ছোটবেলায় বাড়ীতে দেশের বাড়ী থেকে ঠাকুর্দা আসতেন। তখন
আমরা খুবই ছোট। মাকে দেখতাম এত্তবড় ঘোমটা টেনে দাদুর জলখাবার নিয়ে আসত। তার পর জল
ছিটিয়ে আঁচল দিয়ে খাবার জায়গাটা মুছে দিয়ে তার পরে থালা রাখত। থালায় সাদা সাদা
ফুলকো লুচি, আর একটা বড় বাটীতে দুধ। দেশের বাড়ীতে গরু ছিল, কলকাতায় গরু নেই, গয়লা
এসে দুধ দিয়ে যায়। সেটাতে তখনকার দিনেও ২৫-৩০ ভাগ জল মেশান থাকত। তাই তাকে ফুটিয়ে
ফুটিয়ে প্রায় রাবড়ির অবস্থায় নিয়ে আসা হত। সাথে আলু ভাজা। কোন সময়ই একটা লুচিতে সাদা থেকে লাল ভাব
দেখিনি। সেটা ভাজা হত ভাদুয়া ঘিতে। ঘি গাওয়া আর ভঁয়সা মানে গরুর দুধ আর মোষের দুধ
থেকে তৈরী ঘি। ভাদুয়া ঘি ছিল ভঁয়সা ঘি। উত্তর প্রদেশের ভাদুয়া থেকে
তৈরী হয়ে আসত তাই তার নাম ছিল ভাদুয়া। দোকানে ১৫
সেরের টিনে করে থাকত।
বাবাকে দেখেছি স্কুলের ছুটির দিনে লুচি দিয়ে জলখাবার
খেতে। ঐ সময় একটা আরও ব্যপার ছিল। বাড়ীতে একটা বেড়ালছানা ছিল, সেটা এসে বাবার
থালার পাশে বসত আর বাবা তাকে লুচির ফোলা ভাগের থেকে পাতলা চাদরের মত অংশটা ছিড়ে
দিতেন আর বেরালটা সেটা খেত। তখন লুচি ছিল সাদা ময়দার তৈরী। আটার তৈরী লুচিকে পুরী
বলা হত এবং সেটা সাধারনত অবাঙ্গালী মিষ্টির দোকানেই পাওয়া যেত। সাথে হয় কুমড়োর
ঘ্যাঁট নয় ঘন ছোলার ডাল।
আটা দিয়ে আমরা লুচি বানান শুরু করলাম যখন ময়দাতে
ভেজাল দিয়ে তার অবস্থা এমন করা হল যে তাকে বেলতে গেলে রাবারের মতন এদিকে টানলে
ওদিকে ছোট হয় নয়ত বেলনির চাপটা তুলে নিলেই সে আবার নিজের অবস্থায় ফিরে যেত।
বাড়ির মেয়েদের
ময়দা মাখার সময় বিশেষ ধ্যান দিতে হত যাতে শক্ত না হয় বা ময়ান বেশী হয়ে
নিমকি না হয়। ক্লোরেস্টরল বেড়ে যাবে বলে আজ ঘিএর বদলে সয়া রিফাইনে লুচি ভাজা
হচ্ছে। কিন্তু সেই ঘিএ ভাজা লুচির স্বাদ আর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না। আর ভাজাটাও
হচ্ছে কালে ভদ্রে।
আজকে আমাদের ব্রেকফাস্ট বলতে সাধারনত রুটি সাথে কম তেলে তৈরী তরকারী। যতদূর সম্ভব আলু বা কুমড়ো
না দিয়ে (সুগারের কথা চিন্তা করে)। রুটিটা মাল্টিগ্রেন আটার হতে হবে। ময়দাতে
কার্বহাইড্রেট বেশী আর ফাইবার কম বলে তাকে একঘরে করে রাখা হয়েছে। ময়দার তৈরী ঘিয়ে ভাজা লুচি আজকাল ঠাকুরের ভোগেই
দেওয়া হয়। (ঠাকুরের হজম শক্তি জোরদার)। এমনকি জামাই ষষ্ঠীতে জামাইকেও এটা দেওয়া
হবে না (মেয়ে তার স্বামীর জন্য মাকে আউটরাইট নাকচ করে দেবে)। "ওটা ওর সহ্য হয় না দিও না।"। ইতিমধ্যে
যদি কিছুটা তৈরী হয়ে গিয়ে থাকে তবে সেটা মেয়ের জলখাবারে যাবে।
আগে জলখাবারে মিষ্টি থাকতোই। রসগোল্লা, নয়ত সন্দেশ
কিছু না হলে ঘরে তৈরী নারকেল দিয়ে তৈরী নাড়ু বা ছাপা। বিশেষ কিছু অনুষ্ঠান হলে সরু
চিড়ে, মোটা চিড়ে, গঙ্গাজল ইত্যাদি। এই তিনটেই কিন্তু মিষ্টির নাম। সুগারের দোহাই
দিয়ে আমরা এই মিষ্টি জিনিষটার চল প্রায় তুলে দিচ্ছি। আর মিষ্টি ঘরে তৈরী করার মত সময়ও
কার কাছে আছে?
দুধ বলে আমরা আজ যেটা পাই সেটা মিল্ক পাউডার গোলা জল।
আসল গরুর দুধ কোথায়? মাখনের বদলে বাটার অয়েল মেশান হয়। কাজে ঘি তোলার জন্য যদি
সর জমানো হয় তবে সেটা ঐ বাটার অয়েলের ঘি
হবে। আসল নয়। কাজেই তাতে কোন গন্ধ থাকে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন