কিছুক্ষন বাদে রাজামশাইয়ের কাছ থেকে এক জন লোক এল একজোড়া খড়ম কিনতে।


সব খড়ম দেখে লোকটা রাজকুমার যে নতুন খড়মজোড়া বানিয়েছিল, সেটাই পছন্দ করল। লোকটা বলে, আমি এই সুন্দর খড়মের জোড়াটাই রাজামশাইয়ের জন্য পছন্দ করলাম। মিস্ত্রী ভাই, তোমার অন্য খড়মের জোড়াগুলো সব সময় যদি এত সুন্দর হত? এই বলে দশটা সোনার মোহর দিয়ে সেই খড়মজোড়া কিনে নিয়ে চলে গেল।

চলবে--

শুক্রবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৫

বাঘ, শেয়াল আর পণ্ডিত


(ভারতবর্ষের উপকথা)

কোন এক সময়ে একটা বাঘ খাঁচায় ধরা পড়েছিল। খুব লাফালাফি করেও সে কিন্তু তার ঐ খাঁচা থেকে বার হতে পারছিল না। রাগ হচ্ছিল তার খুব, কিন্তু তা দিয়ে তো আর খাঁচা থেকে বার হওয়া যায় না। কি করে ভাবছে। এমন সময় দেখে এক পণ্ডিত মশাই ওদিক দিয়ে আসছেন।

বাঘ একটা পেন্নাম ঠুকে বলে, এই যে পণ্ডিত মশাই, এদিকে একবার এসে আমাকে খাঁচার বাইরে বার করে দিন না। আমি আটকা পড়ে গেছি। পণ্ডিত মশাই বলেন, না রে ভায়া, আমি যদি খাঁচা খুলে তোমাকে বার করে দিই তবে তো তুমি আমাকেই প্রথমে খেয়ে নেবে

বাঘ বলে, তা কি হয়। আপনি আমায় মুক্তি দেবেন আর আমি আপনাকে খেয়ে ফেলব, বরঞ্চ আমি সারা জীবন আপনার দাসানুদাস হয়ে থাকব। এদিকে এই কথার সাথে বাঘের কান্না কাটি দেখে পণ্ডিত মশাইয়ের মনে একটু করুণা হল। আর তাছাড়া বাঘ তো বলছে যে সে খাবে না, তাই পণ্ডিত মশাই আসতে করে এগিয়ে এসে খাঁচার দরজাটা খুলে দিলেন।

আর যায় কোথা, বাঘ তো বাইরে এসে গেল, আর এসেই বলে, আমার তো ভীষন ক্ষিদে পেয়েছে। এতক্ষণ আমি আটকা পড়েছিলেম। তাই তোমাকে খেতে আমার তো কোন বাধা নেই। তোমাকেই খাব। পণ্ডিত বলে সেটা কি করে হয়, তুমি আমাকে বললে খাবে না তাই তো আমি খাচার দরজা খুলে দিলাম। এখন বলছ যে আমাকে খেয়ে নেবে। এটা কি রকম কথা

দুজনে খুব তর্কাতর্কী হতে লাগল। তার পরে ঠিক হল আর একজন কাউকে জিজ্ঞেস করা যাক । সে যদি বলে বাঘ পন্ডিতমশাইকে খাবে তবে বাঘ খেয়ে নেবে, আর যদি বলে খাবে না তবে বাঘ না খেয়ে চলে যাবে।
প্রথমে জিজ্ঞেস করা হল এক পিপুল গাছকে। গাছ বলে দিল এতে জিজ্ঞেস করার কি আছে। আমি তোমাদের ছায়া দিই, যাতে গরমে তোমরা বসে বিশ্রাম নিতে পার, আর তোমরা আমার ডাল পাতা ভেঙ্গে নিয়ে ছাগলকে খেতে দাও। কাজেই উপকার করলে তার প্রতিদান হচ্ছে শাস্তি। বাঘ তো ঠিক কথা বলছে

পন্ডিতের মনে উত্তরটা ভাল লাগল না। সে এবার জিজ্ঞেস করল একটা মোষকে। কাছেই মোষটা ঘানি টানছিল, তাঁকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলে, তা বাঘ আর কি খারাপ বলেছে। আমি যতদিন দুধ দিয়েছি ততদিন তো আমাকে তোমরা ভাল মন্দ খেতে দিয়েছ আর যখন আমার দুধ নেই তখন খাবারও নেই

এবার পন্ডিত জিজ্ঞেস করে রাস্তাকে। কিন্তু সেও ঐ একই ধরনের কথা বলে। বলে যে আমার উপরদিয়ে তোমারা যাতায়াত কর কিন্তু আমাকে কি দাও তার বদলে, ধল ময়লা ছাড়া কিছু না।

এমন সময় পন্ডিত দেখে একটা শেয়াল কাছ দিয়ে যাচ্ছে। শেয়াল জিজ্ঞেস করে, কি ব্যপার পন্ডিত মশাই। 
আপনাকে তো দেখছি খুব মুশড়ে পরে আছেন।  পন্ডিত মশাই তাঁকে সব কথা খুলে বলেন। কিন্তু শেয়াল বলে, ঠিক বুঝতে পারছি না। আমরা বরঞ্চ সে জায়গাতে ঘটনা ঘটেছে সেখানেই যাই, তাহলে ব্যপারটা বুঝতে সুবিধা হবে। চলল তারা ঐ খাঁচাটা যেখানে ছিল। বাঘও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। শেয়ালকে আবার যখন পন্ডিতমশাই সব বোঝাতে যায়, তখন শেয়াল বলে,  আমি দেখতে চাই যে বাঘটা কি ভাবে খাঁচাতে আটকা পড়ে ছিল। আর কি ভাবে আপনি খাচার দরজা খুলে দিয়েছিলেন

এদিকে বাঘ রেগে বলে আমার কিন্তু ক্ষিধে খুব জোরে পেয়েছে আমি এখনই পন্ডিতকে খাব। পন্ডিতমশাই বলে এই শেয়াল ভায়া একবার দেখতে চান যে আমি কি ভাবে আপনাকে খাঁচার বাইতে বার করে দিয়েছি।  আবার পণ্ডিত মশাই সব কথা বলতে যায়। শেয়াল বলে, পন্ডিত মশাই আপনি খাঁচার ভেতরে ছিলেন, আর বাঘটা বাইরে দিয়ে যাচ্ছিল, তার পরে আপনি খাঁচার বাইরে এসেছিলেন


এইবার বাঘ গেল রেগে, শেয়ালকে বলে, বুদ্ধু কোথাকার, বলছিনা আমি খাচার ভেতরে ছিলাম। দেখ ঠিক এই ভাবে খাচার ভেতরে ছিলাম। এই বলে বাঘ খাচার ভেতরে ঢুকে গিয়ে দেখাতে লাগল। শেয়াল তখন পণ্ডিত নশাইকে বলে তাহলে আর দেরি কেন। এবার খাচাটা বন্ধ করে দিন। বাঘ ভায়া ভেতরেই থাকুক।