পুজার মেজাজটা খুবই
খিচড়ে আছে। বাড়ী থেকে বেরোনর সময় কানে ছিল মোবাইলের ইয়ারপ্লাগটা গোঁজা আর চোখটা ছিল
স্ক্রীনের উপর। রাস্তার কোণের উঁচু পাথরটার কথা একেবারেই মনে ছিলনা। লাগলো এক
হোঁচট। অন্য দিন ওটার কথা খেয়াল থাকে। আজকে মেজাজ ঠিক নেই বলে ওটার কথা মাথা থেকে
বেড়িয়েই গেছিল। চটির স্ট্র্যাপটা একেবারে আলগা হয়ে গেছে। অনেক হাটার কথা আছে আজ,
কাজে কাজেই এই চটিটা দিয়ে সেটা চলবে না। বাড়ী ফিরে চটিটা বদলাতেই হবে। তার মানে
আটটা ছাব্বিশ ধরা যাবে না। তাড়াতাড়ি বাড়ীতে ফিরে চটিটা
পালটে প্রায় দৌড়ে খড়ুয়া বাজার। বাসটা ধরে যখন স্টেশনে পৌঁছল তখন আটটা ছাপ্পান্নর
গ্যালপিঙ্গটার লাইন হয়ে গেছে। একটু হাফ ছেড়ে বাঁচল।
অশোকের সাথে হাওড়াতে বড় ঘড়িটার
নীচে মিট করার প্রোগ্রাম আছে। ওখান থেকে দুজনে জু তার পর ভেবে দেখার কথা। বাবু তো
একটু দেরী হলেই ঘন ঘন ঘড়ি দেখেন আর মেজাজের পারাটাকে ক্রমশঃ উঁচু করতে থাকেন। বাড়ী
থেকে বেরোনর সময় মাকে বলেছিল “ তুমি একটু বাবাকে ম্যানেজ করে নিও। আজ একটু
ফিরতে দেরী হবে”। মা তার ফ্রেন্ড,
অশোকের কথাটা পূরোপূরী না হলেও বেশ কিছুটা জানেন আর বাকীটা তো মার গুন যে ঠিক
বুঝতে পেরে যায়।
এমনিতে অশোক ভাল ছেলে।
আপাততঃ সল্ট লেকের এক কলসেন্টারে কাজ
করছে। হায়দ্রাবাদে একটা ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছে। সিলেক্টেড। দুমাস বাদে জয়েন করতে
হবে। চন্দননগরের পাদ্রীপাড়াতে থাকে।যখন অসক হায়দ্রাবাদ চলে যাবে সে সময়টার কথা
পুজা এখনও চিন্তা করেনা। এখন তার সময় কাটে দিনে কলেজে অশোকের সাথে টেক্সটিং করে।
ফাঁক পেলে কথাও বলা যায় কিন্তু তার সময়ের অভাব। কলেজে পড়াওত করতে হবে। ওদিকে রাতে
বাড়ীতে যে ফোনে কথা বলবে তার উপায় নেই । সব সময় তাড়া শুয়ে পড়।
ওদিকে কাল রাতে হটাত
অশোকের ফোন। এদিক থেকে হা হু ছাড়া কথা বলার উপায় নেই। আর ওদিকে উনি অর্ডার করে
বসলেন কলেজ যেতে হবে না। আজ ওনার ছুটি। কলকাতায় একটু ঘুরতে বার হবেন। বেড়ে মজা, ওনার
না হয় পড়া নেই কিন্তু আমাকে তো পাশ করতে হবে। ও যেন ধরে নিয়েছে যে এ বাড়ীতে জামাই
হয়ে আসছেন এটা কনফার্মড। মাঝে মাঝে গান গায় “লে যায়েঙ্গে লে
যায়েঙ্গে, দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে। নিজেকে শারুখ খান মনে করে। জানে না তো
আমার বাবা কাজলের বাবার চেয়েও রাগী।
যতক্ষণ পুজা ট্রেনে হাওড়া পৌচচ্ছে, ততক্ষণে আমরা দেখে নিই
আমাদের শ্রীমান অশোক কি করছেন। পূজার তো হাওড়া পৌছতে এক ঘন্টার মতন লাগবে, অবশ্যি
যদি না ট্রেন লেট করে। আজকাল তো কারশেডের সামনে মিনিট পাঁচেক দাড়ান নিয়ম হয়ে গেছে।
টাইম টেবলে ওটাকে হাওড়া আর লিলুয়ার মাঝে হালুয়া বলে হল্ট করে দিতে অসুবিধা কোথায়।
অশোক হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে পৌনে দশটা বাজে।
কথামত আটটা ছাব্বিশের ট্রেনটা ধরলে এতক্ষণে দেখা দেওয়ার কথা। একগাল হাসির সাথে
বত্রিশটা না হলেও সামনের কটা দাঁত বার করে বলে দিত আমি কিন্তু আজ রাইট টাইমে
এসেছি। মনে মনে গুন গুন করে গাইতে থাকে আচ্ছা তো হম চলতে হ্যাঁয়। দেখা যাক পরের ট্রেনের
জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ফোন করতে অসুবিধা
আছে কেননা যদি বাড়িতে থাকে তবে বাবার সামনে পড়ার ভয় আছে।
পূজার সাথে আলাপ বা
পরিচয়ের শুরুটা ওদের কলেজের ফ্রেশার্স মীটে। একটা পার্পল কালারের সালোয়ার স্যুট
পড়ে এসে, ফার্ষ্ট ইয়ারের ছিপছিপে চেহারার মেয়েটা, শ্রীদেবীর মিষ্টার ইন্ডিয়ার টিপ
টিপ বরষা পানি গানের সাথে নেচেছিল। পানিমে আগ না লাগালেও অশোকের দিলে আগ তো
লাগিয়েই দিয়েছিল। মানে এক কথায় লাভ এট ফার্ষ্ট সাইট।
তার পরে ধীরে ধীরে
নোটসএর আদান প্রদান, ক্যান্টিনে চোখের ভাষার
ইঙ্গিত। সব কিছু সিনেমার স্ক্রিপ্টের মাফিক চলে যাচ্ছিল। দেখতে দেখত তিনটে বছরে তাদের মনের ভাব ঘন হয়ে
উঠছিল। সেটা জমে ক্ষীর না হলেও এখনকার অবস্থাটা রাবড়ীর ষ্টেজে পৌঁছেছে।
এ নিয়ে অশোকের
সহপাঠিনীদের মধ্যে একটা রাগ ছিল। তাদের হারিয়ে দিয়ে একটা জুনিয়র কিনা অশোককে কব্জা
করে নিল। বছর তিনেক আগে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের অ্যাকসিডেন্টে বাবা মা দুজনেই গত
হয়েছেন। তার মনের জ্বালাটা এখনও এত বেশি যে আজো যদি কোন মাওবাদী বা তাদের সহযোগী
পিসিপিএ গ্রুপের লোককে কাছে পায় তবে তাকে ও ছিড়ে খেয়ে নেবে। বাবা মার শেষ কাজটাও
ওরা করতে পারেনি। বডি সনাক্ত করতে পারা যায়নি। যে কোচে ওনারা ছিলেন তার থেকে একজনও
বাঁচে নি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন