এইখানে একটা কথা বলে নেওয়া ভাল হবে। দেশ স্বাধীন হবার
পরে সমস্ত রেল ব্যবস্থাটাকে উত্তর, দক্ষিণ, মধ্য এই রকম কয়েকটা অঞ্চলে ভাগে ভাগ
করে দেওয়া হয়েছিল, আর প্রত্যেক ভাগের জন্য একজন কর্তা (জেনারাল ম্যানেজার) এর উপরে
কাজ চালানর ভার দেওয়া হয়েছিল। বৈদ্যুতিকরণের কাজের ভার, যদিও এই সমস্ত রেলের
অঞ্চলগুলিতে হচ্ছিল তবুও এক আলাদা জেনারাল ম্যানেজারের উপরে দেওয়া হয়েছিল। তার
মানে দাড়িয়েছিল এক অস্থায়ী নতুন অঞ্চল তৈরী করা হল।
তাঁর মূল কারণ ছিল এর আগে রেলে বিদ্যুতের কাজ কর্ম খুব
কম। যেমন সমস্ত হাওড়া-নাগপুর-ওয়াল্টেয়ার এলাকার জন্য মাত্র একজন বিদ্যুৎ অভিযন্তা
(ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার) ছিলেন। সেখানে বর্তমান এই বিরাট যজ্ঞের জন্য অনেক
ইঞ্জিনিয়ারের দরকার পড়েছিল। ক্লার্ক, আর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের জন্য বিভাগীয়
রেলের লোকেদের ডেপুটেশনে নেওয়া হলেও বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য নতুন লোকের দরকার পড়েছিল
আর সেই লোক হলাম আমরা। সদ্য সদ্য কলেজ থেকে পাশ করে কাজে যোগ দিয়েছিলাম। আর কি
উৎসাহ ছিল কাজে।
৭১/৭২ সাল নাগাদ রেলের দিল্লী অফিসে দুই দলের টানাপড়েন
চলছিল। এক দল বলেন বৈদ্যুতিকরণ করা হোক, আর এক দলের মত হচ্ছে তাতে প্রাথমিক খরচ
অনেক হবে তাই আমরা কয়লার বদলে ডিজেল দিয়েই গাড়ী চালাব। ডিজেলওয়ালাদের বাড়বাড়ন্ত
তখন, যদিও ডিজেল মানেই আমেরিকার দ্বারস্থ হওয়া।
বৈদ্যুতিকরণের জেনারাল ম্যানেজারের পদ বিলুপ্ত করা হল। যেখানে যত
বৈদ্যুতিকরণের মালপত্র ছিল সেগুলো বাতিল করে গুদামে পাঠান চালু হল। আর গুদাম থেকে
তাদের কাবাড়িওয়ালার দরে বেচে দেওয়া হতে লাগল। যেহেতু ভবিষ্যতে আর বৈদ্যুতিকরণের
কাজ আর হবে না, তাই আগামী দিনের মালের বরাত সব বাতিল করা হতে লাগল।
পরে এই মালের অভাবই জাপানে লোহার আকর রপ্তানীর জন্য তৈরী
কে কে লাইন বৈদ্যুতিকরণ করতে পাঁচ বছরের মত অতিরিক্ত সময় লাগিয়েছে। এতদিন এটা
গর্বের বিষয় ছিল যে কোন বৈদ্যুতিকরণ প্রজেক্ট তার নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশী সময়
নেয় নি। রাউরকেলা- দূর্গ লাইনের কাজের সমাপ্তিও
নির্ধারিত দিনের এক দিন আগে হয়েছিল বলে আমরা সবাই আনন্দ করেছিলাম।
যাকগে, রেলের দিল্লী অফিসের সুমতি কিছুদিন বাদেই হওয়াতে
আজও এই কাজ হয়ে চলেছে আর সারা ভারতে এখন খুব অল্প জায়গা বাকী আছে ( ট্রাঙ্ক লাইন
বা প্রধান পথ) যেখানে বৈদ্যুতিকরণ হয় নি বা এখনও প্ল্যানে নেওয়া হয় নি।
৭২ সালে দূর্গ- বিলাসপুর খন্ডে বিদ্যুৎ সংযোগ হয়ে গেলে হাওড়া
থেকে একেবারে দূর্গ পর্যন্ত টানা বৈদ্যুতিক ট্রেন চলবার বন্দোবস্ত হয়ে গেল। সাথে
ভিলাইতে এই সমস্ত ইঞ্জিনগুলোর রক্ষণাবেক্ষনের জন্য শেড তৈরী হওয়াতে কোন অসুবিধা
রইল না। এখন শুরু হল যে সমস্ত দৈনিক বেতনভোগী কর্মচারী ছিল তাঁদের একটা গতি করার।
আগে যে দৈনিক বেতনভোগীদের ষ্ট্রাইকের কথা বলেছিলাম তাতে
কিছুটা সুফল দিয়েছিল। এই সমস্ত কর্মচারী
দের জন্য একটা স্ক্রীনিংয়ের বন্দোবস্ত করে তাঁদের বিভিন্ন খালি জায়গাতে নিয়োগের
বন্দোবস্ত করা হল। কিন্তু আমার নিগ্রহের
কথা কিন্তু বিভাগীয় কর্তারা ভোলেন নি। তাতে
যে তিনজন লোক সরাসরি যুক্ত ছিল তাঁদের বাতিল করে দেওয়া হল। কেন সেটা না
জানালেও আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় নি কেননা প্রাথমিক পরীক্ষা আমরাই
নিয়েছিলাম।
৭৩ সাল নাগাদ আমাকে রায়পুরের অফিস বন্ধ করার পরে নিয়ে
আসা হল বিলাসপুরে। সেখানেও কাজ শেষ হয়ে গেছে কিন্তু অফিস বিল্ডিং আর বাড়তি মালের
বন্দোবস্ত করা হয়নি। বিল্ডিং ভাঙ্গা হবে না অন্য কোন বিভাগকে হস্তান্তর করা হবে তা
ঠিক হয়নি। বিলাসপুরের অফিস আগে যেখানে রমরমা ছিল, সেখানে তখনকার অবস্থা টিম টিম
করছে।
বিলাসপুরে এসে প্রথম এক মাস আমাকে থাকতে হল টিকরাপাড়ায় এক
প্রাইভেট বাড়ীতে। পাড়াটা রেলের সীমানার গায়েই আর বাসিন্দাদের প্রায় শতকরা ৯৫
প্রতিশত লোকেরা রেলের কর্মচারী। দোতলার উপরে দুটো ঘর কিন্তু টয়লেট দোতলায় ঢোকবার
সিড়ির মাথায়। ঘরের পেছন দিকে এক খোলা বারান্দা। আমার বন্ধু এসে দেখে বলে দিল, “এই বারান্দার
দরজা তালা দিয়ে রাখ, কেননা তোমার যা শান্ত ছেলে মেয়ে তারা যে কি করবে সেটা ঠিক নেই”।
কলকাতায় মানুষ আর তার পরে চাকরী সুত্রে যে সব জায়গাতে
থাকলাম, সেখানে অফিস আর বাড়ীর মধ্যে দূরত্ব অল্পই থাকত। কিন্তু টিকরাপাড়া থেকে
আমার অফিসের দূরত্ব একটু বেশি মনে হতে লাগতে লাগল। অতএব সাইকেল শেখার দরকার। আমার
বহুদিনের সহকর্মী সাইকেলের সাথে দৌড়ে দৌড়ে প্রায় ঘন্টা দেড়েক বাদে যখন মনে করল যে আমার
ব্যালান্স একটু হয়েছে, তখন সে হঠাত বলে, আমি বাড়ী যাচ্ছি, তুই সাইকেল চালিয়ে আয়।
তখনো একটা উচু জায়গা পেলে সেখান থেকে সাইকেলে উঠি আর নামাটা
তখনও রপ্ত হয়নি। কিন্তু কি করা যায়। কোন রকমে
চেচিয়ে লোকেদের সাবধান করতে করতে গিয়ে পৌঁছলাম। দেখি বন্ধুবর দাড়িয়ে আছেন দরজাতে।
হাসি মুখ, বলে দেখলি তো তোর সাহসটাই হচ্ছিল না। এরপর কি ভাবে উঠতে আর নামতে হয় সেটা
শিখতে আর কটা দিন লাগবে। মানে ৪২ বছর বয়সে আমি সাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্স, তাও লার্ণিং লাইসেন্স পেলাম। অবশ্যি
পাক্কা লাইসেন্স পেতে আর দিন পনের লেগেছিল।
আমি বিলাসপুরে এলাম ৭৩ সালে আর ৭৪ সালের মে মাসে হল আবার
স্ট্রাইক। আমার অফিসে অবশ্যি এবারও কিছু আঁচ পড়েনি। আমার অফিসে ষ্টাফ বলতে তখন
ক্লার্ক একজন আর টেকনিকাল ষ্টাফ মাত্র দুজন, বাকী জন দশের মতন দৈনিক বেতনভোগী
খালাসী। ডিষ্ট্রিক্ট অফিস থেকে ফরমান পেলাম কেউ সকালে হাজিরা ঠিক সময়ে না দিলে তার
নাম লিষ্ট করে পাঠান চাই।
কাজের পাট যেখানে বন্ধ করার মুখে, সেখানে ঠিক সময়ে আর কে
আসে। কিন্তু আমার মন তো তাদের নাম পাঠাতে রাজী হয় না, কারণ দৈনিক বেতনভোগীদের তো
এক কথায় ছাঁটাই করা হবে। কি দরকার, তাই লিস্টে অল প্রেজেন্ট করে খবর পাঠান হল। কিন্তু
আমাদের ডিষ্ট্রিক্ট অফিসে দুজন হেড ক্লার্ক ষ্ট্রাইকে যোগ দেওয়াতে, তাদের চাকরীতে
ব্রেক দেখান হল। পরে অবশ্যি সে সব ঠিক করে নেওয়া হয়েছিল।
এই স্ট্রাইক সম্বন্ধে একটা জিনিষ মনে রাখতে হবে। যে
আমাদের বৈদ্যুতিকরণ অফিসে দুধরণের কর্মী ছিলেন। এক আমাদের মতন লোক যারা সদ্য সদ্য
কাজে যোগ দিয়েছে ( ১৯৫৮ সালের থেকেই আমাদের নিয়োগ করা শুরু হয়), আর অন্য দল
হল যারা আগে থাকতে কোন বিভাগীয় অফিসে কাজ
করছিলেন, একটা প্রমোশন নিয়ে ডেপুটেশনে কাজে এসেছিলন।
কাজে কাজেই কোন ইউনিয়নের বালাই ছিল না, আর যেহেতু ইউনিয়ন
নেই তাই কোন নেতাও তৈরী হয়নি। অতএব ৬০ সালের মতন এবারও বৈদ্যুতিকরণে কোন ষ্ট্রাইক
হয়নি। দু একজন তাঁদের নিজস্ব বিশ্বাসে ষ্ট্রাইক করেছিলেন। তাই বৈদ্যুতিকরণ বিভাগে
কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ( মানে জেলে পাঠান ইত্যাদি,) নেওয়া হয়নি।
দুই ছেলে রেলের প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হল। আর মেয়ে গেল
বাড়ীর পাশেই এক মহিলার বাড়ীতে প্লে স্কুলের মতন ছিল সেখানে। কোয়ার্টার রায়পুরে যে
রকম পেয়েছিলাম সেই রকমই, খালি এবার সাথে অনেকটা জমি থাকায় কিচেন গার্ডেন করতে
পেরেছিলাম। আমার আগে সে সহকর্মী ছিলেম ওখানে তিনি ঐ জমিতে অড়হরের চাষ করেছিলেন।
আমি এবার লাগালাম মুলো আর ঢেড়স। একটু কপিও।
আমার ছেলেরা আমার মতন বাঁদর হবে এটা জানাই ছিল, তবুও তাঁর
নিদর্শন দিতে ছোট ছেলে তার টীচারের সাথে একদিন তর্ক জুড়ে দিল ওয়ান হান্ড্রেড ওয়ান
লেখার জন্য কেন একের পরে দুটো শূন্য দিয়ে একশ বানিয়ে তার পাশে এক লেখা হবে না। “টীচার মিস,
তুমি ভুল শেখাচ্ছ। আমি বাবাকে বলে দেব”। মিস তো আমাকে বলে আর
হাসে। অবশ্যি ছেলের যুক্তি একেবারে ঠিক, কেননা যখন বলছে হান্ড্রেড এন্ড ওয়ান, মানে
একশ আর এক, তাই সেটা ঐ ভাবেই লিখতে হবে
তো। বাড়ী ফিরে আমাকে নিরানব্বই থেকে লিখে লিখে বোঝাতে হল। মনে অবশ্যি পড়েছিল আমার
ট্রান্সলেশনে ‘তাহার আছে’ কেন his has হবেনা নিয়ে
তর্ক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন