তাহিতি-নুইএর যাত্রা
থর হেয়ারডালের তত্ব ছিল, পলিনেশিয়ান দ্বীপ সমূহে আমেরিকার থেকে লোকে গিয়ে
বসতি স্থাপন করেছিল। সেটা কিন্তু অনেক পলিনেশিয়ান দ্বীপবাসীর মনে ঠিক বলে মনে
হয়নি। এই রকন একজন ছিলেন এরিক দ্য এরিক, একজন ফরাসী ধনী ব্যারণ, যিনি তাহিতি
দ্বীপে বাস করছিলেন। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে
তিনি বাঁশের তৈরী ভেলা আর পলিনেশীয়দের নৌচালনার কৌশল নিয়ে পড়াশুনা করে ঠিক করে ফেললেন যে পলিনেশিয়া থেকে
এই বাঁশের ভেলায় চড়ে দক্ষিন আমেরিকায় গিয়ে থরের দেওয়া তত্ব ভুল প্রমাণ করে দেবেন।
কে এই এরিক বিশচপ? বাবা তাকে পাঠিয়েছলে সমূদ্র স্রোতের বিষয়ে অধ্যয়ন করতে।
তার মনে বিশ্বাস ছিল যে সাধারণতঃ এই বিষয়ে শিক্ষা নেবার পর যেমন অন্য ছেলেরা অফিসে
বসে কাজ করে সে রকম তার ছেলে এরিক অফিসে চাকরী নেবে। কিন্তু সমুদ্রের আকর্ষণ তার
ছিল অসম্ভব। তাই সুযোগ পেলেই তিনি জাহাজে চাকরী নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। আর তা ছাড়া তার
মনে পলিনেশীয় দ্বীপ গুলোর উপর একটা আলাদা আকর্ষন ছিল।
১৯৩২ নাগাদ চীন দেশে থাকার সময় তিনি ফু-পা নামে এক জাঙ্ক শ্রেণির নৌকো কিনে
সমূদ্র যাত্রার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তাইওয়ান উপকূলে তার নৌকো ঝড়ে পরে
ভেঙ্গে যাবার পরে তিনি ফু-পা ২ নামের আর একবার নৌকো বানিয়ে সমূদ্রযাত্রা করলেন
লক্ষ হল প্রথমে ফিলিপাইন। ফু-পা ২, ফু-পা প্রথমের চেয়ে ১২ টন হালকা হওয়াতে একে
চালানো অনেক সহজ হয়েছিল। মিনডানাও
পৌঁছানোর পরে মনে হল যে গালাপাগোস দ্বীপ ঘুরে গেলে কি রকম হয়।
উদ্দেশ্য ছিল যে নিরক্ষীয়
সমূদ্রস্রোত ধরে তার যাত্রা, তার এশিয়া
আমেরিকার মধ্যে যোগাযোগের তত্বকে প্রমাণ করবে। কিন্তু সামূদ্রিক জলজ পোকার আক্রমনে তার নৌকো
ক্ষতিগ্রস্থ হওয়াতে তার অভিষ্ট লক্ষের দিকে না গিয়ে তিনি ঠিক করেন যে অষ্ট্রেলিয়া
ঘুরে পূর্ব দিকে সিডনীতে যাবেন। কিন্তু ঝড়ের জন্য তার নৌকো অষ্ট্রেলিয়ার
উত্তর-পশ্চিম দিকের শহর ব্রুমে পৌছায়। সেখানে কিছু মেরামতি করে নিউগিনির দক্ষিণ
দিয়ে সীডনীর দিকে রওনা দেন। কিন্তু আবার ঝড় এসে তাকে নিউগিনির উপকূলে ছেড়ে দ্যায়।
সেখানে কিছুদিন বিশ্রাম নেওয়ার পরে এরিক ঠিক করেন যে চীন থেকে তিনি যে কিউরিও কিনে ছিলেন সেগুলোকে
আমেরিকাতে বিক্রী করে টাকা জোগাড় করা যেতে পারে। সেই ইচ্ছা নিয়ে তিনি এবার উত্তর দিকে নৌকোর মুখ ঘোরান,
এবং মার্শাল দ্বীপপূঞ্জে এসে পৌঁছান। সেই সময় মার্শাল দ্বীপ জাপানীদের দখলে ছিল
তাই তারা নামা মাত্র তাদের বন্দী করা হল।
কিন্তু দিন ১৫ বাদে তাদের ছেড়ে দেওয়া হলে তারা হাওয়াইএর দিকে রওয়ানা দেন।
কিন্তু বন্দী থাকার সময়ে তাদের নৌকোতে খাবার যা ছিল সেগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়াতে তারা
প্রায় অভুক্ত অবস্থাতে হাওয়াই পৌঁছান। ফু পা দ্বিতীয়, মোলোক্কাই দ্বীপে আছড়ে পরে
ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।
হাওয়াই দ্বীপে এরিক ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত কাটান আর ঠিক করেন যে পলিনেশীয় নৌকোর মত ক্যানো তৈরী করে ফ্রান্সের
দিকে রওয়ানা দেবেন। সঙ্গী তাতি এর যদিও ইতিমধ্যেই সমূদ্র সম্বন্ধে বিতৃষ্ণা জন্মে
গেছে তবুও ফ্রান্সের নামে তিনি রাজী হলেন।
১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে ৩৭ ফুট লম্বা একটা ছোট্ট ডবল হাল বিশিষ্ট ক্যানোতে ফ্রান্সের
উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন। নৌকোর নাম দিলেন কাইমিলোয়া। এই কাইমিলোয়া কে দেখা গেল তার আগেকার নৌকোগুলোর চেয়ে অনেক দ্রুতগামী আর জলে অনেক স্থিতিশীল। হাওয়াই থেকে ২৩০০ মাইল দূরের ওয়ালস দ্বীপ পৌছতে
সময় লাগল মাত্র এক মাস।
সেখান থেকে নিউগিনীর দক্ষিণ দিয়ে বালি হয়ে ভারত মহাসাগর পার হবার
দরকার। বালি থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা অন্তরীপ
পার হতে তার সময় লাগল মাত্র ৫৯ দিন।
কিন্তু এই অন্তরীপ পার হবার পরে স্রোতের সাহায্য না পাওয়াতে ট্যাঞ্জিয়ার
পৌছতে সময় লেগে গেল আরও ১০০ দিন। অবশেষে তারা পৌঁছলেন ফ্রান্সের ক্যানে শহরে। এত দিনের সঙ্গী তাতি এবার বিদায় নিল।
কিন্তু এরিক তার যাত্রার কথা মাথা থেকে সরান নি। কাইমিলোয়া কে তার ইচ্ছে মত
অদল বদল করতে গিয়ে তিনি প্রায় এক নতুন নৌকোই বানিয়ে ফেললেন, যার নাম দিলেম
কাইমিলোয়া-বাকিয়া। ইতিমধ্যে তিনি এক নতুন
সঙ্গী, উহু সঙ্গিনী পেয়েছেন। তাকে বিয়ে করে হনিমুন করতে দক্ষিন সাগর মানে
পলিনেশিয়ার দিকে যাবার জন্য বেড়িয়ে পড়লেন ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে। ইউরোপে তখন যুদ্ধ
শুরু হয়ে গেছে। তার যাত্রা কিছুদিন বাদেই ফ্রান্সের পতন হল। কিন্তু ততদিনে তিনি
সমুদ্রে।
বিপদ এল অন্য দিক থেকে। ক্যানারী দ্বীপের কাছে এক রাতে তার নৌকোর সাথে এক
স্পেনীয় মাছ ধরার নৌকোর ধাক্কা লাগলে কাইমিলোয়া দুটুকরো হয়ে ডুবে যায়। ঐ মাছ ধরার জাহাজ তাদের উদ্ধার
করে।
ফ্রান্সে ফেরত এলে তার চিন্তা হয় অর্থের দিকে। ফ্রান্সে তখন আছেন ভিচী সরকার। মার্শাল পেতাঁকে তিনি পছন্দ করতেন
তাই কিছুদিন বাদে তিনি হনুলুলুতে ভাইস কন্সাল হিসাবে নিযুক্তি নিয়ে সস্ত্রীক চলে
আসেন। ভিচি সরকারের পতনের পরে অর্থের জন্য
তিনি এক স্থানীয় ব্যবসায়ীর সাথে যোগ দেন
এবং চেং –হো নৌকো নিয়ে তাহিতি থেকে শুখনো কোপরা আনার কাজে নেমে
পড়েন।
কিন্তু প্রথম যাত্রায় লোকসান
হওয়াতে তার সাথে মামলা হয়। নিজেকে বাঁচতে তিনি ঐ নৌকো নিয়ে কাউকে না জানিয়ে তাহিতি
পালিয়ে যান। এটা ছিল ১৯৪৯ সালের ঘটনা।
এরিক মনে করতেন যে নৃত্বাত্তিকেরা যদি মনে করেন যে পলিনেশিয়াতে বাইরে থেকে
লোকেরা এসেছিল এবং যেহেতু সেখানকার গাছপালার সাথে দক্ষিণ আমেরিকার গাছপালার মিল
আছে তাই সেগুলো দক্ষিণ আমেরিকার থেকে উপনিবেশকারীরা পলিনেশিয়াতে তাদের সাথে এনেছে
তাহলে সেটা ভুল হবে তার কারণ হিসাবে তিনি বললেন এটাও তো হতে পারে যে পলিনেশিয়ার
নাবিকদের দক্ষিণ আমেরিয়ার সাথে যাতায়াত ছিল যাতে দুই দেশের মধ্যে এক সাংস্কৃতিক
বন্ধন গড়ে উঠেছিল।
তার মতে এই পলিনেশীয় লোকেদের নৌকোতে করে যাতায়াত, ঈষ্টার দ্বীপ এবং তার
ওপারে দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত আর পূর্ব দিকে ইন্দোনেশিয়া হয়ে ভারত হয়ে আফ্রিকার
মাদাগাস্কার পর্যন্ত ছিল। এটা ২০০০ বছর আগের কথা এর পরে আমেরিকাতে ইউরোপ থেকে
ক্যারিবিয়ান দ্বীপে স্পেনীয়ার্ড দের আগমন হয়েছিল।
জেনেটিক বিচারেও দেখা গেল যে মাদাগাস্কারের লোকেদের সাথে পলিনেশিয়ান দ্বীপের বাসিন্দাদের যথেষ্ট
মিল আছে। কিন্তু তারা যাতায়াত করত কি ভাবে , কি ধরনের নৌকো নিয়ে ।
তার বিশ্বাস হল যে পলিনেশিয় দ্বীপের লোকেরা তাদের বিভিন্ন যাত্রার জন্য
বিভিন্ন ধরণের নৌকো ব্যবহার করত। কারণ তারা যথেষ্ট নৌবিদ্যায় বিশারদ ছিল। তার ধারনা হল যে ছোট হাল্কা ক্যানো
অল্প গভীর জলে সহজেই যেতে পারে আর বর্তমান
ধরণের দুই হালের ক্যানো কোথাও আক্রমন করে চটপট চলে যাবার কাজেই ব্যবহার করা যাবে।
তাহলে নিশ্চয় তার চেয়ে বড় ভেলার মত কিছু ব্যবহার করা হত। কিন্তু সেটা তৈরী হত কি
দিয়ে। যেহেতু বালসা গাছ পলিনেশিয় দ্বীপে পাওয়া যেত না তাই তিনি ভাবলেন যে এটা
নিশ্চয়ই বাঁশ দিয়ে তৈরী ছিল।
কিন্তু কি রকম চেহারা হবে সেই
ভেলাটার। এরিকের মনে চিন্তা ছিল যে যখন পুরনো ইতিহাস থেকে কোন রকম ছবি বা বর্ণনা
পাওয়া যাচ্ছে না তখন নৌবিদ্যার হিসাব অনুযায়ী ভেলা টা বানানো হোক। শুরু হয়ে গেল
সেই ভাবেই ভেলা তৈরি করার।
যেহেতু এটা মানুষের সহ্যশক্তির পরীক্ষা নয় তাই ভেলার উপরে বানানো হল একটা
ঘর প্লাইউড দেওয়া আর যতদুর সম্ভব খাবার মজুত করা হল। হিসাব করে দেখা গেল যে দক্ষিণ
আমেরিকা পর্যন্ত যাত্রা সম্পুর্ণ করতে মাস চারেক লাগতে পারে তাই একটু বেশী করে
পাঁচ মাসের জন্য খাবার নেওয়া হল। কি ধরনের খাবার। বিয়ার আর লেমনেড। কলার কাঁদি,
আলু পিঁয়াজ, কুমড়ো আর নারকেল। পাকা এবং কাচা ডাব হিসাবে। আধুনিক যন্ত্রপাতি হিসাবে সাথে রইল ইকো সাউন্ডার, রেডিও যোগাযোগের জন্য। ডার্করুম,
ছবি তুলে তাকে ইতিহাসের পাতায় রাখার জন্য।
সঙ্গী হিসাবে রইলেন এরিক কে নিয়ে পাঁচ জন। এলাইন ব্লুম, তার দাদা মাইকেল।
জুয়ানিটো আর ফ্রান্সিস কাওয়ান। যেদিন যাত্রা শুরু করা হবে সেদিনের চেহারাটা
তাহিতিতে একেবারে উতসবের মত। ড্রাম বাজছে, গান হচ্ছে। যত লোক আছে দ্বীপে, তারা এসে
ঘাটে জমা হয়েছে, মেয়েরা উপাউপা নাচের সাথে গান গেয়ে ভেলাকে বিদায় জানাচ্ছে। লোকেরা তার আগে যার যা ইচ্ছে হয়েছে তাই
যাত্রীদের রসদ হিসাবে দিয়ে গেছে। এমন কি তার মধ্যে একটা শূকরছানাও ছিল, যাতে
রাস্তায় মাংস খাবার ইচ্ছে হলে তার মাংস খাওয়া যেতে পারে। বেশ কিছু মুরগীও সাথে
নেওয়া হল যাতে প্রোটিনের অভাব না হয়। যদিও দরকার মতন সামূদ্রিক মাছ ধরে খাবার কোন
বাধা তো নেই যে আমার মাছগুলো তুই ধরে খেয়ে নিচ্ছিস বলে কেউ তেড়ে আসবে। কম করে গোটা পঞ্চাশেক ক্যানো তাহিতি নুইএর সাথে
তাকে সমুদ্রে কিছুটা এগিয়ে দেবার জন্য সাথে যাচ্ছে। একটা জাহাজ এসে তাহিতি নুইকে
টেনে বন্দর ছাড়িয়ে বার সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিল। এইবার তাহিতি নুই একা চলল।
তারিখটা ছিল ১৯৫৬ সালের নভেম্বর মাসের ৬ তারিখ।
যাত্রা শুরুতেই বিপদ। ভেলার যা ওজন নেবার ক্ষমতা তার চেয়ে অনেক বেশি মাল
নেওয়া হয়েছে। লোকেদের উতসাহে যে এত রসদ নিতে হবে তা নক্সা বানানোর সময় মনে রাখা হয়
নি। উপায় হয় কিছু মাল জলে ফেলে দিয়ে হাল্কা হওয়া আর নয়তো ফিরে গিয়ে আরও কিছু বাঁশ
কেটে ভেলাকে জলের উপরে ভাসিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করা। এমনিতে ৮০০ মোটা মোটা বাঁশ কেটে
ভেলার প্রাথমিক চেহারাটা তৈরী করা হয়েছিল।
এরিক ঠিক করল যে ফেরত গিয়ে আরও কিছু বাঁশ কেটে ভেলাকে শক্ত পোক্ত করা হোক। কিন্তু
তাতে বিপদ একটা যাত্রার শুরুতেই ফেরত গেলে লোকে ঠাট্টা করতে আর বাকী রাখবে না। তাই
এরিক যখন বন্দর থেকে ভেলাকে টেনে নিয়ে যাবার জন্য জাহাজের সাহায্য চাইল তখন একথাও
বলে দিল যেন তাদের কোন এক দূরের খাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় যাতে লোকে বিশেষ নজরে না
পড়ে। তাই হল, তাহিতির দক্ষিণ দিকের একটা দূরের
খাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হল আর যথেষ্ট পরিমাণ বাঁশ কেটে ভেলাকে আরও মজবুত করা হল। এবার
আবার যাত্রা হল শুরু দক্ষিণ দিকে অষ্ট্রাল দ্বীপসমুহের দিকে।
যাবার কথা ছিল রুরুটি দ্বীপের
পূর্ব দিক দিয়ে, কিন্তু এই প্রথম তাদের সাথে হাওয়া উলটো দিকে বইতে শুরু হল। উলটো
দিকে ভেলা চলতে শুরু করলে, দ্বীপগুলোকে পাক মেরে তাদের পশ্চিম দিক দিয়ে দক্ষিণ
সমুদ্রে ভেলা এসে পড়ল। ১৯৫৬ সাল শেষ হয়ে ১৯৫৭ সাল যখন শুরু হল, তখন ভেলা দক্ষিণ
সমুদ্রে ৩৩ ডিগ্রী ধরে পুর্ব দিকে চলছে আর গন্তব্য চিলির উপকূল থেকে মাত্র ৫০০০
মাইল দূরে আছে।
এইবার অনুকুল হাওয়া আর স্রোতের
সাহায্য পেয়ে ভেলা আগে এগিয়ে চলল। ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত আবহাওয়া ভাল, কিন্তু
বৃষ্টি না হওয়াতে জলের কষ্ট হতে পারে বলে মনে হচ্ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের ২৩ তারিখা ভেলা তার যাত্রাপথের
মাত্র আদ্ধেক রাস্তা পার হতে পেরেছে। কাজেই এই গতিতে চললে তাদের চিলি পৌছাতে পাঁচ
মাসের বেশী লেগে যাবার কথা। ততদিন রসদের জোগান থাকবে কিনা সন্দেহ আছে। আর তাছাড়
ভেলার সমূদ্রের জলে ইতিমধ্যেই পাঁচ মাসের বেশি হয়ে গেছে আরও মাস তিনেক টিকবে কিনা
তাও একটা ভাববার বিষয়।
আশায় ভর করে যাত্রীরা ভাবতে সুরু করল যে এবার নিশ্চয়ই ভাল দিনের দেখা পাওয়া
যাবে। কিন্তু উলটো হল, এবার হাওয়ার দিক ঘুরে পূর্ব দিক থেকে বইতে শুরু করল। যদিও
প্রথম প্রথম ইচ্ছে ছিল যে ৪০ ডিগ্রীর গর্জনকারী চল্লিশা হাওয়ার আর স্রোতের সাহায্য
নিয়ে যাওয়া হবে যেখানে বছরে সারা সময় পশ্চিম দিক থেকে হাওয়া আর স্রোত বয়ে চলে।
কিন্তু ৩৩ ডিগ্রীতে ভাল অবস্থা পেয়ে, আর দক্ষিণ
দিকে নামা হয়নি। এখন সেদিকে গেলে ভেলা হাওয়ার ধাক্কা সহ্য করেতে পারবে কিনা সে সন্দেহ
মনে দেখা দিতে শুরু করল।
এদিকে মার্চ মাসের প্রথম দিকে দেখা গেল তারা আবার সেই পনের দিন আগেকার
অবস্থানে ফেরত এসেছে তখন যাত্রীদের মনের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে উঠল, তারা কাছের
ঈষ্টার দ্বীপে যাবার কথা চিন্তা করতে লাগল। অবশ্যি এরিক কিন্তু তার মুল লক্ষ্য
থেকে একফোঁটাও নড়েনি।
ভেলা আগে এগিয়ে চলেছিল। জলের অভাব মে মাসে হঠাত এক রাতে বৃষ্টি হয়ে পূর্ণ
হয়ে গেল। শুকরছানার কপালটা খুবই ভাল ছিল। একদিন যখন মুরগির মাংস খেয়ে অরুচি ধরে
গেছে তখন ঠিক করা হল যে পরের দিন ওটাকে কেটে রান্না করা হবে। কিন্তু ফ্রান্সিস পরে
দিন একটা শুশুক ধরাতে, তার মাংস রান্না করা হল আর শুকরছানা বেঁচে গেল। পর পর দুবার
এই রকম হবার পরে সেই শুকরছানাকে ধরে নেওয়া হল ষষ্ঠ সহযাত্রী, তার নাম দেওয়া হল
চানচিতা এবং তাকে প্রত্যহ যোগ্য মর্যাদাতে সাথে নিয়ে খেতে বসা হত।
ম্যাস্কট হিসাবে আরও তিন বিড়াল
ছানার ভাগ্য ছিল এই যাত্রায় সঙ্গী হবার। অবশ্যি রাস্তায় তাদের একজন দেহত্যাগ করলে
পরে, তার জায়গা ভর্তি করার কোন সুযোগ ছিল না বলে সেটা খালি থেকে গেছিল। আরও কিছু
সঙ্গী সহযাত্রী হিসাবে সাথে যাচ্ছিলেন। ভেলা যখন ঘুরে আবার হাইতির খাঁড়িতে যায় তখন
কিছু ছোট মাছ ভেলার নীচে আশ্রয় নিয়ে সাথে সাথে যাচ্ছিল।
মে মাসের এক ঝড়ে দেখা গেল ভেলার থেকে চারটে বাঁশ খুলে ভেসে গেছে। সেগুলো
ছিল প্রধান অঙ্গ ভেলার। ঝড় চলাকালীন দেখা
গেল যে আরও একটা বাশ খুলে ভেসে যেতে শুরু করেছে। সেটাকে তুলে নিয়ে দেখা গেল যে
তাতে পোকার আক্রমন হয়েছে আর সেটাকে ভাঙ্গার পরে টুকরো গুলো আর ভেসে থাকার যোগ্য
রইল না। তখনও গন্তব্য স্থল চিলি আরও ৮০০ মাইল দূরে ।
মে মাসের মাঝামাঝিও এক ঝড়ের সময় দেখা গেল ভেলার নাবিকেরা আর আলেক্সান্ডার
শেলকার্ক হয়ে হুয়ান ফার্ণান্দেজ দ্বীপে
যেতে পারছে না, তখন বাধ্য হয়েই হাইতিতে রেডিও যোগাযোগ করা হল যাতে কোন এক জাহাজ
এসে তাদের টেনে দ্বীপে পৌঁছে দ্যায়। সেখানে আবার ঠিক মতন বাঁশ লাগিয়ে মেরামতি করে
আবার বাকী যাত্রাটা সম্পুর্ণ করা হবে।
মে মাসের ২২ তারিখে চিলির এক নৌবাহিনীর জাহাজের সাথে দেখা হলে তাকে অনেক বোঝানর
পরে ভেলাকে টেনে কাছের দ্বীপে পৌঁছে দেবার জন্য রাজী হয়। কিন্তু এই টানাটানির সময়
জাহাজের সাথে ভেলার ধাক্কা লাগলে ভেলার একদিকের কিছু বাঁশ ভেঙ্গে যায় আর ভেলা
ডুবতে শুরু করে। ২৬ তারিখে যাত্রীরা তাহিতি নুই কে বিদায় জানিয়ে নৌবাহিনীর জাহাজে উঠে
পড়েন। মায় শুকরছানা এবং বিড়ালছানা শুদ্ধ। সাথে নিয়ে আসা গেল না সঙ্গী ছোট মাছের
দলকে, যারা সেই সুদূর হাইতি থেকে সাথে সাথে চলছিল। তাহিতি নুইএর যাত্রা সম্পুর্ণ
না হলে প্রায় কাছেই পৌঁছে গেছিল।
এরিকে এরিকের চিন্তায় কিন্তু তখনও তার সমূদ্রের যাত্রা শেষ হয়। সেই যাত্রার
বিবরন পরে দিচ্ছি।