শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৪

গঙ্গাসাগর মেলার সূত্রপাত


সূর্যের পুত্র মনু। মনুর ছেলের মধ্যে ছিল এক জন ছিল নাম তার ইক্ষাকু। আর ছিল এক মেয়ে, নাম তার ইলা। এই ইলার সাথে বিয়ে হয় চন্দ্রের ছেলের। হয়ে গেল বিখ্যাত সূর্য বংশ আর চন্দ্র বংশের প্রতিষ্ঠা। দশরথের ছেলে রাম ছিল এই সূর্য বংশের। কিন্তু তার আগে আমরা পাই এই সূর্য বংশে এক সাগর রাজাকে। সাগরের দুই বৌ। প্রভা আর ভানুমতী। দুজনেই সন্তান কামনাতে পূজা আচ্চা করতে লাগলে তাদের জিজ্ঞাসা করা হয় যে তোমাদের কি চাই বল। একজনের ৬০ হাজার ছেলে হবে, যারা করিতকর্মা হবে, আর আর একজনের একটি মাত্র ছেলে হবে কিন্তু তার প্রজন্মের নাম বিশ্ববিদিত হবে।

প্রভা ভেবে দেখল, তার যদি ৬০০০০ ছেলে হয় তবে তার সুবিধাই হচ্ছে কেননা তাঁরা  সব করিতকর্মা হবে বলা হচ্ছে। আর তা না হলে এক ছেলের পরে কোন প্রজন্মের ছেলের নাম সারা বিশ্বে জানবে সেটা কে জানে ।তাই সে  বলে দিলে তার ঐ ষাট হাজার ছেলের মা হওয়া মঞ্জুর। আর ওদিকে ভানুমতির একটাই ছেলে হল, নাম তার অসমঞ্জ। এই অসমঞ্জ ছিল কিন্তু অত্যন্ত অত্যাচারী। তার একটা সখ ছিল নবজাত শিশুদের ধরে নদীতে ছুড়ে ফেলা যাতে তারা ডুবে মারা যায়। এই অসমঞ্জের পরে আমরা যদি সপ্তদশ পুরুষে যাই, তবে আমরা পাব রাজা রাম কে।

সাগর রাজা যখন ঠিক করল, সে অশ্বমেধ যজ্ঞ করবে তখন তার অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া গিয়ে বাঁধা পড়ল কপিল মুনির আশ্রমে। সাগর রেগে কাই, ঘোড়া খুঁজে না বার করলে তো যজ্ঞ শুরুই হবে না। তাই হুকুম দিল তার ছেলেদের, যা খুঁজে আন ঘোড়াটাকে। বাবার হুকুম অমান্য হবে না, তাই ষাট হাজার ছেলে (প্রভার ষাট হাজার ছেলে ছিল। কেউ যমজ না হলে প্রভাকে কতদিন বেঁচে থাকতে হয়েছে সেটা কেউ হিসাব করতে পারবেন কি? আর সেই অনুযায়ী সাগর রাজাও, কেননা তার আর একটি স্ত্রীও ছিল ভানুমতী, যার মাত্র একটি ছেলে হয়েছিল) হারে রে করে বন জঙ্গল পুড়িয়ে দিয়ে দৌড়ল ঘোড়া খুজতে।

এক জায়গাতে গিয়ে দেখে এক বুড়ো বসে তপস্যা করছে। আর তার পাশে একটা খুটীতে ঘোড়াটা বাঁধা আছে। কোন রাজা ধরলে তাও কথা ছিল, কেননা তাঁদের মধ্যে রেষারেষী হতে পারে, যার ফলে ঘোড়াকে আটকে রাখার চিন্তা হলেও হতে পারে। কিন্তু এক সাধু বাবা কেন ঘোড়া বেঁধে রাখবে।  নিশ্চয় ঘোড়াটাকে কিছু ভাবে বশ করে বেধে রেখেছে, যদি বদলে কিছু পাওয়া যায়। কিছু গালাগাল আর হাত পা চালানোর পরে সাধুবাবা তো জেগে উঠলেন আর সাথে সাথে তার রক্ত চক্ষু। তার থেকে বেরিয়ে এল আগুন। অবশ্যি সাধুবাবা কিন্তু ড্রাগন ছিলেন না। নাম  ছিল তার কপিল।
 
গেল সাগর রাজার ষাট হাজার ছেলে পুড়ে ছাই হয়ে। রাজার যজ্ঞ রইল অসমাপ্ত। সাগরের নাতি, অসমঞ্জের ছেলে অংশুমান যখন তার জেষ্ঠতাতদের খুজতে খুজতে গিয়ে কপিলের আশ্রমে হাজির হল, তখন কপিল তাঁকে বলল হ্যাঁরে বাপ, তাঁদের তো আমি ছাই করে ফেলেছি । অংশুমান জিজ্ঞেস করে উপায় কি হবে তবে । কপিল বলে যাও গিয়ে গঙ্গাকে নিয়ে এস। তাহলে তাদের ছাইগুলো ধুয়ে গেলে তোমার জ্যেঠারা মুক্তি পাবে। মানে সোজা ভাষায় তাঁরা আমার আশ্রমে নোংরা করে ফেলেছে, তুমি জল দিয়ে জায়গাটা ধুয়ে পরিস্কার করে দাও। আমি তবে তাঁদের ছেড়ে দেব।  অংশুমান গেল ফেরত, গঙ্গা কোথায় ইত্যাদির খোঁজ খবর নিয়ে তাঁকে নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করতে।

কিন্তু গঙ্গাকে নিয়ে আসা কি সোজা কথা। গঙ্গা থাকে আকাশে। তখনকার দিনে আকাশেও থাকার বন্দোবস্ত ছিল নিশ্চয়ই।  তাঁকে পৃথিবীতে নামাতে হবে, আর তার পরে সেই কপিল মুনির আশ্রম পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। চাট্টী খানি কথা নয়। কেউ পারে না। টাকার পর টাকা খরচ হয়ে যায়, আর এক প্রজন্মের পরে আরেক প্রজন্ম আসে, কিন্তু নো সল্যুশন। রাজ্য প্রায় ধ্বংস হবার উপক্রম। কোন রকমে টিকে ছিল কিন্তু গঙ্গাকে কপিল মুনির আশ্রম পর্যন্ত নিয়ে যাবার জেদ তাঁরা ছাড়েনি।

ভগীরথ যখন জন্মাল তখন কোশল রাজার আর বিশেষ কিছু আভিজাত্য নেই। তাছাড়া বাপ মরা ছেলে, মা তাঁকে মানুষ করে তুলেছে। কিন্তু তার মনে আছে যে কোশল রাজ্যের এত টাকা খালি গঙ্গাকে কপিলের আশ্রমে নিয়া যাবার জন্যেই নষ্ট হয়েছে। এঈ কাজটা তাঁকে শেষ করতেই হবে।  শুরু করল হাইড্রলিক্স আর জিওগ্রাফীর পাঠ নিতে। অনেক হিসাব নিকেষ করে দেখা গেল কৈলাস পর্বতের উপরে যদি গঙ্গাকে নামান যায় তবে তার পতনের বেগটা আটকান যাবে। মানে অত উচু থেকে নামলে তো পড়বার ধাক্কাটা তো অনেক জোরেই হবে।

এখন কৈলাস পর্বতে থাকতেন শিব। গাঁজা গুলি ভাঙ্গ খেয়ে, গায়ে  ইমমিউনিটি হয়ে গেছে। তার কাছে নিবেদন করা হল আপনি যদি গঙ্গাকে একটু ধরে বেঁধে রাখতে পারেন তবে আমি তাঁকে নামাতে পারি। নয়তো তাকে  যেখানে নামাব সেখানেই এক পাতাল পর্যন্ত গভীর গর্ত হয় যাবে। শিব রাজী। বলে আমার মাথায় যে জটা আছে  তার উপরে নামাতে পার।

এবার গঙ্গাকে তো এক লাফ তো মারতে হয় ভগীরথের জন্য। আর লাফ মারা মাত্রই পড়ল এসে ঐ জটার মধ্যে। আর পড়া মাত্রই গেল জটার মাঝে আটকে। সেই কবেকার ধুলো আর ছাই দিয়ে সযতনে বানানো জটা। সে এক অন্তহীন ধাঁধার মত জট। শেষকালে গঙ্গা পেল সাতটা রাস্তা। তিনটে পশ্চিম দিক দিয়ে, সেখান দিয়ে বার হবার পরে তাঁদের নাম হল সিন্ধু ইত্যাদি। তিনটে রাস্তা পেল পূর্ব দিক দিয়ে। তাঁরা হল  ব্রহ্মপুত্র ইত্যাদি। আর শেষ কালে বার হল গঙ্গা দক্ষিন দিক দিয়ে।

কিন্তু গঙ্গার দুষ্টুমি বা চপলতা এখনো শেষ হয় নি। নেমেই দেখা গেল সামনে জহ্ণু মুনির আশ্রম। বলে এটাই মনে হচ্ছে কপিলার আশ্রম,  দিই এটাকে ধুয়ে, তাহলে আর আগে এগোতে হয় না। জহ্ণু মুনি ব্যপার দেখে অবাক, বলা নেই কথা নেই এসে সারা আশ্রমে জলে কাদা করে দিচ্ছে। এটাকে তো একটু শিক্ষা দিতে হয়। বলে সেই জলে মারলেন এক চুমুক।  যত জল জটা থেকে নীচে নামে, সব জহ্নুর মুখ দিয়ে পেটের মধ্যে চলে যায়।গঙ্গাকে আর দেখতে পাওয়া যায় না।

ভগীরথ দেখে মহা বিপদ। দু হাত জোড় করে জহ্নু মুনিকে বলে, গুরুদেব। আপনি এত জল একসাথে পান করে গঙ্গাকে আপনার পেটের ভেতরে নিয়ে নিলে, আমার পূর্বপুরুষেরা উদ্ধার পাবে কি করে। এই গঙ্গার জল তো কপিলের আশ্রম পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। কথা শুনে জহ্নু মুনি বলে তাই নাকি। ঠিক আছে। এই বলে পুচুৎ করে গঙ্গাকে বার করে দিলেন।

ভগীরথের কাছে ম্যাপ তৈরী করাই ছিল। সে সেই রাস্তা দেখিয়ে গঙ্গাকে নিয়ে যাওয়া সুরু করলেন। সেই গোমুখ থেকে হরিদ্বার, সেখান থেকে কাশী। তার পরে নবদ্বীপ হয়ে কপিলের আশ্রম। ঠিক জানা নেই কতদিন বা কত ঘন্টা লেগেছিল কপিলমুনির আশ্রমে গঙ্গার পৌছতে। কিন্তু পৌঁছে গেলেন।  আশ্রম ধোয়া হল। প্রভার ছেলেরা এত দিনে মারা গেছে তাই তাঁরা সোজা স্বর্গের দিকে রওয়ানা দিলেন। শেষ পর্যন্ত মনে হয় সাগর রাজার সেই অশ্বমেধ যজ্ঞ আর হয়নি, কিন্তু সেই থেকে প্রত্যেক বছর  কপিল মুনির আশ্রমে গঙ্গাসাগর মেলা হচ্ছে।


1 টি মন্তব্য: