শুক্রবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৫

আমার দেখা সত্তরের দশক (৫)

নতুন শখ হল মুরগী পোষা যায় কিনা। দুটো মুরগী এনে তাদের কেটে খাওয়ার বদলে ভেতরের উঠোনে কয়লা রাখার জায়গাতে রেখে দেওয়া হল। তখন গ্যাস আর কোথায়। কয়লা মানে কোল ব্রিকেটস। মুরগী দুটো খায় দায় আর পেছনের বাড়িতে গিয়ে ডিম পেরে আসে। কদিন দেখার পরে আমার বাড়িতে যে অল্প বয়সী বউটি কাজ করত সে বলে,  ওটাতো ঐ বাড়িতে গিয়ে ডিম পেরে আসছে।

তারপর থেকে কদিন একটু আটকে রাখার পরে রোজ একটা করে ডিম পাওয়া যেত। তখন মেয়ের মাথা চুলের জন্য নেড়া করে দেওয়া হয়েছিল, আর তার পরে মাথায় ডিম মাখালে চুল ভাল হবে অতএব ওর মাথায় একটা করে ডিম ঠুকে ফাটান হত। আর তাতে ওর দাদাদের কি উল্লাস। এখনও মেয়ে আমাকে বলে, আমার মাথায় তুমি যে ডিমগুলো ফাটিয়েছ তার দৌলতেই আমার চুল এত বড় হয়েছিল।

বাডীতে কাজ করতে আসত প্রথম প্রথম এক বছর পঞ্চাশেক বয়সের উড়িয়া মহিলা। সাথে তার ছেলের বৌ। পরে তার ছেলের বৌ একাই কাজ করতে আসত। বউটির বিয়ে হয়েছিল বছর দুয়েক আগে, কিন্তু তখনও তার কোন সন্তান হয়নি বলে তার শ্বাশুড়ি আবার ছেলের বিয়ে দেবে বলে ঠিক করছিল। বৌ, নাম ছিল প্রমীলা, এসে তার মাজি অর্থাৎ আমার স্ত্রীকে নালিশ করাতে, সে শ্বাশুড়ী কে ডেকে বোঝায়।

আমার অফিস কাছেই হলেও পরে সেটা তুলে নিয়ে বড় অফিসের পাশে পাঠান হল। সে সমস্ত বিল্ডিং তৈরী করা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে একটা ব্লক রেলের স্কুলের প্রাইমারী সেকশনকে দেওয়া হল। আর একটা ব্লকে এসে গেল স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। মেয়ে কেজি সেকশনে এসে এই প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হল।

কিন্তু সে তখন জানে যে তার বাবা রেলের ফোরম্যান, এর পরেই ফাইভম্যান হবে,  (তার হিসাবে ফোরের পরে ফাইভ, অতএব ফোরম্যান থেকে প্রমোশন পেলে ফাইভম্যান হয়ে যাবে), অতএব টীচার একবার তাকে বকাতে সোজা এসে আমার অফিসে হাজির, আমাকে নালিশ করবে।

কিন্তু আমাকে না পেয়ে আমার অফিসের চৌকিদার বুড়োকে বলেছে। মুন্নিকে কে বকেছে কার ঘাড়ে কটা মাথা, অতএব চৌকিদার তার লাঠি ঠুকতে ঠুকতে গিয়ে হেড মিস্ট্রেসের কাছে হাজির। এর একটা বিহিত করতে হবে। মুন্নিকে বকা চলবে না। আমি ফিরে এসে সব সামাল দিই।

বিলাসপুরে তখন বাঙ্গালী কর্মচারীর সংখ্যা প্রচুর। তিনটে দূর্গা পূজা হত শুধু রেলের কলোনীতে, তা  ছাড়া সিভিল সেটেলমেন্টে আরও গোটা তিনেক।  কোয়ার্টারের কাছেই ছিল কনষ্ট্রাকশন কলোনীর পুজা, যেখানে সারা দিন কেটে যেত। আমাকে অফিসে যেতে হত কিন্তু বাড়ীর বাকী লোকে ঐ প্যান্ডেলে সারা দিন পড়ে থাকত। মধ্যে একবার এসে সন্ধ্যের আরতির আগে কাপড় বদল করে আবার যাওয়া।

এই সময় আমাকে একটু অফিস সংক্রান্ত সোশাল কাজ করতে হল। মানে আমার এক সহকর্মী হঠাত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি থাকতেন বিলাসপুরে একা, স্ত্রী কন্যা থাকতেন কলকাতায়। বেশ কিছু দিন হাসপাতালে থেকে পরে ছাড়া পেলেন। অফিস থেকে তার কলকাতায় মেডিকাল রেফারেন্সের বন্দোবস্ত করা হলে তাঁকে কলকাতায় পোঁছানর দায়ীত্ব পড়ল আমার উপরে।

ইতিমধ্যে তার স্ত্রী এবং কন্যা বিলাসপুরে এসে হাজির। এই তিনজনকে নিয়ে আমি একটা ফোরবার্থ কম্পার্টমেন্টে রিজার্ভেশন করে, নিয়ে গেলাম কলকাতায়। কেশব সেন ষ্ট্রীটের বাড়িতে পৌছিয়ে দিয়ে আমার ছুটি। পরে অবশ্যি তার ট্রান্সফার কলকাতায় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
    
রায়পুরের কাজ ভালভাবে শেষ করার জন্য যদিও আমার নামে একটা অ্যাওয়ার্ড এল, তবুও আমাদের মতন অস্থায়ী কর্মচারীদের উপরে ক্রমশই খাড়া নামার ভয় বাড়ছিল। তাই আমার রায়পুরে থাকার সময়েই আমরা ৭১ জন মিলে কলকাতা হাইকোর্টে রেলের বিরুদ্ধে মামলা করলাম। আমাদের স্থায়ীত্ব দিতে হবে এবং এই যে কবছরের কাজের অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার মূল্য দিতে হবে।  যুক্তি রইল যদি আমরা কোন জিনিষ গড়তে পারি তবে সেটাকে ঠিক রাখার জন্য সমস্ত কর্তব্যও আমরা করতে পারি। আমাদের হয়ে ব্যারিষ্টার দাঁড়ালেন স্নেহাংশু আচার্য আর রেলের পক্ষে শঙ্করদাস ব্যানার্জী।

কেসের কাজকর্ম দেখার জন্য এক একজনকে মাঝে মাঝে কলকাতায় আসতে হয়। কেস চলতে থাকল। শেষে হাইকোর্ট থেকে রায় বার হল আমাদের বিরুদ্ধে। বিচারকের মন্তব্য ছিল, যদিও আমাদের দাবীটা যৌক্তিক, তবুও বর্তমানে রেলের কোন আইনের দ্বারা আমাদের দাবীকে আইনানুগ করে নেওয়া যাচ্ছে না। সাথে আরও বলা হল রেল যেন এই দাবীগুলোকে সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করে।

এই নিয়ে যখন আমরা সাংসদদের সাথে দেখা করেছিলাম, তখম এক বামপন্থী সাংসদের বক্তব্য ছিল অদ্ভূত। তিনি সোজা বলে দিলেন, তোমাদের ৭১ জনের  দাবীর জন্য তো আমি আমার এত বড় রেলের অন্যান্য কর্মচারীদের ভাসিয়ে দিতে পারিনা।

তার প্রধান যুক্তি ছিল যদি আমাদের অভিজ্ঞতাকে দাম দেওয়া হয় তবে আমাদের এই সমস্ত প্রোমোশনগুলোকেও মান্যতা দিতে হবে আর তাতে ওনার ইউনিয়নের সদস্য, যারা সুযোগের অভাবে এত দিন প্রমোশন পান নি বা কাজের খাতিরে যাদের এই ধরণের কাজ করতে পাঠানো হয়নি, তাঁরা বঞ্চিত হবেন।

আমরা ডিভিশন বেঞ্চে আপীল করলাম। ইতিমধ্যে এলাহাবাদ কোর্টেও একই ধরনের এক মামলাতে রেলের বিপক্ষে রায় গেল। রেল ওখানে আপীল করল। কলকাতা হাইকোর্টে বোর্ড থেকে একজন এসে সওয়াল করার সময় বিচারককে বললেন, এলাহাবাদে এই ধরনের একটা কেস আছে। তাতে যা রায় হবে সেটা আমরা দুই মামলাতেই মেনে নেব। বিচারক রাজী হয়ে আমাদের আপীল ডিসমিস করে রায় সেই ভাবেই দিলেন। কিন্তু এখানেই রেলের আইনজ্ঞদের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।

আমাদের চাকুরীর মেয়াদ তখন থাকছে আর খুব বেশি হলে বছর পঁচিশ। ততদিন যদি এলাহাবাদের মামলাতে তারিখের পর তারিখ নিয়ে নেওয়া যায় তবে কতদূর পর্যন্ত এই সব বালখিল্যেরা লড়তে পারবে। যতদুর জানি এখনও সে কেসের রায় বার হয়নি। তাছাড়া বোর্ডের প্রতিনিধি আমাদের এমন ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন, আমরা যে এই লাখ লাখ টাকা  খরচ করছি, সেটা বোর্ডে দিলেই সব হয়ে যেত। কালো টাকার কারবার সব সময়েই ছিল আর থাকবেও। প্রথম প্রথম যারা অন্য বিভাগ থেকে ডেপুটেশনে এসেছিলেন তাঁদের ফেরত পাঠান হতে লাগল। তাঁদের পরে আমাদের কিছু কিছু লোকেদের অস্থায়ী হিসাবেই  এলাহাবাদ বা ওয়ালটেয়ার এলাকায় পাঠান হতে লাগল।

শেষের দিকে এমন অবস্থা হল যে সারা অফিসে (ইলেক্ট্রিল্কাল সেকশনে) আমি একমাত্র সিনিয়র সুপারভাইসরি ষ্টাফ। আমার অধীনে একজন সুপারভাইজর আর কিছু খালাসি। যদি কোথাও কিছু দরকার পরে তবে সেই কাজটুকু করানর জন্য। মূলত কাজগুলো ছিল বড় আজব ধরনের।

তবে এই সময়ের একটা মজার কথা না বলে পারছিনা। ভিলাই রেলের বৈদ্যুতিক ইঞ্জিন মেরামতীর কারখানাতে একটা নতুন মেশিন বসবে, পিট হুইল লেদ। ইঞ্জিনের চাকার উপরে যে ষ্টীলের টায়ার লাগানো থেকে তাকে কেটে আবার গোল করে দেয়ার কাজের জন্য। যেহেতু চাকাটা খোলা হবে না তাই মেশিন বসাতে হবে লাইনের নীচে, মাটী খুঁড়ে। কাজ শুরু করা আগে তো কন্ট্রাক্টর তার পুজাআচ্চা করে নিয়েছিল। কিন্তু শেষ হবার পরে মেশিনের কাজের উদ্বোধন করার জন্য শুভদিন দেখতে হবে। ধারেকাছে পাজি অনুযায়ী কোন শুভদিন না পাওয়াতে স্থির হল যে প্রাচীন প্রবাদ মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা। অতএব এক বুধবার দেখে মেশিনের কাজের উদ্বোধন করা হল, আমরা ইতরজন মিষ্টান্ন ভক্ষণ করলাম।

 

সোমবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৫

আমার দেখা সত্তরের দশক (৪)



এইখানে একটা কথা বলে নেওয়া ভাল হবে। দেশ স্বাধীন হবার পরে সমস্ত রেল ব্যবস্থাটাকে উত্তর, দক্ষিণ, মধ্য এই রকম কয়েকটা অঞ্চলে ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল, আর প্রত্যেক ভাগের জন্য একজন কর্তা (জেনারাল ম্যানেজার) এর উপরে কাজ চালানর ভার দেওয়া হয়েছিল। বৈদ্যুতিকরণের কাজের ভার, যদিও এই সমস্ত রেলের অঞ্চলগুলিতে হচ্ছিল তবুও এক আলাদা জেনারাল ম্যানেজারের উপরে দেওয়া হয়েছিল। তার মানে দাড়িয়েছিল এক অস্থায়ী নতুন অঞ্চল তৈরী করা হল।

তাঁর মূল কারণ ছিল এর আগে রেলে বিদ্যুতের কাজ কর্ম খুব কম। যেমন সমস্ত হাওড়া-নাগপুর-ওয়াল্টেয়ার এলাকার জন্য মাত্র একজন বিদ্যুৎ অভিযন্তা (ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার) ছিলেন। সেখানে বর্তমান এই বিরাট যজ্ঞের জন্য অনেক ইঞ্জিনিয়ারের দরকার পড়েছিল। ক্লার্ক, আর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের জন্য বিভাগীয় রেলের লোকেদের ডেপুটেশনে নেওয়া হলেও বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য নতুন লোকের দরকার পড়েছিল আর সেই লোক হলাম আমরা। সদ্য সদ্য কলেজ থেকে পাশ করে কাজে যোগ দিয়েছিলাম। আর কি উৎসাহ ছিল কাজে।

৭১/৭২ সাল নাগাদ রেলের দিল্লী অফিসে দুই দলের টানাপড়েন চলছিল। এক দল বলেন বৈদ্যুতিকরণ করা হোক, আর এক দলের মত হচ্ছে তাতে প্রাথমিক খরচ অনেক হবে তাই আমরা কয়লার বদলে ডিজেল দিয়েই গাড়ী চালাব। ডিজেলওয়ালাদের বাড়বাড়ন্ত তখন, যদিও ডিজেল মানেই আমেরিকার দ্বারস্থ হওয়া।  বৈদ্যুতিকরণের জেনারাল ম্যানেজারের পদ বিলুপ্ত করা হল। যেখানে যত বৈদ্যুতিকরণের মালপত্র ছিল সেগুলো বাতিল করে গুদামে পাঠান চালু হল। আর গুদাম থেকে তাদের কাবাড়িওয়ালার দরে বেচে দেওয়া হতে লাগল। যেহেতু ভবিষ্যতে আর বৈদ্যুতিকরণের কাজ আর হবে না, তাই আগামী দিনের মালের বরাত সব বাতিল করা হতে লাগল।

পরে এই মালের অভাবই জাপানে লোহার আকর রপ্তানীর জন্য তৈরী কে কে লাইন বৈদ্যুতিকরণ করতে পাঁচ বছরের মত অতিরিক্ত সময় লাগিয়েছে। এতদিন এটা গর্বের বিষয় ছিল যে কোন বৈদ্যুতিকরণ প্রজেক্ট তার নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশী সময় নেয় নি। রাউরকেলা- দূর্গ লাইনের কাজের সমাপ্তিও  নির্ধারিত দিনের এক দিন আগে হয়েছিল বলে আমরা সবাই আনন্দ করেছিলাম।

যাকগে, রেলের দিল্লী অফিসের সুমতি কিছুদিন বাদেই হওয়াতে আজও এই কাজ হয়ে চলেছে আর সারা ভারতে এখন খুব অল্প জায়গা বাকী আছে ( ট্রাঙ্ক লাইন বা প্রধান পথ) যেখানে বৈদ্যুতিকরণ হয় নি বা এখনও প্ল্যানে নেওয়া হয় নি।

৭২ সালে দূর্গ- বিলাসপুর খন্ডে বিদ্যুৎ সংযোগ হয়ে গেলে হাওড়া থেকে একেবারে দূর্গ পর্যন্ত টানা বৈদ্যুতিক ট্রেন চলবার বন্দোবস্ত হয়ে গেল। সাথে ভিলাইতে এই সমস্ত ইঞ্জিনগুলোর রক্ষণাবেক্ষনের জন্য শেড তৈরী হওয়াতে কোন অসুবিধা রইল না। এখন শুরু হল যে সমস্ত দৈনিক বেতনভোগী কর্মচারী ছিল তাঁদের একটা গতি করার।

আগে যে দৈনিক বেতনভোগীদের ষ্ট্রাইকের কথা বলেছিলাম তাতে কিছুটা সুফল দিয়েছিল।  এই সমস্ত কর্মচারী দের জন্য একটা স্ক্রীনিংয়ের বন্দোবস্ত করে তাঁদের বিভিন্ন খালি জায়গাতে নিয়োগের বন্দোবস্ত করা হল। কিন্তু  আমার নিগ্রহের কথা কিন্তু বিভাগীয় কর্তারা ভোলেন নি। তাতে  যে তিনজন লোক সরাসরি যুক্ত ছিল তাঁদের বাতিল করে দেওয়া হল। কেন সেটা না জানালেও আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় নি কেননা প্রাথমিক পরীক্ষা আমরাই নিয়েছিলাম। 

৭৩ সাল নাগাদ আমাকে রায়পুরের অফিস বন্ধ করার পরে নিয়ে আসা হল বিলাসপুরে। সেখানেও কাজ শেষ হয়ে গেছে কিন্তু অফিস বিল্ডিং আর বাড়তি মালের বন্দোবস্ত করা হয়নি। বিল্ডিং ভাঙ্গা হবে না অন্য কোন বিভাগকে হস্তান্তর করা হবে তা ঠিক হয়নি। বিলাসপুরের অফিস আগে যেখানে রমরমা ছিল, সেখানে তখনকার অবস্থা টিম টিম করছে।

বিলাসপুরে এসে প্রথম এক মাস আমাকে থাকতে হল টিকরাপাড়ায় এক প্রাইভেট বাড়ীতে। পাড়াটা রেলের সীমানার গায়েই আর বাসিন্দাদের প্রায় শতকরা ৯৫ প্রতিশত লোকেরা রেলের কর্মচারী। দোতলার উপরে দুটো ঘর কিন্তু টয়লেট দোতলায় ঢোকবার সিড়ির মাথায়। ঘরের পেছন দিকে এক খোলা বারান্দা। আমার বন্ধু এসে দেখে বলে দিল, এই বারান্দার দরজা তালা দিয়ে রাখ, কেননা তোমার যা শান্ত ছেলে মেয়ে তারা যে কি করবে সেটা ঠিক নেই

কলকাতায় মানুষ আর তার পরে চাকরী সুত্রে যে সব জায়গাতে থাকলাম, সেখানে অফিস আর বাড়ীর মধ্যে দূরত্ব অল্পই থাকত। কিন্তু টিকরাপাড়া থেকে আমার অফিসের দূরত্ব একটু বেশি মনে হতে লাগতে লাগল। অতএব সাইকেল শেখার দরকার। আমার বহুদিনের সহকর্মী সাইকেলের সাথে দৌড়ে দৌড়ে প্রায় ঘন্টা দেড়েক বাদে যখন মনে করল যে আমার ব্যালান্স একটু হয়েছে, তখন সে হঠাত বলে, আমি বাড়ী যাচ্ছি, তুই সাইকেল চালিয়ে আয়।

তখনো একটা উচু জায়গা পেলে সেখান থেকে সাইকেলে উঠি আর নামাটা তখনও রপ্ত হয়নি।  কিন্তু কি করা যায়। কোন রকমে চেচিয়ে লোকেদের সাবধান করতে করতে গিয়ে পৌঁছলাম। দেখি বন্ধুবর দাড়িয়ে আছেন দরজাতে। হাসি মুখ, বলে দেখলি তো তোর সাহসটাই হচ্ছিল না। এরপর কি ভাবে উঠতে আর নামতে হয় সেটা শিখতে আর কটা দিন লাগবে। মানে ৪২ বছর বয়সে আমি সাইকেলের ড্রাইভিং  লাইসেন্স, তাও লার্ণিং লাইসেন্স পেলাম। অবশ্যি পাক্কা লাইসেন্স পেতে আর দিন পনের লেগেছিল।

আমি বিলাসপুরে এলাম ৭৩ সালে আর ৭৪ সালের মে মাসে হল আবার স্ট্রাইক। আমার অফিসে অবশ্যি এবারও কিছু আঁচ পড়েনি। আমার অফিসে ষ্টাফ বলতে তখন ক্লার্ক একজন আর টেকনিকাল ষ্টাফ মাত্র দুজন, বাকী জন দশের মতন দৈনিক বেতনভোগী খালাসী। ডিষ্ট্রিক্ট অফিস থেকে ফরমান পেলাম কেউ সকালে হাজিরা ঠিক সময়ে না দিলে তার নাম লিষ্ট করে পাঠান চাই।

কাজের পাট যেখানে বন্ধ করার মুখে, সেখানে ঠিক সময়ে আর কে আসে। কিন্তু আমার মন তো তাদের নাম পাঠাতে রাজী হয় না, কারণ দৈনিক বেতনভোগীদের তো এক কথায় ছাঁটাই করা হবে। কি দরকার, তাই লিস্টে অল প্রেজেন্ট করে খবর পাঠান হল। কিন্তু আমাদের ডিষ্ট্রিক্ট অফিসে দুজন হেড ক্লার্ক ষ্ট্রাইকে যোগ দেওয়াতে, তাদের চাকরীতে ব্রেক দেখান হল। পরে অবশ্যি সে সব ঠিক করে নেওয়া হয়েছিল।

এই স্ট্রাইক সম্বন্ধে একটা জিনিষ মনে রাখতে হবে। যে আমাদের বৈদ্যুতিকরণ অফিসে দুধরণের কর্মী ছিলেন। এক আমাদের মতন লোক যারা সদ্য সদ্য কাজে যোগ দিয়েছে ( ১৯৫৮ সালের থেকেই আমাদের নিয়োগ করা শুরু হয়), আর অন্য দল হল  যারা আগে থাকতে কোন বিভাগীয় অফিসে কাজ করছিলেন, একটা প্রমোশন নিয়ে ডেপুটেশনে কাজে এসেছিলন।

কাজে কাজেই কোন ইউনিয়নের বালাই ছিল না, আর যেহেতু ইউনিয়ন নেই তাই কোন নেতাও তৈরী হয়নি। অতএব ৬০ সালের মতন এবারও বৈদ্যুতিকরণে কোন ষ্ট্রাইক হয়নি। দু একজন তাঁদের নিজস্ব বিশ্বাসে ষ্ট্রাইক করেছিলেন। তাই বৈদ্যুতিকরণ বিভাগে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ( মানে জেলে পাঠান ইত্যাদি,) নেওয়া হয়নি।

দুই ছেলে রেলের প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হল। আর মেয়ে গেল বাড়ীর পাশেই এক মহিলার বাড়ীতে প্লে স্কুলের মতন ছিল সেখানে। কোয়ার্টার রায়পুরে যে রকম পেয়েছিলাম সেই রকমই, খালি এবার সাথে অনেকটা জমি থাকায় কিচেন গার্ডেন করতে পেরেছিলাম। আমার আগে সে সহকর্মী ছিলেম ওখানে তিনি ঐ জমিতে অড়হরের চাষ করেছিলেন। আমি এবার লাগালাম মুলো আর ঢেড়স। একটু কপিও।


আমার ছেলেরা আমার মতন বাঁদর হবে এটা জানাই ছিল, তবুও তাঁর নিদর্শন দিতে ছোট ছেলে তার টীচারের সাথে একদিন তর্ক জুড়ে দিল ওয়ান হান্ড্রেড ওয়ান লেখার জন্য কেন একের পরে দুটো শূন্য দিয়ে একশ বানিয়ে তার পাশে এক লেখা হবে না। টীচার মিস, তুমি ভুল শেখাচ্ছ। আমি বাবাকে বলে দেব। মিস তো আমাকে বলে আর হাসে। অবশ্যি ছেলের যুক্তি একেবারে ঠিক, কেননা যখন বলছে হান্ড্রেড এন্ড ওয়ান, মানে একশ আর এক,  তাই সেটা ঐ ভাবেই লিখতে হবে তো। বাড়ী ফিরে আমাকে নিরানব্বই থেকে লিখে লিখে বোঝাতে হল। মনে অবশ্যি পড়েছিল আমার ট্রান্সলেশনে তাহার আছে কেন his has হবেনা নিয়ে তর্ক। 


বৃহস্পতিবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৫

আমার দেখা সত্তরের দশক (৩)

রায়পুরে তখন বাঙ্গালী অনেক হলেও তাঁরা সমস্ত শহরের অন্য প্রান্তে (বুড়া পাড়া এলাকাতে) থাকেন। সেখানে একটা কালীবাড়িও আছে। আগে যে আমার মাসতুতো দাদার কথা বলেছি তার শ্বশুরবাড়ীও  এই বুড়াপাড়াতেই। দুর্গা পুজা শহরে একটাই, এই বুড়াপাড়াতে হত সেই সময়, যদিও বাকী প্রায় প্রত্যেক পাড়াতেই হত নবদূর্গার আরাধনা।

আসলে আমাদের মা দূর্গার ছেলেপিলেকে নিয়ে সবশুদ্ধ এক সাথে পূজো হয় প্রধানতঃ বাঙ্গালীদেরই, অন্য সব জায়গাতে একা অম্বা মা হিসাবে সিংহবাহিনী প্রতিমার পুজা হয়। ৯ দিন ধরে সেই পূজা চলে। রাবণ দহণের ব্যপারটা দক্ষিণ ভারতে নেই, উত্তর ভারতের অবাঙ্গালী প্রধান এলাকাতেই সেটা হয়। রায়পুরেও সেটা ছিল।

রায়পুর সম্বন্ধে আর একটু কথা বলা দরকার। যেহেতু সাধারন ছত্তিশগডি লোকেরা খুবই সরল, তাই এখানে ডাক্তার মানেই হচ্ছে যে সুই লাগায়। লোকের বিশ্বাস যে সুই লাগালেই অসুখ সারে, সুই লাগানো মানে ইঞ্জেকশন দেওয়া। মিক্সচার বা ট্যাবলেটের উপর লোকের তত বিশ্বাস নেই।

কথা আছে এই ধরনের এক ডাক্তারের কাছে এক গ্রামের লোক এসেছে তার মায়ের জ্বরের জন্য ওষুধ নিতে। ডাক্তারকে আদ্ধেক কথা বলতে বলতেই সে একটা সিরিঞ্জে ডিস্টিল ওয়াটার নিয়ে ছেলের হাতে একটা সুই লাগিয়ে দিল আর ১০ টাকা নিয়ে নিল। দু দিন বাদে সেই গ্রাম্য লোকটি আবার ডাক্তারের কাছে এসে পেন্নাম ঠুকে বলল তুই খুব ভাল ডাক্তার রে, আমাকে সুই দিলি আর ঘরে বুড়ী মার জ্বরও নেমে গেল। তার কোন ব্যাথাও লাগল না। ভগবান তোর ভাল করুক। ঝড়ে কাগ মরল, আর ফকিরের কেরামতী বাড়ল।

আমাকেও এই ধরনের ডাক্তারের পাল্লায় পরতে হয়েছিল।  স্ত্রীর একটা দাঁত তোলানর দরকার পড়েছিল। তার দাঁতের একটু বিশেষত্ব ছিল যে তার রুট গুলো পাশের দিকে একটু বেঁকে থাকে। সেটা আমার জানা ছিল না। ডাক্তার প্রায় এক ঘন্টা ধরে ধ্বস্তাধস্তি করে দাঁত তো উপড়ে দিল। বাড়ি এসে দেখি রক্ত বন্ধ হচ্ছে না, আবার বিকেলেই তার কাছে নিয়ে হাজির।

এবার সিনিয়র ডাক্তার মাড়ীর অবস্থা দেখে বলে, একটু সেলাই দিয়ে দিচ্ছি। আর তার পরে আমার সামনেই সেই জুনিয়রকে প্রায় মারতে বাকী রাখে। এটা আমাকে একটু শিক্ষিত চেহারার দেখতে মনে হয়েছিল বলে হয়তো আমার জন্য করা হয়েছিল, নয়ত আবার সেই সেলাইএর সাথে আনুসঙ্গীক হিসাবে আরও কিছু তাঁকে গচ্চা দিতে হত।

টোটকা হিসাবে অল্প কাটাছেড়ার একটা ওষুধ যে মানুষের (নিজের) প্রস্রাব হতে পারে, সেটা আমি এই স্থানীয় লোকেদের কাছেই শিখলাম। আমার পুত্রদের নর্মাল বাচ্চাদের মতন রাস্তায় যা কিছু পাবে তাতে শট মারার অভ্যেস ছিল। একদিন আমার ট্রলীম্যানের সাথে অফিসের সহকর্মীর বাড়ী থেকে ফেরার পথে এই রকম শট মারার দৌলতে ছোট পুত্রের পায়ের  পাশে গেল অনেকটা কেটে। সেই ট্রলীম্যান আমার ছেলেকে বলে ঐ কাটার উপরে প্রস্রাব করতে। বাড়ী আসার পরে আমি দেখি রক্ত বন্ধ হয়ে গেছে। অবশ্যি আমি ধুয়ে ডেটল লাগিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু তার কাছেই শুনলাম যে ঐ টোটকা মহৌষধ প্রায়।

দুই ছেলের আরেক কীর্তির কথা না বললে ঠিক তাঁদের পরিচয় দেওয়া হবে না। বাবাকে দেখেছে ছোটখাট ইলেক্ট্রিকের কাজে কাউকে না ডেকে নিজেই ঠিক ঠাক করে নিতে। অতএব আমি অফিসে আর তাঁদের মা ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে ঘরে শুয়ে। এনারা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সুইচবোর্ডের সামনে গিয়ে ঠিক করলেন একটু পগিটিব (পজিটিভ) নেগেটিব খেলা যাক। ব্যাপারটা কিছুই নয়। একটা তার দিয়ে দেখেছে টেষ্টিং করার সময় পজিটিভ নেগেটিভ এক করলে স্পার্ক হয়, সেটাই তাঁরা করে দেখতে গেছিলেন।

একটা তার কোথাও থেকে জোগাড় করে, (ভাগ্যে সেটা ইন্সুল্টেড ছিল)  চেয়ারে চড়ে,( ভাগ্য সেটা কাঠের ছিল  ) প্লাগের দুই পিনের ফুটোতে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। বাস দড়াম করে আওয়াজ হয়ে ফিউজ উড়ে গেল আর এনারা চেয়ার শুদ্ধ হকচকিয়ে পপাত ধরণীতে। সামনের বাড়ির ভদ্রলোক দৌড়ে এসে টেনে তোলে, গিন্নী শোবার ঘরের থেকে বেড়িয়ে হাউ মাউ। আমাকে অফিস ফোন, আমি এসে বকুনী লাগিয়ে সব প্লাগ পয়েন্টের মুখ ব্ল্যাকটেপ দিয়ে বন্ধ করে রাখি। আর নয়ত তাতে যেটা চলে সেটাকে প্লাগটপ লাগিয়ে টেপ আটকে দিই যাতে খোলা না যায়।

বাঙ্গালীরা ভাতের সাথে যে তরকারী রান্না করি সেটাতে আলুর সাথে (আলু অতি অবশ্যি থাকবেই) অন্য একটা কি দুটো সব্জী নিয়ে রান্না হবে। ওখানের এক বাড়ির থেকে শেখা হল স্রেফ করলার তরকারী কি ভাবে রান্না করা যায়, যা দিয়ে ভাত মেখে খাওয়া যাবে। করলার গা একটু চেঁচে নিয়ে রাতে দইয়ের মধ্যে ফেলে দেওয়া হবে, টক দই, আর সকালে সেই করলা কেটে ঐ দইটা দিয়ে ঝোল ঝোল তরকারী। খেতে তেমন তিক্ততা থাকে না।

এতদিন আমার রান্না হত সরষের তেলে। প্রথম প্রথম ১৫ লিটার টিনের থেকে খুলে দোকান থেকে আনা হত। কিন্তু এই সময়ে সরষের তেলে শেয়ালকাঁটা ভেজালের সংখ্যা খুব বেড়ে উঠেছিল। বাধ্য হয়ে আমাকে ছোট সীলড টিনে চলে যেতে হল। নিতে শুরু করেলাম ইঞ্জিন মার্কা, কিন্তু তার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকায় বদল করে যেতে হন পোষ্টম্যান বাদাম তেলে। এই বাদাম তেলের রান্না তার পরে প্রায় প্রতি ঘরেই চলে এসেছিল তার কারণ ছিল সরষের তেলের বেশী দাম।

সাধারন দোকানপাট অধিকাংশই ছিল সিন্ধি রিফিউজী হয়ে যারা এসেছিলেন তাঁদের হাতে। পুর্ব পাকিস্তান থেকে যে সমস্ত বাস্তুহারা এসেছিলেন তাদের পুনর্বাসন করা হয়েছিল প্রধানত মধ্যপ্রদেশের বাস্তার এলাকা আর উড়িষ্যার কোরাপুট এলাকাতে। রায়পুরের কাছে ছিল অল্প দূরেই মানা।

এই মানাতে বিশ্বযুদ্ধের সময় রানওয়ে তৈরি হয়েছিল আর তার পাশে প্রচুর জায়গাতে তৈরী হয়েছিল এঁদের জন্য ট্রান্সিট ক্যাম্প। সেখান থেকে সুদূর পশ্চিম মধ্যপ্রদেশের রতলাম, নাগদা, উড়িষ্যার মাচকুন্ড, সুনাবেড়া এই সব জায়গাতে অল্প অল্প করে পরিবারদের পাঠান হত। অবশ্যি কতকগুলো জায়গাতে একসাথে অনেক পরিবারকেও পাঠান হয়েছিল যেমন উজ্জ্বয়িনী। কাজেই কৃষিজীবী বাঙ্গালী বাস্তুহারাদের হাতে কোন ব্যবসাই ছিলনা প্রায়।

এই জন্য প্রসঙ্গটা তুললাম, তার কারণ হচ্ছে এঁদের দোকানের সাজসজ্জা ছিল দেখবার মত। সাধারণ ভাবে যে সমস্ত দোকানগুলোতে চাল ডাল আটা ইত্যাদি বিক্রী হয় সেই সব দোকানেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখেছি মালপত্র গ্যালভানাইজড টিনের পাত্রে রাখা থাকত। অধিকাংশ মাল বাছাই করে পরিস্কার করে একটা চাকচিক্যময় চেহারা আনার চেষ্টা থাকত। এক দোকানির সাথে আমার এই নিয়ে কথা হয়েছিল যে এই যে বিজ্ঞাপনের দেখান জিনিষপত্রের মতন সাজানর চেষ্টা, তাতে যে খরচ হয় সেটা কি লোকের ঘাড় ভেঙ্গেই তোলা হয়।

তার উত্তর ছিল এই রকম। সেটা ঠিকই যে ক্রেতার মাথায় এর খরচ চাপবে, কিন্তু সব ক্রেতার উপরে নয়, কেননা তাহলে ক্রেতা কমে যাবে। যে জিনিষের চাহিদা বেশী, সেটা প্রায় সব দোকানেই পাওয়া যাবে। ক্রেতাকে আমার কাছে ডাকতে হবে বলে তাই তাতে দাম বিশেষ বাড়ান হবে না। আর অল্প বিক্রীর জিনিষে দামের বৃদ্ধির পরিমান বেশী হবে। আপনি আমার দোকানে চাল, ডাল আটা ইত্যাদি কম দামে নিয়ে পাচশ টাকা খরচ করলে, কি দশ টাকার এলাচ কেনার জন্য বিশ টাকা দেবেন না  অন্য দোকানে যাবেন? যুক্তিটা ঠিক বলেই আমার মনে হয়েছিল।

এই সময় আমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হল। আমি ছুটির দরখাস্ত দিয়ে দিলাম আর সেটা মঞ্জুর হয়েও গেল। ট্রেনের রিজার্ভেশন করা হয়েছে। বম্বে মেলে হাওড়া, আর তার পরে শেয়ালদহ থেকে শান্তিপুরে বাবার কাছে। বিয়ে গঙ্গার অপর পাড়ে, কালনাতে, মেয়ের দাদার বাড়ীতে।


যাবার ঠিক চার দিন আগে হঠাত ভিলাই রেলের ইঞ্জিন রিপেয়ারের কারখানাতে স্ট্রাইক। রেলের ভাষায় এমার্জেন্সী, সবার ছুটি সাস্পেন্ডেড। ষ্ট্রাইক মিটলে ছুটি পাওয়া যাবে।  দিন গোনা সুরু করেছি, কবে ষ্ট্রাইক উঠে যাবে। উঠেও গেল যে দিন আমার রওয়ানা হবার কথা সেই দিন দুপুরে। কিন্তু কর্তারা তো এত সহজে এমার্জেন্সী তুলবেন না। সেই এমার্জেন্সী উঠল সরকারী ভাবে বম্বে মেল ছাড়ার আরও এক ঘন্টা বাদে। আমার সব কিছু রেডি করেও ভাইয়ের বিয়েতে যাওয়া হল   না। তখন তো ঘরে ফোন নেই, তাই খবর দেবার জন্য চিঠি লেখা, আর সেটা পৌঁছতে দিন চারেক।

রবিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৫

আমার দেখা সত্তরের দশক

৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ শেষ হল। পূর্ব পাকিস্তানে যত পাকিস্তানী সেনা ছিল, তাঁদের যুদ্ধ বন্দী হিসাবে ভারতে নিয়ে আসা হল। বিলাসপুর আর রায়পুরের মাঝে একটা সাময়িক আস্তানা খোলা হয়েছিল, যেখানে তাঁদের বন্দী করে রাখা হয়েছিল। অবশ্যি মাত্র পাঁচ মা্সের মধ্যেই তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত পাঠান হয়। এই যুদ্ধের আর্থিক ক্ষতিপূরণ, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পরোক্ষ কর হিসাবে নেওয়া হল। পাঁচ পয়সার রিফিউজী রিলিফের ষ্ট্যাম্প, সমস্ত ডাক বিভাগীয় কাজ কর্মে লাগানো বাধ্যতা মূলক হয়ে গেল। ঐ সময় থেকে মুল্যবৃদ্ধির সূত্রপাত হল যেটা আজকেও কমে নি।

রায়পুরের পাশেই ভিলাইয়ের ইস্পাত কারখানা, আর তার জন্য মালের আনা নেওয়ার জন্য তৈরী হয়েছিল বিশাল এলাকাতে ভিলাই রেলের ইয়ার্ড। নাম ভিলাই মার্শালিং ইয়ার্ড। আর এত রেলের কাজ হচ্ছে, অতএব তার জন্য চাই কর্মীদলের থাকার জায়গা। ঐ ইয়ার্ডের পাশেই তৈরী হল এক বিশাল রেল কলোনী, নাম হল চারোদা বা বি এম ওয়াই, অর্থাৎ ভিলাই মার্শালিং ইয়ার্ড। চারোদা ছিল পুরনো ঐ জায়গার গ্রামের নাম।

ইয়ার্ডে লাইন বদল করার জন্য আর যাতায়াতের সুবিধার জন্য জায়গায় জায়গায় কেবিন ছিল। সাধারণত কোন ষ্টেশনে দুটির বেশী কেবিন হলে এ, বি, সি, ডি এই রকম ভাবে নাম রাখা হয়। এখানে এম পর্যন্ত চলে গেছিল বলে এরা নিজেদের পরিচয় অন্য ভাবে দিত। যেমন এইচ কেবিন নাম নিয়েছিল হাওড়া, ডি কেবিন দিল্লী, জি কেবিন গোন্ডিয়া, কে কেবিন কানপুর এই রকম। কিছু নাম ঐ ইংরাজী বর্ণমালা দিয়েও রেখে দেওয়া হয়েছিল।

দূর্গ-রায়পুর-বিলাসপুর অঞ্চলটাতে আমি যখন প্রথম যাই তখন রেলের লাইনের পাশে ধান, আর গমের ক্ষেত দেখতে পাওয়া যেত। কুড়ি বছর বাদে যখন আবার গেছি তখন সে জায়গাতে একের পর এক কারখানা তৈরী হয়ে গেছে, ধান ক্ষেতগুলো আর নেই। সাথে ধানের মিল গুলোর সংখ্যাও কমে গেছে। রায়পুরের পাশের ষ্টেশন ছিল সারোনা, যেখানে টি বি হাসপাতাল ছিল। হাসপাতালের চার দিকে বিরাট খোলা মাঠ আর ক্ষেত। এবার গিয়ে দেখতে পেলাম লাইনের পাশে হাসপাতালের ঠিক অপর পারে একটা স্পঞ্জ আয়রণের কারখানা হয়েছে। বায়ু দূষণের কথা চিন্তা করা হয় নি।

সারোনা থেকে আর একটু দূরে কুমহারী ষ্টেশন, ষ্টেশনের এক পাশে সালফ্যুরিক এসিড তৈরির কারখানা। অন্য পাশে কাপড়ের হোলসেল ভান্ডার। নানান জায়গা থেকে কাপড় আসে, পলিথিনে মুড়ে। আর সেই পলিথীনের সীট গুলো ছিড়ে কাপড় দোকানে দোকানে পাঠানর পরে সারা মাঠ ভরে থাকে ঐ পলিথীনে।

তার পরে ভিলাইয়ের ইস্পাত কারখানা, আর সাথে অনুসঙ্গী কাজের জন্য আরও কিছু কারখানা তৈরী হয়ে গেছে, এই সব জায়গাতে কাজের জন্য লোকের  দরকার অতএব তাঁদের বাসস্থান তৈরি হয়ে গেছে। আসলে দূর্গ থেকে রায়পুরের মধ্যে লাইনের পাশে খোলা জমি এখন আর দেখতে পাওয়া যাবে না।

আমি যখন ওখানে ছিলাম, তখন মান্ধার বলে একটা জায়গাতে এ সি সি র সিমেন্টের কারখানা তৈরী হল। টাকা বাঁচাতে তার চিমনীতে ডাষ্ট প্রেসিপিটেটর লাগানো হল না। ফল, কারখানার চারদিকে অন্তত তিন কিলোমিটার ব্যাসার্ধের জায়গাতে সিমেন্টের একটা আস্তরণ পড়ে গেল। প্রথমে কোম্পানি থেকে গ্রামের লোকেদের বলা হয়েছিল এই সিমেন্টের আস্তরণ ফলন বাড়াবে। কিন্তু পরে লোকে বুঝতে পেরে আন্দোলন করায় প্রেসিপিটেটর লাগানো হল। কিন্তু ততদিনে কাছের জমিগুলো আর চাষের যোগ্য রইল না।

টিলডা ষ্টেশনের কাছে সেঞ্চুরী সিমেন্টের কারখানা হবে, জমি চাই। এই জমি সংগ্রহের কাজে ছিলেন আমার চেনা এক ভদ্রলোক। কেউ জমি না দিতে চাইলে বা দামে না পোষালে, তার জমির চার দিকের জমি কিনে নেবার কাজ চালু হয়ে যেত আগে। কারণ তখন সেই অনিচ্ছুক চাষী তার জমিতে যাবার রাস্তা পাবে না। বাধ্য হয়েই আরও কম দামে সে এবার জমি বেচে দেবে।

ছত্তিশগড়ে যে উগ্রবাদী আন্দোলন এসেছে তার প্রধান কারণ হল এই রকম জোর করে গরীব চাষীদের ঠকিয়ে তাদের সম্পত্তি নেবার ইতিহাস। আমি ৭৭ সালে ছত্তিশগড় ছেড়েছি, তার পরেও এই আন্দোলন আরও উগ্ররূপ নিয়েছে। যদি সময় হয় তবে নব্বইয়ের দশকের কথাতে এই ব্যপারে লিখব।

রেলের যে বৈদ্যুতিকরনের কাজটা হচ্ছিল সেটাতে যদিও বেশীরভাগ কাজে কন্ট্রাক্টর নিযুক্ত থাকত তবুও রেলের নিজস্ব ভাবে কিছু কাজ করার জন্য সব সময়ই বেশ কিছু লোক লাগত। ৫৮ সাল থেকে এই যে সমস্ত লোকের দরকার হত তাদের কোন স্থায়ীত্ব ছিল না। কাজ শেষ তো ঘর যাও। অবশ্যি যে হেতু কাজ কোথাও না কোথাও হচ্ছে তাই এই সমস্ত শ্রমিকেরা দেশ দেশান্তরে ( এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে) ঘুরে ঘুরে কাজে যোগ দিত। কিন্তু সবাই তো আর যেতে পারেনা, তাই কেউ খুশী হয় আর কেউ না। 

৭১ সালের আগে থাকতেই এই শ্রমিকেরা একটা দাবী রেখেছিল যে তাঁদের অন্তত প্রাথমিক ভাবে এই সব কাজে অগ্রাধিকার দেওয়া হোক। এত দিন এই অগ্রাধিকারের ব্যপার ছিল না। সুপারভাইসরদের চেনা শোনার উপর এটা নির্ভরশীল ছিল। সেটা পাচ্ছে না বলে এরা এইবার ষ্ট্রাইক করে বসল।

আমাদেরও চাকুরী তখনও স্থায়ী হয় নি,  কাজেই আমাদের অবস্থা ওদের মতন না হলেও এমন একটা কিছু আলাদা ছিল না। ওদের আর আমাদের মধ্যে  একটা বিভাজন বরাবরই ছিল। তাই ওদের প্রথম রাগটা এসে পড়ল আমাদের উপরে। কাজে যাবার পথে আমাকে রাস্তায় কিছু শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হল। আমার ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলে একটা ফ্র্যাকচার এল।

রেলের তরফ থেকে তারা একটা সুযোগ পেয়ে গেল, আমাকে শহীদ বানানোর চেষ্টা হল। আমার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চারজন বন্দুকধারী আর পি এফ, ২৪ ঘন্টার জন্য মোতায়েন হয়ে গেল। রাতে আমার কোয়ার্টারের সামনে তাঁরা পাহারা দ্যায়। দিনে আমি কাজে গেলে সাথে যায়। কারুর সাথে মন খুলে কথা বলে যাবে না এই রকম অবস্থা করে দিয়েছিল।বন্ধু বান্ধবের আমার বাড়ী আসা বন্ধ হয়ে গেল।

বাধ্য হয়েই আমার বসের বসকে বলতে হল, ঘাট হয়েছে আমার,এবার তো কমলি হটাও। আমার আর কোন নিরাপত্তার দরকার নেই। ততদিনে অবস্থাও শান্ত হয়েছে দেখে পুলিশ পার্টীও তুলে নেওয়া হল। আমার বন্ধুরা আবার বাড়ীতে আসা শুরু করল।

এই সময় কাজের চাপটাও খুব বেড়ে গেছিল। তার কাটা, লাইনে দুর্ঘটনা লেগেই ছিল। এক দুপুরে হঠাত এই রকম দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আমি বেড়িয়ে গেছি। ঘরে এক বন্ধুর দুপুরে খাবার কথা আছে। আমার আশা ছিল যে সন্ধ্যের মধ্যেই ফিরতে পারব, কেননা তখনও খবর আছে যে বিশেষ কিছু হয় নি।

গিয়ে দেখি একটা ছোট ব্রিজের উপরে মালগাড়ী উল্টেছে, আর কম করে এক কিলোমিটারের মত জায়গাতে তার ছিঁড়ে একাকার কান্ড। লোকজন লাগিয়ে ঠিক করতে করতে লেগে গেল প্রায় ৪০ ঘন্টার মত। আমি ফিরলাম পরের পরের দিন সকালে। ঘরে কোন খবর দেবার উপায় ছিল না কারণ তখন মোবাইলের চলন হয় নি। বন্ধু এসে খেয়ে দেয়ে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করে তার ঘরে ফেরত গেল।

কাজের জন্য সকালে কাজে বেড়িয়ে যাই আর ফিরতে ফিরতে সেই মাঝ রাত হয়ে যায়। দুই ছেলেকে নিয়ে তাঁদের মা সংসার টেনে চলে।  এই অবস্থাতে সংসারের আয়তন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবার সম্ভাবনা হল। কিন্তু তার ফল হল অন্য ধরণের। আমার অনুপস্থিতিতে তার মানসিক টেন্সন বৃদ্ধি পেল। 


ভাবী আগন্তুক তার মাকে বেশ কিছু ভয় দেখানতে ডাক্তার বলে দিল হাসপাতালে ভর্তি করুন। অনেক রিকোয়েষ্টের পরে কমপ্লিট বেডরেষ্ট হবে, এই করারে বাড়িতে থাকার অনুমতি দিয়েছিল। পরে আর কোন  গণ্ডগোল না করে কন্যা সন্তান কোলে এলেন। 


শুক্রবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১৫

আমার দেখা সত্তরের দশক

(১)
৬৯ সালের মার্চ মাসে আমি চলে এলাম রায়পুরে। আর দিন দশেকের মধ্যে কোয়ার্টার পেয়ে গেলাম বলে এপ্রিলেই চলে গেলাম ছেলে বউকে নিয়ে আসতে।  মাল পত্র যদিও আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম তবুও আমার কপালদোষে সেগুলো এসে পৌঁছেছিল প্রায় দুমাস বাদে। ততদিন একটা কড়াই আর ছোট্ট হাঁড়ি সম্বল ছিল।

রান্না করব কি ভাবে। রান্নার ষ্টোভটাও যে ওয়াগনে, তবে? উপায় একটা সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। যে কোয়ার্টার পেলাম তাতে রান্নাঘরে সিমেন্টের উনুন তৈরী করা আছে। কাঠকয়লার অভাব নেই, সহজলভ্য। অতএব সেই উনুনে কাঠকয়লার আঁচে রান্না চালু হল।ভাগ্যে বিছানাটা ফ্যামিলির সাথেই এসেছিল। নয়ত রাতে যে কি ভাবে শোয়া হত সেটা এখনও ভাববার বিষয় হয়ে থাকে।

 আজকে ছত্তিশগড় কি রকম বদলেছে সেটা ঠিক বোঝাতে পারব না, কারণ রায়পুর ছোট্ট শহর এখন হয়েছে ছত্তিশগড়ের রাজধানী, সেখানে হয়েছে রেলের জোনাল হেডকোয়ার্টার। অতএব ৭০/৭১ এর রায়পুর, বিলাসপুর যেটাকে আমি মনে রেখেছিলাম তাঁকে পরে আমি আর চিনতে পারিনি। যেখানে আমার যৌবনের  আট বছর কেটে গেছে, সুখ দুঃখের মধ্যে দিয়ে সংসারের বৃদ্ধি হয়েছে, কাজে উন্নতি হয়েছে, সেই রায়পুর, বিলাসপুরকে, আমি বিশ বছর বাদে ৯০/৯২ সালে খুজে পাইনি।

 কি কি বদলে গেছে?  ফাফাডি নাকা পার হবার পরে ছিল আমার কোয়ার্টার। সামনে ছিল বিশাল মাঠ। দূরে দেখতে পেতাম, উড়িষ্যার থেকে আসা মজদূরেরা মাটির ঘর বানিয়ে আছে। দেয়াল আর মেঝে মাটির, ছাত খাপড়া বা দেশী টাইলের।

এদের মেয়ে বউয়েরা আমাদের ঘরে কাজ করতে আসত। এদের ডাকা হত রোতাইন নামে, ছত্তিশগড়ী ভাষায় মানে হল ঝি। কথাটা এসেছে মনে হয় রাউত কথার থেকে। আর বাড়ীটার পেছনে ছিল বড় রাস্তা (জব্বলপুরে যাবার জন্য), পার হলে রেলের লাইন পর্যন্ত সবজির ক্ষেত। এখন সামনে আরও নতুন কোয়ার্টার উঠেছে আর পেছনের সব্জীক্ষেতে হয়েছে রেলের অফিস।

এদিক ওদিকে এখন ফ্লাই ওভারের মেলা। আর শহরের সীমানা বাইরের দিকে বাড়তে বাড়তে দুদিকে প্রায় তিন চার কিলোমিটার দূরে চলে গেছে। জনসংখ্যা মনে হয় দশগুণ বেড়ে গেছে। আগে শহরের মধ্যে যাতায়াতের জন্য ছিল সাইকেল রিক্সা।  আর তাঁকে টানবার জন্য চালকদের অধিকাংশ ছিল কোরাপুট, কালাহান্ডী জেলার অধিবাসীরা। এখন এই রিক্সার সাথে পাল্লা দিয়ে দেখলাম বেড়েছে প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা।

রায়পুর শহরের গায়েই আগে দেখেছিলাম এক ধরণের ধানের ক্ষেত, যেখানে গাছটার রঙ ছিল বেগুনী। না পোকা লাগে নি। গাছগুলো ছিল একটু বেঁটে। খুব বেশি হলে এক হাতের মতন উচু হবে। নাম শুনেছিলাম কালীমুছ। সুগন্ধী, তবে ফলন অল্প। সে ক্ষেত বা সেই ধানের চাষ আর নেই।

এত দিন হুটকথায় বদলী হয়েছি, এবার শুরু হল অনেকদিন এক জায়গায় থাকার পালা। রায়পুরে থাকতে হল ৭৩ এর মাঝামাঝি পর্যন্ত আর তার পরে আরও চার বছর মানে ৭৭ পর্যন্ত বিলাসপুরে। রায়পুরেই দেখা পেলাম এক ধরনের লোকেদের যাদের স্থানীয় কথায় বলা হত মুশাহরা। অত্যন্ত দরিদ্র, নামের কারণ এঁদের খাবার। এরা সাধারণত মুশা বা ইদুর মেরে সেটাকে ঝলসে নিয়ে খেত। ধান কাটা হয়ে গেলে এদের দেখা পাওয়া যেত ক্ষেতের আসে পাশে ইদুরের গর্ত খুঁজে তাতে খুচিয়ে খুচিয়ে ইদুর বার করতে।

সাধারন লোক মানে ছত্তিশগড়ি লোকের মত সাদাসিদে  সরল লোক খুব কম দেখতে পেয়েছি। অনেকটা সেই পুরুলিয়ার লোকেদের মত। ঠিক জানিনা, হয়তো দারিদ্রতা সরলতার পরিপোষক। মানে যেখানে যেখানে দেখেছি সাধারণ মানুষের আর্থিক ক্ষমতা কম, সেখানেই কিন্তু দেখেছি তাঁদের মধ্যে অন্য লোকেদের বিশ্বাস করার একটা প্রবণতা আছে। আর তার প্রতিদান যদি আপনি দিয়েছেন তবে তারা যে কি চোখে আপনাকে দেখবে সেটা বলে বোঝান যাবে না।

আমার এক জন খালাসী (মজদূর) একদিন আমার কাছে হঠাত নিয়ে এল একটা রূপোর পৈছে (কোমরে শাড়ীর উপরে বেল্টের মতন করে পরা হয়)। ওজন হবে কম করে দু কিলোর মতন। কি ব্যপার এটা রেখে তাকে দুশ টাকা দিতে হবে, তার মার সম্পত্তি ওটা। আমি তাকে এই মারি সেই মারি করে তখুনি বাড়ী পাঠালাম, তুই আগে গিয়ে তোর মার কাছে তার জিনিষ ফেরত দে। আর এই নে টাকা। কেন তোর টাকার এত দরকার পড়েছে। প্রথমে বলতে চায়নি, কিন্তু পরে বলেছিল যে কোন মহাজনকে সুদের টাকা দেবার জন্য।  তখনকার দিনে ঐ গহণার দাম ছিল কম করে হাজার দুয়েক, কি তার চেয়েও বেশী।

ইতিমধ্যে বাবা আর মা তাঁদের কলকাতার বাস গুটিয়ে চলে গেছেন শান্তিপুরে। দেশের মাটীতে শেষ বয়সটা কাটাবার কথা চিন্তা করে। তার ছেলে দুজন( আমার বাকি দুই ভাই )কলকাতায় চাকরী করে, আমি বাইরে চাকরী করি আর বোনেদের বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়ী চলে গেছে। মানে দুই বুড়োবুড়ী একা থাকবে। কি আর বলা যায়।  আমি বছরে সপরিবার একবার করে যাই, এক মাসের মতন থেকে আসি।   বাকী ভাই বোনেরা সুযোগ পেলেই ঘুরে যায়। আর বাবা আর মা দুজনে মিলে বাড়ীর লাগোয়া বাকী সাত আট কাঠা জমিতে তাদের নাতী নাতনীরা এসে আম জাম খাবে, এই ভেবে বাছাই করা কলমের ফল গাছ লাগিয়ে তার পরিচর্যা করেন।

শান্তিপুর জায়গাটা গঙ্গার গতিপথ বদল হওয়াতে গঙ্গার বালি মিশ্রিত পলি দিয়ে তৈরী। আমাদের বাড়ী তৈরির সময় (বাবা যে নতুন বাড়ী তৈরী করেছিলেন ) ভিত খুড়তে গিয়ে নৌকোর ভাঙ্গা বৈঠার টুকরো বালির মধ্যে পাওয়া গেছিল। আসলে বালি বলতে যে জিনিষটা সাধারণত বাড়ি তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়, সেটা গঙ্গার পূর্ব পাড়ে বিশেষ পাওয়া যেত না। যে বালিটা পাওয়া যেত সেটা সাদা মিহি বালি। কাজেই সেটা কেবল পলেস্তারার কাজে ব্যবহার হত। গাথুনীর কাজে বালির বদলে ইট ভাঙ্গা সুরকী আর চুণের কাজ বেশী হত।


আমাদের বাড়ী ছিল কাদা দিয়ে গাথা, ইটের পাকা বাড়ী। ছাদ কাঠের কড়ি বরগার উপরে চুন সুরকীর পেটা। দেওয়ালে অবশ্যি চুন বালির পলেস্তারা। শান্তিপুরে দেখেছি পঙ্খের কাজ। এটা হচ্ছে কলি চুণ দিয়ে দেওয়ালে পলেস্তারা, যাকে মেজে পালিশ করে দেওয়া হত। শুখোনর পরে এটা প্রায় মার্বেলের মত দেখাত। এর উপরে  ম্যুরালের মতন করে রঙ দিয়ে আলপনা আঁকা হত।  এই বাড়ী তৈরির সময়, আমি ছুটি নিয়ে গিয়ে কাজ দেখতাম। যে হেড মিস্ত্রী ছিল তার নাম ছিল বজ্জাত  বয়স তখন প্রায় পঞ্চাশ পঞ্চান্নর কাছাকাছি। তার কাছেই এই পঙ্খের কাজ করার প্রশেস জেনেছিলাম। সে বলেছিল যে আজকাল আর এই কাজের মিস্ত্রী পাওয়া যায় না, কেননা এত দাম দিয়ে আর কেউ বাড়ী বানায় না। শান্তিপুরে এই রকম পঙ্খের কাজ করা বাড়ী বেশ কয়েকটা ছিল।