সুর্যের দেবী ছিলেন আমাতেরাসু। তাঁর সৌন্দর্যের কথা শুধু
জাপান নয় সারা বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। আর
ওদিকে ঝড়ের দেবতা ছিলেন তাঁর ভাই সুসানো-ও। কোনকিছু নড়াতে হলে তাঁর কোন জুড়ি ছিল
না। তাড়াহুড়ো করে সবকিছু ভন্ডুল করে দিতেও তাঁর কোন জুড়ি ছিল না।
এই সুসানো-ও একদিন তাঁর বোনের সাথে দেখা করতে গেলেন
স্বর্গের রাজ্যে। আসলে তাঁর যাবার কথা ছিল তাঁর মার সাথে দেখা করবার, মৃত্যুপূরীতে
গিয়ে, কিন্তু রাস্তায় অনেক ভয়ের কথা শুনে তাঁর মনে একটু ভয় হয়ে গেছিল। তাই সে
ভেবেছিল যে তাঁর এই জ্ঞানী বোনের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে নিলে তাঁর মনের সাহস বেড়ে যাবে।
কিন্তু সুসানো-ওর ব্যপার তো। তাড়াহুড়ো করে যেতে গিয়ে সে আকাশের একপ্রান্ত থেকে
অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত বিদ্যুতের রেখা টেনে মেঘের গর্জনে সবাইকে কাপিয়ে, (এমনকি
পাহাড়পর্বত পর্যন্ত কেপে ঊঠেছিল), ভয় পাইয়ে দিলেন। এই ভাবে সুসানো-ও গিয়ে পৌছালেন
আমা বা আমাতেরাসুর কাছে। আমাতেরাসু পর্যন্ত ভয় পেয়ে গেছিলেন।
নিজেকে শক্ত করে আমাতেরাসু হাতে একটা ধনুক আর কাঁধে তীর
ভর্তি তূনীর নিয়ে সুসানো-ওর সাথে দেখা করার জন্য বেড়িয়ে এলেন। চোখে মুখে বেশ রাগের
লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল আমাতেরাসুর। বলে উঠলেন, “ কি ব্যপার।
সবাইকে চমকে দিয়ে ভয় পাইয়ে এটা কি হচ্ছে তোমার”।
যদিও সুসানো-ওর এই ধরনের অভ্যর্থনা ভাল লাগেনি, তবুও তিনি
হাসিমুখে বলে উঠলেন, “ সুন্দরী বোন আমাতেরাসু। তোমাদের কাউকে ভয় দেখাতে আমি
চাই নি। তোমার সাথে একটু দেখা করে যাবার ইচ্ছেই মনে আছে, আসলে আমি তো মার সাথে দেখা করার জন্য পাতালপূরীতে যাচ্ছি
তাই তাঁর আগে তোমার সাথে একটু দেখা করতে এলাম”।
কথাটা আমাতেরাসুর মনে ধরলেও সে সুসানো-ওকে একটু যাচাই
করে দেখতে চাইল। কিন্তু এর মধ্যেই সুসানো-ও বলে উঠলেন, জাপানের এই পূণ্যভুমিতে ভাল
ভাবে শাসন করবার জন্য আমাদের গোটাকয়েক দেব দেবী তৈরী করা হলে ভাল হয় না কি? আর
তাঁর জন্য তাহলে আমাকে এখানে কিছুদিন থেকে যেতে হয়। আসলে সুসানো-ওর মনে পাতালপূরীতে যাবার ভয়টা
কিছুতেই কাটছিল না।
আমাতেরাসু রাজী হয়ে গেলেন। আর তখন সুসানো-ওর তলোয়ারটাকে
নিয়ে তিন টুকরোতে ভেঙ্গে ফেললেন। আর তাঁর পরে সেই টুকরোগুলোকে মুখে নিয়ে চিবিয়ে
চিবিয়ে একেবারে গুঁড়ো করে ফুঁ দিয়ে এক কুয়াশার সৃষ্টি করে দিলেন। সেই কুয়াশার থেকে
তৈরী হল আরও তিন সুন্দরী দেবীর। সুন্দরী মানে একমাত্র আমাতেরাসু ছাড়া বাকী অন্য
সবার চেয়ে সুন্দরী।
এইভাবে সুসানো-ও তাঁর বোনের কাছ থেকে পাঁচটা মণি চেয়ে
নিয়ে তাঁকে মুখে পুরে চিবিয়ে গুঁড়ো করে ফুঁ দিলেন। আর ঠিক আমাতেরাসুর তৈরি তিন
দেবীর মত সুসানো-ওর ফুঁ থেকে তৈরী হল পাঁচ দেবতা। এরা প্রচন্ড শক্তিশালী হলেন তবে সুসানো-ওর
মতন নয়।
নিজের কৃতিত্বে সুসানো-ও আত্মহারা হয়ে লাফাতে শুরু করে
দিলেন আর বলতে শুরু করলেন যে সবাই দেখুক যে কি ভাবে সুসানো-ও দেবতাদের সৃষ্টি
করেছে। আমাতেরাসু একটু রেগেই বললেন, ওগুলো তো আমার দেওয়া মণির থেকে তৈরী হয়েছে। সুসানো-ও
রেগে কাই। অন্য কিছু করা গেলেও হত।
কিন্তু রাগের মাথা সুসানো-ও ঝড় বৃষ্টি এনে আমাতেরাসুর সমস্ত ক্ষেতখামার ভাসিয়ে
দিল। বানের জলে মন্দির গুলো ভেঙ্গে গেল। আর জঞ্জালে চারদিক ভরে গেল।
যদিও আমাতেরাসু
তাঁর ভাইএর কাছ থেকে এইরকম কিছু হতে পারে বলে ভেবেছিল কিন্তু তাঁর চিন্তায় ছিল না
যে সুসানো-ও এত কিছু নষ্ট করে ফেলবে। এটা অবশ্যি তাঁর জানা ছিল যে সুসানো-ও একটা
গোঁয়ার গোবিন্দ ছেলে তবুও। মনে মনে তিনি ভাবলেন, যাক এবার সুসানো-ওর রাগ হয়ত একটুঁ
কমেছে আর এই সব ঠিক করার কাজে ও একটু হাত লাগাবে।
কিন্তু কোথায় কি, বরঞ্চ সুসানো-ও আরও কি ভাবে আমাতেরাসুর
সাথে দুর্ব্যবহার করা যায় তাঁর দিকেই নজর দিতে শুরু করলেন। ওদিকে আমাতেরাসুও ভাবতে লাগলেন কি সে এত অন্যায় করেছে সে তাঁকে এই
রকম একটা গোঁয়ার ভাইএর দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হচ্ছে।
একদিন আমাতেরাসু তাঁর নিজের পূজার ঘরে বসে পুজার জন্য
কাপড় গোছগাছ করছিলেন ঠিক সেই সময়েই সুসানো-ওর মনে হল যে তাঁর বোনের এই সব কিছু
অগ্রাহ্য করে যাওয়া আর তাঁর পছন্দ নয়। এইবার একটা কিছু করার দরকার যাতে হয় আমাতেরাসু
তাঁর সাথে লডাইএ নামবে নয়তো হেরে গিয়ে তাঁর অধীনতা স্বীকার করবে। সে একটা ঘোড়াকে
আচ্ছা করে চাবকিয়ে সেই আমাতেরাসুর পূজাঘরের ছাদ দিয়ে নীচে ফেলে দিলেন। ঘোড়াটা তো
পড়ে মরে গেল, কিন্তু তাঁর জীনে একটা কাগজে কিছু লেখা দেখতে পাওয়া গেল। লেখাটা
অবশ্যি সুসানো-ওর আর আমাতেরাসুকে লেখা। তাতে লেখা আছে, “পৃথিবীতে সব
কিছুই, এই ঘোড়ার গাঁয়ের রঙের মত সাদা কালো আলাদা ছোপে ছোপে নয় তাঁর মধ্যে কিছুটা
মেলানো রঙও থাকে”।
ব্যপারটা আর আমাতেরাসুর সহ্য হল না কারণ ভয়ের চোটে ঐ ঘোড়াটার
পড়ে গিয়ে মরে যাওয়ার সময় আমাতেরাসুর এক খুব নিকট বন্ধুও ভয় পেয়ে মারা যান। আমাতেরাসু
ঠিক করলেন যে আর নয়, এবার সব কিছু ছেড়ে পালাতে হবে। মানে এক দূর জায়গাতে যেখানে
কেউ তাঁকে আর বিরক্ত করতে না পারে।
আমাতেরাসু দৌড় লাগালেন দূর পাহাড়ের দিকে। আর গিয়ে আশ্রয়
নিলেন এক গভীর গুহার মধ্যে, সুধু আশ্রয় নেওয়া নয়, একটা পাথর টেনে গুহার মুখটাও
বন্ধ করে নিলেন। তাতে আমাতেরাসুকে গুহার
ভেতরের অন্ধকারের মধ্যে থাকতে হল বটে,
কিন্তু গুহার বাইরের অবস্থাটা খুবই খারাপ। বাইরের লোকেদের কাছে আর সেই আমাতেরাসুর
জ্যোতির আলো নেই, তাঁরা ঘন মিশকালো অন্ধকারে পরে রইল।
এদিকে দেব আর দেবীদের প্রায় আটশ জনের এক জোট একটা নদীর
শুখা বুকে বসে ঠিক করতে শুরু করলেন কি ভাবে আমাতেরাসুকে গুহার বাইরে আনা যায়।
জ্ঞানী বুড়া দেবতা ধরা হল। তিনি বললেন যেখানে যত রাজ্যের মোরগ আছে, তাদের একসাথে
করা হোক। আর আমাতেরাসুর সেই গুহার সামনে একটা গাছে বেশ কিছু আয়না টাঙ্গানো হোক।
এই সময় আর এক দেবী, আমা নো উজুমে এসে এই পরিকল্পনাতে আরও
একটু কিছু যোগ করে দিলেন। তিনি তাঁর সাধারণ বেশ ছেড়ে খালি কিছু লতাপাতা দিয়ে তৈরী
পোষাক পরে একটা বড় বাল্টীকে উলটো করে তাঁর উপরে নাচতে শুরু করে দিলেন। সে এক
উদ্দাম নাচ। ওখানে যত দেবদেবীরা ছিল তারা হেঁসে গড়িয়ে পড়ে আর হাততালি আর সিটির বহর
পড়তে থাকে। আর ঐ সব দেবদেবীরা যে সব মশাল জ্বেলে নাচ দেখছিলেন সেই মশালের আলোতে
দিন হয়ে গেছে ভেবে মোরগগুলো একসাথে চেঁচাতে শুরু করে দিল।
সে এক বিরাট হই চই ব্যপার। আমাতেরাসু গুহার ভেতর থেকে বাইরের
গন্ডগোলের আওয়াজ পাচ্ছিলেন কিন্তু কি ব্যপার বুঝতে পারছিলেন না। তাঁর অবর্তমানে
অন্য দেবদেবীরা হাসিঠাট্টা করে সময় কাটাচ্ছেন, এটা তিনি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন
না। অতএব দেখতে হয় কি ব্যপার হচ্ছে বাইরে।
বাইরেও সবাই এই জিনিষটা হবে বলে ভেবে রেখে শক্তির দেবতাকে
গুহার মুখের কাছেই রেখে দিয়েছিলন, যাতে আমতেরাসু বের হলেই তাঁকে টেনে একেবারে
বাইরে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু তাঁর আর দরকার পড়ল না। আমাতেরাসু গুহার বাইরে তাকিয়ে
প্রথমে তাঁর নিজের ছায়াই আয়নাগুলোতে দেখতে পেলেন আর তাঁর পরেই দেখতে পেলেন যে বাইরে
তাঁকে পাবার জন্য সমস্ত দেবদেবীরা কি ভাবে অপেক্ষা করছেন। তাঁর ভয় আর রাগ মিলিয়ে গেল।
আমাতেরাসু তাঁর নিজের প্রাসাসে ফিরে গেলেন। পৃথিবী তাঁর
জ্যোতির থেকে বঞ্চিত হল না, ওদিকে সুসানো-ও কেও তিনি তাঁর কাজের জন্য ক্ষমা করলেন।