ভাবনা পর্ব – ২
সকাল বেলায় অফিস যাবার মুখে সন্টু প্রায় নাচতে নাচতে এসে
বলল “ জান মা, বাবা লাইনে যাবার আগে আমাকে বলছিল, এই শুক্কুরবার ঠাম্মার কাছে আমরা
যাব। জান বাবা বলছিল, ঠাম্মা আমাদের অনেক করে দেখতে চেয়েছে। কি মজা। ঠাম্মার ওখানে
তালশাঁস ভাল পাওয়া যায়। কি মিষ্টি খেতে।“
খবরটা শুনে
মেজাজটা অনেক কষ্টে ঠিক করা গেল। শ্বাশুড়ীমা এমনিতে ভাল, কিন্তু ওঁর ঐ ছোঁয়াচ মানামানীর
জন্য ভীষন অসুবিধা হয়। সকাল বেলা উঠে বাসী কাপড় না ছেড়ে রান্না ঘরে যাওয়া যাবে না।
এই সব। তাছাড়া ঐ সময় কদিনতো উনি আমার
ছোঁয়াও খাবেন না। রাতে বিমল ফিরলে কথা বলতে হবে।
বিমলের স্ত্রী
শোভা। দুই ছেলে। তাদের
বয়স সাড়ে সাত আর ছয়। এর পরেই শোভা অপারেশন করিয়ে নিয়েছে। ঐ পিল খেলে শুনেছে ও মোটা হয়ে যাবে। বডি ফিট রাখতে জিমে রোজ যেতে হয়।
মাস গেলে তিন হাজার টাকা চাঁদা। টাকাটা গায়ে লাগলেও, যখন বিমলের বন্ধুরা তাকে দেখে
এঞ্চান্টেড হয়েছে বোঝাতে চায়, তখন তার খুবই ভাল লাগে। দুজনের মাসে রোজগার কিছু না
হলেও হাজার পঞ্চাশের মতন। বাড়ী ভাড়া দিতে হয় না। বিমলের কোম্পানির কোয়ার্টার,
কিন্তু ছেলেদের স্কুলের মাইনে, টিউশন, নিজের আর বিমলের গাড়ীর তেলের খরচ এই সব
দেওয়ার পরে খুব অল্পই বেঁচে থাকে। এর উপরে রিটায়ারমেন্টের আগে একটা মাথা গোঁজার
জায়গা তো কেনার ব্যবস্থাও করতে হবে। তাছাড়া ওখানে যাওয়া মানেই নগদ কিছু খরচ।
শ্বশুর মশাই রিটায়ার করার পরে হাতে প্রভিডেন্ট ফান্ডের যা টাকা পেয়েছিলেন, তার প্রায়
সমস্তটাই শ্বাশুড়ীমার চিকিৎসাতেই শেষ হয়েছে। বিমলকে মাঝে মাঝেই কিছু টাকা পাঠাতে
হয়। এটা নিয়ে শোভার মনে একটা ক্ষোভ রয়ে গেছে।
সারা দিনটা
টেনশনের মধ্যে কাটল। অফিসের কাজে মন লাগানোর মতন মনের অবস্থা হল না। দুবার বেশী
করে চিনি দিয়ে ব্ল্যাক কফি খেয়েও সে একই অবস্থা। সন্ধে বেলা বাড়ী ফিরে মাইক্রোতে
ভাতটা বসিয়ে দেবার আগে আরও এক কাপ কফি খেয়ে নিল। মাথাটা বেশ ভাল করেই ধরে আছে। বিমলকে
বললেই তার প্রেসক্রিপশন হবে একটা ছোট করে লাইমের সাথে জিন টনিক নেবার। সব সময় শোভার
ওগুলো পছন্দ নয়। গন্ধ লাগা বা নেশা হবার জন্য নয়। ওগুলো খেলেই তো চর্বি জমে যেতে
শুরু হবে। পার্টীতে গেলে পরে হাতে নিতেই হয়, আর তার পর সিপ করলে যে খারাপ লাগে তা
তো নয়। সকালে চিকেন বানিয়েছিল তার একটা পোর্শন আলাদা করে ফ্রিজে রাখা ছিল। সেটাকে
গরম করে নিলেই হয়ে যাবে। খাবার সময় বিশেষ কোন কথা হল না। শোভার কম খাওয়া দেখে
বিমলের জিজ্ঞেস করলে শোভা মাথা ধরেছে বলে দিল।
ছেলেরা শুয়ে পড়লে শোভা ওদের
ঘরের আলো নিভিয়ে গুডনাইট বলে নিজের শোবার ঘরে চলে গেল। বিমলের পাশে শুয়ে পড়ে গায়ের
চাদরটা টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, " তুমি কি মার কাছে যাবার প্ল্যান করছ
নাকি।" "হু। মানে আসছে সপ্তাহের
শুক্কুরবার ছুটি আছে। তার সাথে শনি রবি মিলিয়ে তিন দিন হয়ে যাবে। তাইই। তুমি কি
করে জানলে? আমি তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেব ভাবছিলাম।"
"সারপ্রাইজ। আর সারপ্রাইজ
দেবার দরকার নেই। এদিকে আমাকে সারপ্রাইজ দেবে আর ওদিকে সন্টুকে তো বলেছ। তার মানে
আমাকে বলার দরকার মনে করনি" । একটু
থামার পরে আবার, " তাছাড়া, ওখানে
যাওয়া মানে কত এক্সট্রা খরচ তা শর্মা হিসেব করেছেন কি? যাতায়াতের খরচ বাদ দিয়ে
ওখানে গেলেই তো মাকে কিছু দিতে হবে। বাবাকে অনেক দিন তুমি টাকা পাঠাচ্ছো না।
অবশ্যি আমার ডিমান্ডগুলো মেটানোর পরে তোমার কাছে আর কিছু বাঁচছেও না। মানে প্রায়
হাজার দশেকের মতন খরচ হবে । কোত্থেকে আসবে শুনি? আমার কাছে হাত পাতলেও কিছু এবার পাচ্ছনা।
এবার আমাদের কিটি পার্টীতে অনেক খরচ।"
"ওসব চিন্তাতো তোমার নয়।
এবার আর তোমার কাছে হাত পাতবোনা। তখন গাড়ির ডাউন পেমেন্টের জন্য দরকার পড়েছিল। আর তাছাড়া তো
এখনও ফাইনাল কিছু করিনি। ছুটি আছে তাই। ছেলে দুটো তাদের ঠাম্মার কাছে যাবে বলে
প্রত্যেক ছুটির সময়ই বায়না ধরে।" হু, বলে শোভা পাশ ফিরে শুল। বোঝা গেল এতে তার
সম্মতি নেই। এমনিতে শ্বাশুড়ী এলে তাকে যত্ন আত্তি করতে শোভার কোন কষ্ট নেই। সেটা
গায়ের শক্তির ব্যপার আর এখন এটা নগদ টাকার কথা। বিমল ভাবতে শুরু করলো কি ভাবে
ম্যানেজ হবে। মাও বেশ কিছু দিন থেকেই ফোনে বলেন 'বাবার শরীরটা আর ভাল যাচ্ছে না,
আমিও আর পেরে উঠছি না'। কিন্তু যদি বলি আমার এখানে চলে এসনা, তখনি নানান অজুহাত
দেখান শুরু করেন। রাতে দুজনেরই ভাল করে ঘুম হল না।
পরের দিন দুজনেই তাদের নিজের
ইচ্ছে থেকে নড়বার কোন চেষ্টা দেখাল না। কিন্তু এই নিয়ে কোন ঝগড়া বা কথা কাটাকাটী
হলনা। একেবার কোল্ড ওয়ার। সন্ধে বেলায়
বিমল ফিরে দেখে শোভা আগেই এসে গেছে আর বেশ খুসী খুসী ভাব দেখাচ্ছে। "কি
ব্যপার ডার্লিং? আজ কি কোন সুখবর শোনাবে। অবশ্যি সে তো বছর ছয়েক আগেই শোনানর
রাস্তা বন্ধ কর দিয়েছ।" বিমলের মনের গোপনে তার মেয়ে পাওয়ার ইচ্ছেটা প্রকাশ পেয়ে
গেল। "না সুখবর নয়। র্যাদার তোমার কাছে খারাপ খবর। আমার এই শুক্কুরবার থেকে
মানেজমেন্ট ট্রেইনিং নিতে দিল্লী যেতে হবে। সো, দা প্রোগ্রাম অফ গোইং টু মাম্মী হ্যাস
টু বি ক্যানসেল্ড। আই অ্যাম সো সরি ডার্লিং। তোমায় ক'দিন একা থাকতে হবে"। "নাথিং টু বদার। ইন ফ্যাক্ট আমিও ভাবছিলাম
তোমার ওখানে কাজ করতে অনেক অসুবিধা হয়। ফ্রিজ, মাইক্রো নেই, সেই গ্যাসের চুলা। তাই
আমিও প্রোগ্রামটা ক্যানসেল করেছি। সন্টুদের বুঝিয়ে বোললেই হবে"। দুজনের এমন
ভাব দেখাল যেন তারা অন্যের প্রতি কত চিন্তাশীল।
সন্টুদের তাদের ঠাম্মার কাছে
যাওয়া হল না। ঠাম্মার তার নাতিদের আদর করা হল না। দুই প্রাপ্তবয়স্ক এমন ভাব দেখাল
তারা কত বিবেচক। সত্যি কি তাই। আপনারা কি বলেন?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন