বৃহস্পতিবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৫

আমার দেখা সত্তরের দশক (৩)

রায়পুরে তখন বাঙ্গালী অনেক হলেও তাঁরা সমস্ত শহরের অন্য প্রান্তে (বুড়া পাড়া এলাকাতে) থাকেন। সেখানে একটা কালীবাড়িও আছে। আগে যে আমার মাসতুতো দাদার কথা বলেছি তার শ্বশুরবাড়ীও  এই বুড়াপাড়াতেই। দুর্গা পুজা শহরে একটাই, এই বুড়াপাড়াতে হত সেই সময়, যদিও বাকী প্রায় প্রত্যেক পাড়াতেই হত নবদূর্গার আরাধনা।

আসলে আমাদের মা দূর্গার ছেলেপিলেকে নিয়ে সবশুদ্ধ এক সাথে পূজো হয় প্রধানতঃ বাঙ্গালীদেরই, অন্য সব জায়গাতে একা অম্বা মা হিসাবে সিংহবাহিনী প্রতিমার পুজা হয়। ৯ দিন ধরে সেই পূজা চলে। রাবণ দহণের ব্যপারটা দক্ষিণ ভারতে নেই, উত্তর ভারতের অবাঙ্গালী প্রধান এলাকাতেই সেটা হয়। রায়পুরেও সেটা ছিল।

রায়পুর সম্বন্ধে আর একটু কথা বলা দরকার। যেহেতু সাধারন ছত্তিশগডি লোকেরা খুবই সরল, তাই এখানে ডাক্তার মানেই হচ্ছে যে সুই লাগায়। লোকের বিশ্বাস যে সুই লাগালেই অসুখ সারে, সুই লাগানো মানে ইঞ্জেকশন দেওয়া। মিক্সচার বা ট্যাবলেটের উপর লোকের তত বিশ্বাস নেই।

কথা আছে এই ধরনের এক ডাক্তারের কাছে এক গ্রামের লোক এসেছে তার মায়ের জ্বরের জন্য ওষুধ নিতে। ডাক্তারকে আদ্ধেক কথা বলতে বলতেই সে একটা সিরিঞ্জে ডিস্টিল ওয়াটার নিয়ে ছেলের হাতে একটা সুই লাগিয়ে দিল আর ১০ টাকা নিয়ে নিল। দু দিন বাদে সেই গ্রাম্য লোকটি আবার ডাক্তারের কাছে এসে পেন্নাম ঠুকে বলল তুই খুব ভাল ডাক্তার রে, আমাকে সুই দিলি আর ঘরে বুড়ী মার জ্বরও নেমে গেল। তার কোন ব্যাথাও লাগল না। ভগবান তোর ভাল করুক। ঝড়ে কাগ মরল, আর ফকিরের কেরামতী বাড়ল।

আমাকেও এই ধরনের ডাক্তারের পাল্লায় পরতে হয়েছিল।  স্ত্রীর একটা দাঁত তোলানর দরকার পড়েছিল। তার দাঁতের একটু বিশেষত্ব ছিল যে তার রুট গুলো পাশের দিকে একটু বেঁকে থাকে। সেটা আমার জানা ছিল না। ডাক্তার প্রায় এক ঘন্টা ধরে ধ্বস্তাধস্তি করে দাঁত তো উপড়ে দিল। বাড়ি এসে দেখি রক্ত বন্ধ হচ্ছে না, আবার বিকেলেই তার কাছে নিয়ে হাজির।

এবার সিনিয়র ডাক্তার মাড়ীর অবস্থা দেখে বলে, একটু সেলাই দিয়ে দিচ্ছি। আর তার পরে আমার সামনেই সেই জুনিয়রকে প্রায় মারতে বাকী রাখে। এটা আমাকে একটু শিক্ষিত চেহারার দেখতে মনে হয়েছিল বলে হয়তো আমার জন্য করা হয়েছিল, নয়ত আবার সেই সেলাইএর সাথে আনুসঙ্গীক হিসাবে আরও কিছু তাঁকে গচ্চা দিতে হত।

টোটকা হিসাবে অল্প কাটাছেড়ার একটা ওষুধ যে মানুষের (নিজের) প্রস্রাব হতে পারে, সেটা আমি এই স্থানীয় লোকেদের কাছেই শিখলাম। আমার পুত্রদের নর্মাল বাচ্চাদের মতন রাস্তায় যা কিছু পাবে তাতে শট মারার অভ্যেস ছিল। একদিন আমার ট্রলীম্যানের সাথে অফিসের সহকর্মীর বাড়ী থেকে ফেরার পথে এই রকম শট মারার দৌলতে ছোট পুত্রের পায়ের  পাশে গেল অনেকটা কেটে। সেই ট্রলীম্যান আমার ছেলেকে বলে ঐ কাটার উপরে প্রস্রাব করতে। বাড়ী আসার পরে আমি দেখি রক্ত বন্ধ হয়ে গেছে। অবশ্যি আমি ধুয়ে ডেটল লাগিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু তার কাছেই শুনলাম যে ঐ টোটকা মহৌষধ প্রায়।

দুই ছেলের আরেক কীর্তির কথা না বললে ঠিক তাঁদের পরিচয় দেওয়া হবে না। বাবাকে দেখেছে ছোটখাট ইলেক্ট্রিকের কাজে কাউকে না ডেকে নিজেই ঠিক ঠাক করে নিতে। অতএব আমি অফিসে আর তাঁদের মা ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে ঘরে শুয়ে। এনারা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সুইচবোর্ডের সামনে গিয়ে ঠিক করলেন একটু পগিটিব (পজিটিভ) নেগেটিব খেলা যাক। ব্যাপারটা কিছুই নয়। একটা তার দিয়ে দেখেছে টেষ্টিং করার সময় পজিটিভ নেগেটিভ এক করলে স্পার্ক হয়, সেটাই তাঁরা করে দেখতে গেছিলেন।

একটা তার কোথাও থেকে জোগাড় করে, (ভাগ্যে সেটা ইন্সুল্টেড ছিল)  চেয়ারে চড়ে,( ভাগ্য সেটা কাঠের ছিল  ) প্লাগের দুই পিনের ফুটোতে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। বাস দড়াম করে আওয়াজ হয়ে ফিউজ উড়ে গেল আর এনারা চেয়ার শুদ্ধ হকচকিয়ে পপাত ধরণীতে। সামনের বাড়ির ভদ্রলোক দৌড়ে এসে টেনে তোলে, গিন্নী শোবার ঘরের থেকে বেড়িয়ে হাউ মাউ। আমাকে অফিস ফোন, আমি এসে বকুনী লাগিয়ে সব প্লাগ পয়েন্টের মুখ ব্ল্যাকটেপ দিয়ে বন্ধ করে রাখি। আর নয়ত তাতে যেটা চলে সেটাকে প্লাগটপ লাগিয়ে টেপ আটকে দিই যাতে খোলা না যায়।

বাঙ্গালীরা ভাতের সাথে যে তরকারী রান্না করি সেটাতে আলুর সাথে (আলু অতি অবশ্যি থাকবেই) অন্য একটা কি দুটো সব্জী নিয়ে রান্না হবে। ওখানের এক বাড়ির থেকে শেখা হল স্রেফ করলার তরকারী কি ভাবে রান্না করা যায়, যা দিয়ে ভাত মেখে খাওয়া যাবে। করলার গা একটু চেঁচে নিয়ে রাতে দইয়ের মধ্যে ফেলে দেওয়া হবে, টক দই, আর সকালে সেই করলা কেটে ঐ দইটা দিয়ে ঝোল ঝোল তরকারী। খেতে তেমন তিক্ততা থাকে না।

এতদিন আমার রান্না হত সরষের তেলে। প্রথম প্রথম ১৫ লিটার টিনের থেকে খুলে দোকান থেকে আনা হত। কিন্তু এই সময়ে সরষের তেলে শেয়ালকাঁটা ভেজালের সংখ্যা খুব বেড়ে উঠেছিল। বাধ্য হয়ে আমাকে ছোট সীলড টিনে চলে যেতে হল। নিতে শুরু করেলাম ইঞ্জিন মার্কা, কিন্তু তার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকায় বদল করে যেতে হন পোষ্টম্যান বাদাম তেলে। এই বাদাম তেলের রান্না তার পরে প্রায় প্রতি ঘরেই চলে এসেছিল তার কারণ ছিল সরষের তেলের বেশী দাম।

সাধারন দোকানপাট অধিকাংশই ছিল সিন্ধি রিফিউজী হয়ে যারা এসেছিলেন তাঁদের হাতে। পুর্ব পাকিস্তান থেকে যে সমস্ত বাস্তুহারা এসেছিলেন তাদের পুনর্বাসন করা হয়েছিল প্রধানত মধ্যপ্রদেশের বাস্তার এলাকা আর উড়িষ্যার কোরাপুট এলাকাতে। রায়পুরের কাছে ছিল অল্প দূরেই মানা।

এই মানাতে বিশ্বযুদ্ধের সময় রানওয়ে তৈরি হয়েছিল আর তার পাশে প্রচুর জায়গাতে তৈরী হয়েছিল এঁদের জন্য ট্রান্সিট ক্যাম্প। সেখান থেকে সুদূর পশ্চিম মধ্যপ্রদেশের রতলাম, নাগদা, উড়িষ্যার মাচকুন্ড, সুনাবেড়া এই সব জায়গাতে অল্প অল্প করে পরিবারদের পাঠান হত। অবশ্যি কতকগুলো জায়গাতে একসাথে অনেক পরিবারকেও পাঠান হয়েছিল যেমন উজ্জ্বয়িনী। কাজেই কৃষিজীবী বাঙ্গালী বাস্তুহারাদের হাতে কোন ব্যবসাই ছিলনা প্রায়।

এই জন্য প্রসঙ্গটা তুললাম, তার কারণ হচ্ছে এঁদের দোকানের সাজসজ্জা ছিল দেখবার মত। সাধারণ ভাবে যে সমস্ত দোকানগুলোতে চাল ডাল আটা ইত্যাদি বিক্রী হয় সেই সব দোকানেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখেছি মালপত্র গ্যালভানাইজড টিনের পাত্রে রাখা থাকত। অধিকাংশ মাল বাছাই করে পরিস্কার করে একটা চাকচিক্যময় চেহারা আনার চেষ্টা থাকত। এক দোকানির সাথে আমার এই নিয়ে কথা হয়েছিল যে এই যে বিজ্ঞাপনের দেখান জিনিষপত্রের মতন সাজানর চেষ্টা, তাতে যে খরচ হয় সেটা কি লোকের ঘাড় ভেঙ্গেই তোলা হয়।

তার উত্তর ছিল এই রকম। সেটা ঠিকই যে ক্রেতার মাথায় এর খরচ চাপবে, কিন্তু সব ক্রেতার উপরে নয়, কেননা তাহলে ক্রেতা কমে যাবে। যে জিনিষের চাহিদা বেশী, সেটা প্রায় সব দোকানেই পাওয়া যাবে। ক্রেতাকে আমার কাছে ডাকতে হবে বলে তাই তাতে দাম বিশেষ বাড়ান হবে না। আর অল্প বিক্রীর জিনিষে দামের বৃদ্ধির পরিমান বেশী হবে। আপনি আমার দোকানে চাল, ডাল আটা ইত্যাদি কম দামে নিয়ে পাচশ টাকা খরচ করলে, কি দশ টাকার এলাচ কেনার জন্য বিশ টাকা দেবেন না  অন্য দোকানে যাবেন? যুক্তিটা ঠিক বলেই আমার মনে হয়েছিল।

এই সময় আমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হল। আমি ছুটির দরখাস্ত দিয়ে দিলাম আর সেটা মঞ্জুর হয়েও গেল। ট্রেনের রিজার্ভেশন করা হয়েছে। বম্বে মেলে হাওড়া, আর তার পরে শেয়ালদহ থেকে শান্তিপুরে বাবার কাছে। বিয়ে গঙ্গার অপর পাড়ে, কালনাতে, মেয়ের দাদার বাড়ীতে।


যাবার ঠিক চার দিন আগে হঠাত ভিলাই রেলের ইঞ্জিন রিপেয়ারের কারখানাতে স্ট্রাইক। রেলের ভাষায় এমার্জেন্সী, সবার ছুটি সাস্পেন্ডেড। ষ্ট্রাইক মিটলে ছুটি পাওয়া যাবে।  দিন গোনা সুরু করেছি, কবে ষ্ট্রাইক উঠে যাবে। উঠেও গেল যে দিন আমার রওয়ানা হবার কথা সেই দিন দুপুরে। কিন্তু কর্তারা তো এত সহজে এমার্জেন্সী তুলবেন না। সেই এমার্জেন্সী উঠল সরকারী ভাবে বম্বে মেল ছাড়ার আরও এক ঘন্টা বাদে। আমার সব কিছু রেডি করেও ভাইয়ের বিয়েতে যাওয়া হল   না। তখন তো ঘরে ফোন নেই, তাই খবর দেবার জন্য চিঠি লেখা, আর সেটা পৌঁছতে দিন চারেক।

1 টি মন্তব্য: