শুক্রবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৫

আমার দেখা সত্তরের দশক (৫)

নতুন শখ হল মুরগী পোষা যায় কিনা। দুটো মুরগী এনে তাদের কেটে খাওয়ার বদলে ভেতরের উঠোনে কয়লা রাখার জায়গাতে রেখে দেওয়া হল। তখন গ্যাস আর কোথায়। কয়লা মানে কোল ব্রিকেটস। মুরগী দুটো খায় দায় আর পেছনের বাড়িতে গিয়ে ডিম পেরে আসে। কদিন দেখার পরে আমার বাড়িতে যে অল্প বয়সী বউটি কাজ করত সে বলে,  ওটাতো ঐ বাড়িতে গিয়ে ডিম পেরে আসছে।

তারপর থেকে কদিন একটু আটকে রাখার পরে রোজ একটা করে ডিম পাওয়া যেত। তখন মেয়ের মাথা চুলের জন্য নেড়া করে দেওয়া হয়েছিল, আর তার পরে মাথায় ডিম মাখালে চুল ভাল হবে অতএব ওর মাথায় একটা করে ডিম ঠুকে ফাটান হত। আর তাতে ওর দাদাদের কি উল্লাস। এখনও মেয়ে আমাকে বলে, আমার মাথায় তুমি যে ডিমগুলো ফাটিয়েছ তার দৌলতেই আমার চুল এত বড় হয়েছিল।

বাডীতে কাজ করতে আসত প্রথম প্রথম এক বছর পঞ্চাশেক বয়সের উড়িয়া মহিলা। সাথে তার ছেলের বৌ। পরে তার ছেলের বৌ একাই কাজ করতে আসত। বউটির বিয়ে হয়েছিল বছর দুয়েক আগে, কিন্তু তখনও তার কোন সন্তান হয়নি বলে তার শ্বাশুড়ি আবার ছেলের বিয়ে দেবে বলে ঠিক করছিল। বৌ, নাম ছিল প্রমীলা, এসে তার মাজি অর্থাৎ আমার স্ত্রীকে নালিশ করাতে, সে শ্বাশুড়ী কে ডেকে বোঝায়।

আমার অফিস কাছেই হলেও পরে সেটা তুলে নিয়ে বড় অফিসের পাশে পাঠান হল। সে সমস্ত বিল্ডিং তৈরী করা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে একটা ব্লক রেলের স্কুলের প্রাইমারী সেকশনকে দেওয়া হল। আর একটা ব্লকে এসে গেল স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। মেয়ে কেজি সেকশনে এসে এই প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হল।

কিন্তু সে তখন জানে যে তার বাবা রেলের ফোরম্যান, এর পরেই ফাইভম্যান হবে,  (তার হিসাবে ফোরের পরে ফাইভ, অতএব ফোরম্যান থেকে প্রমোশন পেলে ফাইভম্যান হয়ে যাবে), অতএব টীচার একবার তাকে বকাতে সোজা এসে আমার অফিসে হাজির, আমাকে নালিশ করবে।

কিন্তু আমাকে না পেয়ে আমার অফিসের চৌকিদার বুড়োকে বলেছে। মুন্নিকে কে বকেছে কার ঘাড়ে কটা মাথা, অতএব চৌকিদার তার লাঠি ঠুকতে ঠুকতে গিয়ে হেড মিস্ট্রেসের কাছে হাজির। এর একটা বিহিত করতে হবে। মুন্নিকে বকা চলবে না। আমি ফিরে এসে সব সামাল দিই।

বিলাসপুরে তখন বাঙ্গালী কর্মচারীর সংখ্যা প্রচুর। তিনটে দূর্গা পূজা হত শুধু রেলের কলোনীতে, তা  ছাড়া সিভিল সেটেলমেন্টে আরও গোটা তিনেক।  কোয়ার্টারের কাছেই ছিল কনষ্ট্রাকশন কলোনীর পুজা, যেখানে সারা দিন কেটে যেত। আমাকে অফিসে যেতে হত কিন্তু বাড়ীর বাকী লোকে ঐ প্যান্ডেলে সারা দিন পড়ে থাকত। মধ্যে একবার এসে সন্ধ্যের আরতির আগে কাপড় বদল করে আবার যাওয়া।

এই সময় আমাকে একটু অফিস সংক্রান্ত সোশাল কাজ করতে হল। মানে আমার এক সহকর্মী হঠাত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি থাকতেন বিলাসপুরে একা, স্ত্রী কন্যা থাকতেন কলকাতায়। বেশ কিছু দিন হাসপাতালে থেকে পরে ছাড়া পেলেন। অফিস থেকে তার কলকাতায় মেডিকাল রেফারেন্সের বন্দোবস্ত করা হলে তাঁকে কলকাতায় পোঁছানর দায়ীত্ব পড়ল আমার উপরে।

ইতিমধ্যে তার স্ত্রী এবং কন্যা বিলাসপুরে এসে হাজির। এই তিনজনকে নিয়ে আমি একটা ফোরবার্থ কম্পার্টমেন্টে রিজার্ভেশন করে, নিয়ে গেলাম কলকাতায়। কেশব সেন ষ্ট্রীটের বাড়িতে পৌছিয়ে দিয়ে আমার ছুটি। পরে অবশ্যি তার ট্রান্সফার কলকাতায় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
    
রায়পুরের কাজ ভালভাবে শেষ করার জন্য যদিও আমার নামে একটা অ্যাওয়ার্ড এল, তবুও আমাদের মতন অস্থায়ী কর্মচারীদের উপরে ক্রমশই খাড়া নামার ভয় বাড়ছিল। তাই আমার রায়পুরে থাকার সময়েই আমরা ৭১ জন মিলে কলকাতা হাইকোর্টে রেলের বিরুদ্ধে মামলা করলাম। আমাদের স্থায়ীত্ব দিতে হবে এবং এই যে কবছরের কাজের অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার মূল্য দিতে হবে।  যুক্তি রইল যদি আমরা কোন জিনিষ গড়তে পারি তবে সেটাকে ঠিক রাখার জন্য সমস্ত কর্তব্যও আমরা করতে পারি। আমাদের হয়ে ব্যারিষ্টার দাঁড়ালেন স্নেহাংশু আচার্য আর রেলের পক্ষে শঙ্করদাস ব্যানার্জী।

কেসের কাজকর্ম দেখার জন্য এক একজনকে মাঝে মাঝে কলকাতায় আসতে হয়। কেস চলতে থাকল। শেষে হাইকোর্ট থেকে রায় বার হল আমাদের বিরুদ্ধে। বিচারকের মন্তব্য ছিল, যদিও আমাদের দাবীটা যৌক্তিক, তবুও বর্তমানে রেলের কোন আইনের দ্বারা আমাদের দাবীকে আইনানুগ করে নেওয়া যাচ্ছে না। সাথে আরও বলা হল রেল যেন এই দাবীগুলোকে সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করে।

এই নিয়ে যখন আমরা সাংসদদের সাথে দেখা করেছিলাম, তখম এক বামপন্থী সাংসদের বক্তব্য ছিল অদ্ভূত। তিনি সোজা বলে দিলেন, তোমাদের ৭১ জনের  দাবীর জন্য তো আমি আমার এত বড় রেলের অন্যান্য কর্মচারীদের ভাসিয়ে দিতে পারিনা।

তার প্রধান যুক্তি ছিল যদি আমাদের অভিজ্ঞতাকে দাম দেওয়া হয় তবে আমাদের এই সমস্ত প্রোমোশনগুলোকেও মান্যতা দিতে হবে আর তাতে ওনার ইউনিয়নের সদস্য, যারা সুযোগের অভাবে এত দিন প্রমোশন পান নি বা কাজের খাতিরে যাদের এই ধরণের কাজ করতে পাঠানো হয়নি, তাঁরা বঞ্চিত হবেন।

আমরা ডিভিশন বেঞ্চে আপীল করলাম। ইতিমধ্যে এলাহাবাদ কোর্টেও একই ধরনের এক মামলাতে রেলের বিপক্ষে রায় গেল। রেল ওখানে আপীল করল। কলকাতা হাইকোর্টে বোর্ড থেকে একজন এসে সওয়াল করার সময় বিচারককে বললেন, এলাহাবাদে এই ধরনের একটা কেস আছে। তাতে যা রায় হবে সেটা আমরা দুই মামলাতেই মেনে নেব। বিচারক রাজী হয়ে আমাদের আপীল ডিসমিস করে রায় সেই ভাবেই দিলেন। কিন্তু এখানেই রেলের আইনজ্ঞদের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।

আমাদের চাকুরীর মেয়াদ তখন থাকছে আর খুব বেশি হলে বছর পঁচিশ। ততদিন যদি এলাহাবাদের মামলাতে তারিখের পর তারিখ নিয়ে নেওয়া যায় তবে কতদূর পর্যন্ত এই সব বালখিল্যেরা লড়তে পারবে। যতদুর জানি এখনও সে কেসের রায় বার হয়নি। তাছাড়া বোর্ডের প্রতিনিধি আমাদের এমন ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন, আমরা যে এই লাখ লাখ টাকা  খরচ করছি, সেটা বোর্ডে দিলেই সব হয়ে যেত। কালো টাকার কারবার সব সময়েই ছিল আর থাকবেও। প্রথম প্রথম যারা অন্য বিভাগ থেকে ডেপুটেশনে এসেছিলেন তাঁদের ফেরত পাঠান হতে লাগল। তাঁদের পরে আমাদের কিছু কিছু লোকেদের অস্থায়ী হিসাবেই  এলাহাবাদ বা ওয়ালটেয়ার এলাকায় পাঠান হতে লাগল।

শেষের দিকে এমন অবস্থা হল যে সারা অফিসে (ইলেক্ট্রিল্কাল সেকশনে) আমি একমাত্র সিনিয়র সুপারভাইসরি ষ্টাফ। আমার অধীনে একজন সুপারভাইজর আর কিছু খালাসি। যদি কোথাও কিছু দরকার পরে তবে সেই কাজটুকু করানর জন্য। মূলত কাজগুলো ছিল বড় আজব ধরনের।

তবে এই সময়ের একটা মজার কথা না বলে পারছিনা। ভিলাই রেলের বৈদ্যুতিক ইঞ্জিন মেরামতীর কারখানাতে একটা নতুন মেশিন বসবে, পিট হুইল লেদ। ইঞ্জিনের চাকার উপরে যে ষ্টীলের টায়ার লাগানো থেকে তাকে কেটে আবার গোল করে দেয়ার কাজের জন্য। যেহেতু চাকাটা খোলা হবে না তাই মেশিন বসাতে হবে লাইনের নীচে, মাটী খুঁড়ে। কাজ শুরু করা আগে তো কন্ট্রাক্টর তার পুজাআচ্চা করে নিয়েছিল। কিন্তু শেষ হবার পরে মেশিনের কাজের উদ্বোধন করার জন্য শুভদিন দেখতে হবে। ধারেকাছে পাজি অনুযায়ী কোন শুভদিন না পাওয়াতে স্থির হল যে প্রাচীন প্রবাদ মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা। অতএব এক বুধবার দেখে মেশিনের কাজের উদ্বোধন করা হল, আমরা ইতরজন মিষ্টান্ন ভক্ষণ করলাম।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন