শিমরণ এবং আবির্ভাবের ভাবনা
সিমরণ আর আবির্ভাবের প্রেমের বয়স মনে হয়
বছর দেড়েকের হবে। অবশ্যি এর আগে কলেজে পড়ার সময় ওরা নিশ্চয়ই প্রেম করেছে তবে একে
অন্যকে নয়। তখনকার প্রেম ছিল চোখের দেখার প্রেম, যেটা কলেজের পড়া শেষ করে নিজের
নিজের রাস্তা আলাদা হবার পরে আস্তে আস্তে শুখিয়ে গেছে। দুজনে একই অফিসে চাকরী করে।
সারা দিনে একসাথে থেকে কাজ করায় ধীরে ধীরে ওদের মনে আবার প্রেমের কলি বিকশিত হয়ে
উঠতে শুরু হয়েছ। এখন ওদের প্রেমের অবস্থাটা কিছুটা জমে উঠেছে, জমে কন্ডেন্সড মিল্ক
না হলেও রাবড়ির কন্সিষ্টেন্সিতে পৌঁছে গেছে। অফিসের শেষে সোজা বাড়ির দিকে
রওয়ানা না হয়ে, কোনদিন কোলাবা কজওয়েতে উইন্ডো শপিং, বা কোনদিন ফ্যাশন মার্কেটে
লাকোস্টে বা প্রভোগের জামাকাপড়ের দরদামকরে কেনা, যদিও ওরা জানে যে এগুলো অরিজিনাল
নয়। কোনদিনও ওরা হাটতে হাটতে গিরগাও চৌপাটিতে ঘুরে আসা। আর তার পরে লোকাল ধরে নিজ
নিকেতনে। হার্বার লাইনের ট্রেনেও ওরা একসাথেই যায় কেননা আবির্ভাব যায় ভাসী আর
সিমরণ নেরুল।
আবির্ভাব এক ডাক্তারের বাড়িতে পিজি অ্যাকমোডেশন নিয়ে
আছে, দিনের লাঞ্চটা ওকে অফিসের ক্যান্টীনে খেতে হয়। সকালে ব্রেকফাষ্ট করে লকাল ধরে
নটার মধ্যে সিএসটি পৌছতে হবে। রাতে ঐ চক্করটা মেরে বাড়িতে পৌছতে প্রায় সাড়ে নটা
বেজে যায়। খাবারটা হটকেসে রাখা থাকে। স্নান করে খেয়ে নিয়ে বিছানাতে উপুড় হয়ে শুয়ে
ল্যাপটপে সিনেমা দেখা বা ইন্টারনেট সার্ফিং করা। এতেই ঘুমোতে যাবার সময় হয়ে যায়।
সপ্তাহে একদিন রাতে কলকাতায় বাবা আর মার সাথে টেলিফনে কথা হয়। স্কাইপে দুদিকেই
লাগান আছে কিন্তু মার দ্বারা ঐটা কানেকশন করে নেওয়া হয় না। বার বার দেখিয়ে দেওয়া
সত্ত্বেও ভূল করে ফেলে। তাই এবার একটা থ্রিজি মোবাইল কিনে দিয়ে আস্তে হবে।
আবির্ভাবরা দুই ভাই। দাদা বিয়ে করেছে। কোলকাতারই
মেয়ে, কিন্তু বিয়ের পরে কদিনের মধ্যে অন্য পাড়ায় বাড়ী ভাড়া করে আছে। বৌদি আর মার
মধ্যে বনিবনা হয়নি। এখন মা দেখা করতে চাইলে ফোন করে ডেকে নেয়। দাদা একা এসে দেখা
করে কথা বার্তা বলে চলে যায়। বৌদি আসে না। চাকরীটা নিয়ে মুম্বাই চলে আসার পড় থেকেই
আবির্ভাবের মনে সব সময় মার জন্য চিন্তা। বাবা রিটায়ার করলেও শরীর এখনও বেশ ভালই
আছে, কিন্তু মার শরীরটা ভেঙ্গে গেছে। দাদার কাছে না থাকা ঠিক মনে মানিয়ে নিতে
পারেনি। এদিকে যে বাবামাকে তুলে মুম্বাইতে নিয়ে আসবে তাও সম্ভব নয়। কিছু না হলেও
একটা টু বিএচকে ফ্ল্যাটের ভাড়া কম করে হাজার দশেকের মতন। সেটাও পানভেল বা
কালাম্বোলিতে, ষ্টেশনের থেকে কম করে ৪/৫ কিলোমিটার দূরে। একটা নিজের গাড়ী থাকা
দরকার। আর তাছাড়া এখানকার লোকগুলো যে যার নিজের জন্য। পাশের ফ্ল্যাটে লোকে বাঁচল
কি অসুখ হয়ে বিছানায় পড়ে রইল তাতে কারুর কিছু যায় আসে না।বাবাও
বলে এই কলকাতায় বেশ ভাল আছি। সারা ভারতে এর মত সস্তা আর ভাল জায়গা কথ পাবিনা। আগের
চেয়ে এখন এখানে গুন্ডামী হচ্ছে তবুও অন্যান্য জায়গার থেকে কলকাতা অনেক সেফ। বরং
তুই এদিকে একটা ভাল চাকরী পেলে চলে আস্তে পারিস।
মাঝে মাঝে ভাবে ট্রান্সফারের জন্য চেষ্টা করবে। ওঁর
অফিসের একটা ব্রাঞ্চ রাজারহাটে আছে। তবে যতদূর জানে ওখানে কোন ভেকান্সি নেই। ওয়েষ্ট
বেঙ্গলে চাকরীর বাজারটা খুবই খারাপ। হয়ত দূর্গাপুর বা হলদিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল
এষ্টেটে কিছু পাওয়া যাবে, কিন্তু তাতেও তো বাবামাকে কলকাতা থেকে তুলে নিয়ে যেতে
হবে। ের উপরে আছে সিমরণ। বুঝতে পারি যে ও আমাকে চায় আর সেই জন্য আস্তে আস্তে বাঙলা
শিখতে শুরু করেছে। কিন্তু ও কি পারবে বাবামাকে ছেড়ে আমার সাতেহ চলে যেতে? আমি যেমন
সব সময়ই বাবামার কথা ভাবি ও কি করবে? ওঁর তো ভাইও নেই। একমাত্র মেয়ে। ভাবি খালি
ভাবি কি ভাবে কি হবে?
শিমরণ মঙ্গেশকার। বয়স বাইশ থেকে পচিশের মধ্যে।
মেয়েদের ঠিক বয়স বলতে নেই, একটা রেঞ্জের মধ্যে রাখতে হয়। বাবা রিটায়ার করেছেন। রোজ
সকালে প্রায় তিন কিলোমিটার মর্নিং ওয়াক করে আসেন। ঠিক কটার সময় বাড়ী ফিরে আসেন
সেটা সিমরণ বলতে পারে না, কেননা ও বাবার ফেরার আগেই অফিসের জন্য হাঁটা শুরু করে।
বাড়ী থেকে ষ্টেশন প্রায় দেড় কিলোমিটার। একটু সময় হাতে নিয়েই বেরোয়। এর আগে ঘুম
থেকে উঠে চা খেয়ে সকালের লাঞ্চের জন্য তরকারী বানিয়ে রাখে যার থেকেই নিজের জন্য
কিছুটা নিয়ে নেয়। কোনদিন চারটে রুটি, কোনদিন বা পোহা নিয়ে যায়। মাঝে মধ্যে যে দিন
দেরী হয়ে যায়, সে দিন লাঞ্চটা ও আবির্ভাবের সাথে ক্যান্টিনেই করে নেয়। দুপুরে ভাত
মা বানিয়ে নেবে। রাতে ফিরে এসে মাইক্রোতে চটপট ফ্রিজের থেকে সকালের তরকারীটা বার
করে গরম করে নেওয়া আর ভাত বানিয়ে নিতে খুব বেশি হলে আধ ঘন্টা লাগে, কাজেই রাত
দশটার মধ্যে ডিনার কমপ্লিট। রাতে শুয়ে খালি আবির্ভাবের কথা চিন্তা করে। আবির্ভাব
যে ওকে চায় সেটা বুঝতে পেরে ও দোটানাতে পড়ে আছে। একদিকে বাবা আর মা। আমি বিয়ে করে
চলে গেলে এই বুড়োবূড়িদের কে দেখবে? বাবা কোনদিনই সংসারের কাজের দিকে নজর দেন নি।
ছোটবেলায় দেখেছে মা দৌড়ে দৌড়ে সব কাজের দিকে নজর দিচ্ছে। বড় হবার পরে আস্তে আস্তে
এই দায়িত্বটা সিমরণ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। বাবার নিজের ওয়ান বিএচকে ফ্ল্যাট।
বাড়ী ভাড়ার খরচ নেই। পেন্সনের টাকায় দিব্যি চলে যাবে। কিন্তু অসুখ বিসুখ হলে পরে
কে দেখবে? সিমরণ তো থাকবে আবির্ভাবের বাড়ীতে। তা ছাড়া আবির্ভাবের বাবা মারও তো বয়স
হয়েছে, এই বয়সে ওঁরা আর কতদিন একা থাকতে পারবেন তা কেউ বলতে পারেনা। হয় আবির্ভাব
ওদের কাছে নিয়ে আসবে নয়ত ট্রান্সফার নিয়ে কলকাতায় চলে যাবে। কাছে নিয়ে এলে নতুন
বাঙ্গালি পরিবেশে ওকে থাকতে হবে, নতুন লোকের দায়িত্ব নিতে হবে, কিন্ত নিজের
বাবামাকে কাছেই দেখতে পাবে। আর কলকাতায় ট্রান্সফার নিয়ে গেলে বাবামাকে হয়ত দু তিন
বছর বাদে বাদে দেখা করতে আসতে পারবে। চিন্তা করে কোন রাস্তাই পায় না। মাঝ থেকে
ঘুমটা দেরী করে আসে।
এদের চিন্তার কি কোন সল্যুশন আছে? আমি তো জানি না।
আপনাদের জানা থাকলে ওদের উপদেশ দিন না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন