মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

কনটিকির উলটো পথে

তাহিতি-নুইএর যাত্রা


থর হেয়ারডালের তত্ব ছিল, পলিনেশিয়ান দ্বীপ সমূহে আমেরিকার থেকে লোকে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিল। সেটা কিন্তু অনেক পলিনেশিয়ান দ্বীপবাসীর মনে ঠিক বলে মনে হয়নি। এই রকন একজন ছিলেন এরিক দ্য এরিক, একজন ফরাসী ধনী ব্যারণ, যিনি তাহিতি দ্বীপে বাস করছিলেন।  প্রায় ত্রিশ বছর ধরে তিনি বাঁশের তৈরী ভেলা আর পলিনেশীয়দের নৌচালনার কৌশল নিয়ে  পড়াশুনা করে ঠিক করে ফেললেন যে পলিনেশিয়া থেকে এই বাঁশের ভেলায় চড়ে দক্ষিন আমেরিকায় গিয়ে থরের দেওয়া তত্ব ভুল প্রমাণ করে দেবেন।

কে এই এরিক বিশচপ? বাবা তাকে পাঠিয়েছলে সমূদ্র স্রোতের বিষয়ে অধ্যয়ন করতে। তার মনে বিশ্বাস ছিল যে সাধারণতঃ এই বিষয়ে শিক্ষা নেবার পর যেমন অন্য ছেলেরা অফিসে বসে কাজ করে সে রকম তার ছেলে এরিক অফিসে চাকরী নেবে। কিন্তু সমুদ্রের আকর্ষণ তার ছিল অসম্ভব। তাই সুযোগ পেলেই তিনি জাহাজে চাকরী নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। আর তা ছাড়া তার মনে পলিনেশীয় দ্বীপ গুলোর উপর একটা আলাদা আকর্ষন ছিল।

১৯৩২ নাগাদ চীন দেশে থাকার সময় তিনি ফু-পা নামে এক জাঙ্ক শ্রেণির নৌকো কিনে সমূদ্র যাত্রার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তাইওয়ান উপকূলে তার নৌকো ঝড়ে পরে ভেঙ্গে যাবার পরে তিনি ফু-পা ২ নামের আর একবার নৌকো বানিয়ে সমূদ্রযাত্রা করলেন লক্ষ হল প্রথমে ফিলিপাইন। ফু-পা ২, ফু-পা প্রথমের চেয়ে ১২ টন হালকা হওয়াতে একে চালানো অনেক সহজ হয়েছিল।  মিনডানাও পৌঁছানোর পরে মনে হল যে গালাপাগোস দ্বীপ ঘুরে গেলে কি রকম হয়।

 উদ্দেশ্য ছিল যে নিরক্ষীয় সমূদ্রস্রোত  ধরে তার যাত্রা, তার এশিয়া আমেরিকার মধ্যে যোগাযোগের তত্বকে প্রমাণ করবে। কিন্তু  সামূদ্রিক জলজ পোকার আক্রমনে তার নৌকো ক্ষতিগ্রস্থ হওয়াতে তার অভিষ্ট লক্ষের দিকে না গিয়ে তিনি ঠিক করেন যে অষ্ট্রেলিয়া ঘুরে পূর্ব দিকে সিডনীতে যাবেন। কিন্তু ঝড়ের জন্য তার নৌকো অষ্ট্রেলিয়ার উত্তর-পশ্চিম দিকের শহর ব্রুমে পৌছায়। সেখানে কিছু মেরামতি করে নিউগিনির দক্ষিণ দিয়ে সীডনীর দিকে রওনা দেন। কিন্তু আবার ঝড় এসে তাকে নিউগিনির উপকূলে ছেড়ে দ্যায়।

সেখানে কিছুদিন বিশ্রাম নেওয়ার পরে এরিক ঠিক করেন যে  চীন থেকে তিনি যে কিউরিও কিনে ছিলেন সেগুলোকে আমেরিকাতে বিক্রী করে টাকা জোগাড় করা যেতে পারে। সেই  ইচ্ছা নিয়ে তিনি এবার উত্তর দিকে নৌকোর মুখ ঘোরান, এবং মার্শাল দ্বীপপূঞ্জে এসে পৌঁছান। সেই সময় মার্শাল দ্বীপ জাপানীদের দখলে ছিল তাই তারা নামা মাত্র তাদের বন্দী করা হল।

কিন্তু দিন ১৫ বাদে তাদের ছেড়ে দেওয়া হলে তারা হাওয়াইএর দিকে রওয়ানা দেন। কিন্তু বন্দী থাকার সময়ে তাদের নৌকোতে খাবার যা ছিল সেগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়াতে তারা প্রায় অভুক্ত অবস্থাতে হাওয়াই পৌঁছান। ফু পা দ্বিতীয়, মোলোক্কাই দ্বীপে আছড়ে পরে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।

হাওয়াই দ্বীপে এরিক ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত কাটান  আর ঠিক করেন যে  পলিনেশীয় নৌকোর মত ক্যানো তৈরী করে ফ্রান্সের দিকে রওয়ানা দেবেন। সঙ্গী তাতি এর যদিও ইতিমধ্যেই সমূদ্র সম্বন্ধে বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে তবুও ফ্রান্সের নামে তিনি রাজী হলেন। 

১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে ৩৭ ফুট লম্বা একটা ছোট্ট ডবল হাল বিশিষ্ট ক্যানোতে ফ্রান্সের উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন। নৌকোর নাম দিলেন কাইমিলোয়া। এই কাইমিলোয়া কে  দেখা গেল তার আগেকার নৌকোগুলোর চেয়ে অনেক  দ্রুতগামী আর জলে অনেক স্থিতিশীল।  হাওয়াই থেকে ২৩০০ মাইল দূরের ওয়ালস দ্বীপ পৌছতে সময় লাগল মাত্র এক মাস।

সেখান থেকে নিউগিনীর দক্ষিণ দিয়ে বালি হয়ে ভারত মহাসাগর পার হবার দরকার।   বালি থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা অন্তরীপ পার হতে তার সময় লাগল মাত্র ৫৯ দিন।  কিন্তু এই অন্তরীপ পার হবার পরে স্রোতের সাহায্য না পাওয়াতে ট্যাঞ্জিয়ার পৌছতে সময় লেগে গেল আরও ১০০ দিন। অবশেষে তারা পৌঁছলেন ফ্রান্সের ক্যানে শহরে।  এত দিনের সঙ্গী তাতি এবার বিদায় নিল।

কিন্তু এরিক তার যাত্রার কথা মাথা থেকে সরান নি। কাইমিলোয়া কে তার ইচ্ছে মত অদল বদল করতে গিয়ে তিনি প্রায় এক নতুন নৌকোই বানিয়ে ফেললেন, যার নাম দিলেম কাইমিলোয়া-বাকিয়া। ইতিমধ্যে তিনি  এক নতুন সঙ্গী, উহু সঙ্গিনী পেয়েছেন। তাকে বিয়ে করে হনিমুন করতে দক্ষিন সাগর মানে পলিনেশিয়ার দিকে যাবার জন্য বেড়িয়ে পড়লেন ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে। ইউরোপে তখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তার যাত্রা কিছুদিন বাদেই ফ্রান্সের পতন হল। কিন্তু ততদিনে তিনি সমুদ্রে।

বিপদ এল অন্য দিক থেকে। ক্যানারী দ্বীপের কাছে এক রাতে তার নৌকোর সাথে এক স্পেনীয় মাছ ধরার নৌকোর ধাক্কা লাগলে কাইমিলোয়া দুটুকরো  হয়ে ডুবে যায়। ঐ মাছ ধরার জাহাজ তাদের উদ্ধার করে।
ফ্রান্সে ফেরত এলে তার চিন্তা হয় অর্থের দিকে। ফ্রান্সে তখন আছেন  ভিচী সরকার। মার্শাল পেতাঁকে তিনি পছন্দ করতেন তাই  কিছুদিন বাদে তিনি হনুলুলুতে  ভাইস কন্সাল হিসাবে নিযুক্তি নিয়ে সস্ত্রীক চলে আসেন।  ভিচি সরকারের পতনের পরে অর্থের জন্য তিনি এক স্থানীয়  ব্যবসায়ীর সাথে যোগ দেন এবং চেং হো নৌকো নিয়ে তাহিতি থেকে শুখনো কোপরা আনার কাজে নেমে পড়েন।

 কিন্তু প্রথম যাত্রায় লোকসান হওয়াতে তার সাথে মামলা হয়। নিজেকে বাঁচতে তিনি ঐ নৌকো নিয়ে কাউকে না জানিয়ে তাহিতি পালিয়ে যান।  এটা ছিল ১৯৪৯ সালের ঘটনা।
এরিক মনে করতেন যে নৃত্বাত্তিকেরা যদি মনে করেন যে পলিনেশিয়াতে বাইরে থেকে লোকেরা এসেছিল এবং যেহেতু সেখানকার গাছপালার সাথে দক্ষিণ আমেরিকার গাছপালার মিল আছে তাই সেগুলো দক্ষিণ আমেরিকার থেকে উপনিবেশকারীরা পলিনেশিয়াতে তাদের সাথে এনেছে তাহলে সেটা ভুল হবে তার কারণ হিসাবে তিনি বললেন এটাও তো হতে পারে যে পলিনেশিয়ার নাবিকদের দক্ষিণ আমেরিয়ার সাথে যাতায়াত ছিল যাতে দুই দেশের মধ্যে এক সাংস্কৃতিক বন্ধন গড়ে উঠেছিল।

তার মতে এই পলিনেশীয় লোকেদের নৌকোতে করে যাতায়াত, ঈষ্টার দ্বীপ এবং তার ওপারে দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত আর পূর্ব দিকে ইন্দোনেশিয়া হয়ে ভারত হয়ে আফ্রিকার মাদাগাস্কার পর্যন্ত ছিল। এটা ২০০০ বছর আগের কথা এর পরে আমেরিকাতে ইউরোপ থেকে ক্যারিবিয়ান দ্বীপে স্পেনীয়ার্ড দের আগমন হয়েছিল।

জেনেটিক বিচারেও দেখা গেল যে মাদাগাস্কারের  লোকেদের সাথে পলিনেশিয়ান দ্বীপের বাসিন্দাদের যথেষ্ট মিল আছে। কিন্তু তারা যাতায়াত করত কি ভাবে , কি ধরনের নৌকো নিয়ে ।
তার বিশ্বাস হল যে পলিনেশিয় দ্বীপের লোকেরা তাদের বিভিন্ন যাত্রার জন্য বিভিন্ন ধরণের নৌকো ব্যবহার করত। কারণ তারা যথেষ্ট নৌবিদ্যায়  বিশারদ ছিল। তার ধারনা হল যে ছোট হাল্কা ক্যানো অল্প গভীর জলে সহজেই যেতে পারে  আর বর্তমান ধরণের দুই হালের ক্যানো কোথাও আক্রমন করে চটপট চলে যাবার কাজেই ব্যবহার করা যাবে। তাহলে নিশ্চয় তার চেয়ে বড় ভেলার মত কিছু ব্যবহার করা হত। কিন্তু সেটা তৈরী হত কি দিয়ে। যেহেতু বালসা গাছ পলিনেশিয় দ্বীপে পাওয়া যেত না তাই তিনি ভাবলেন যে এটা নিশ্চয়ই বাঁশ দিয়ে তৈরী ছিল। 
   
 কিন্তু কি রকম চেহারা হবে সেই ভেলাটার। এরিকের মনে চিন্তা ছিল যে যখন পুরনো ইতিহাস থেকে কোন রকম ছবি বা বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে না তখন নৌবিদ্যার হিসাব অনুযায়ী ভেলা টা বানানো হোক। শুরু হয়ে গেল সেই ভাবেই ভেলা তৈরি করার।

যেহেতু এটা মানুষের সহ্যশক্তির পরীক্ষা নয় তাই ভেলার উপরে বানানো হল একটা ঘর প্লাইউড দেওয়া আর যতদুর সম্ভব খাবার মজুত করা হল। হিসাব করে দেখা গেল যে দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত যাত্রা সম্পুর্ণ করতে মাস চারেক লাগতে পারে তাই একটু বেশী করে পাঁচ মাসের জন্য খাবার নেওয়া হল। কি ধরনের খাবার। বিয়ার আর লেমনেড। কলার কাঁদি, আলু পিঁয়াজ, কুমড়ো আর নারকেল। পাকা এবং কাচা ডাব হিসাবে।  আধুনিক যন্ত্রপাতি হিসাবে সাথে রইল  ইকো সাউন্ডার, রেডিও যোগাযোগের জন্য। ডার্করুম, ছবি তুলে তাকে ইতিহাসের পাতায় রাখার জন্য।
সঙ্গী হিসাবে রইলেন এরিক কে নিয়ে পাঁচ জন। এলাইন ব্লুম, তার দাদা মাইকেল। জুয়ানিটো আর ফ্রান্সিস কাওয়ান। যেদিন যাত্রা শুরু করা হবে সেদিনের চেহারাটা তাহিতিতে একেবারে উতসবের মত। ড্রাম বাজছে, গান হচ্ছে। যত লোক আছে দ্বীপে, তারা এসে ঘাটে জমা হয়েছে, মেয়েরা উপাউপা নাচের সাথে গান গেয়ে ভেলাকে বিদায় জানাচ্ছে।  লোকেরা তার আগে যার যা ইচ্ছে হয়েছে তাই যাত্রীদের রসদ হিসাবে দিয়ে গেছে। এমন কি তার মধ্যে একটা শূকরছানাও ছিল, যাতে রাস্তায় মাংস খাবার ইচ্ছে হলে তার মাংস খাওয়া যেতে পারে। বেশ কিছু মুরগীও সাথে নেওয়া হল যাতে প্রোটিনের অভাব না হয়। যদিও দরকার মতন সামূদ্রিক মাছ ধরে খাবার কোন বাধা তো নেই যে আমার মাছগুলো তুই ধরে খেয়ে নিচ্ছিস বলে কেউ তেড়ে আসবে।  কম করে গোটা পঞ্চাশেক ক্যানো তাহিতি নুইএর সাথে তাকে সমুদ্রে কিছুটা এগিয়ে দেবার জন্য সাথে যাচ্ছে। একটা জাহাজ এসে তাহিতি নুইকে টেনে বন্দর ছাড়িয়ে বার সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিল। এইবার তাহিতি নুই একা চলল। তারিখটা ছিল ১৯৫৬ সালের নভেম্বর মাসের ৬ তারিখ।

যাত্রা শুরুতেই বিপদ। ভেলার যা ওজন নেবার ক্ষমতা তার চেয়ে অনেক বেশি মাল নেওয়া হয়েছে। লোকেদের উতসাহে যে এত রসদ নিতে হবে তা নক্সা বানানোর সময় মনে রাখা হয় নি। উপায় হয় কিছু মাল জলে ফেলে দিয়ে হাল্কা হওয়া আর নয়তো ফিরে গিয়ে আরও কিছু বাঁশ কেটে ভেলাকে জলের উপরে ভাসিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করা। এমনিতে ৮০০ মোটা মোটা বাঁশ কেটে ভেলার প্রাথমিক চেহারাটা তৈরী করা হয়েছিল।

এরিক ঠিক করল যে ফেরত গিয়ে আরও কিছু বাঁশ কেটে ভেলাকে শক্ত পোক্ত করা হোক। কিন্তু তাতে বিপদ একটা যাত্রার শুরুতেই ফেরত গেলে লোকে ঠাট্টা করতে আর বাকী রাখবে না। তাই এরিক যখন বন্দর থেকে ভেলাকে টেনে নিয়ে যাবার জন্য জাহাজের সাহায্য চাইল তখন একথাও বলে দিল যেন তাদের কোন এক দূরের খাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় যাতে লোকে বিশেষ নজরে না পড়ে। তাই হল, তাহিতির দক্ষিণ দিকের  একটা দূরের খাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হল আর যথেষ্ট পরিমাণ বাঁশ কেটে ভেলাকে আরও মজবুত করা হল। এবার আবার যাত্রা হল শুরু দক্ষিণ দিকে অষ্ট্রাল দ্বীপসমুহের দিকে।

যাবার কথা ছিল  রুরুটি দ্বীপের পূর্ব দিক দিয়ে, কিন্তু এই প্রথম তাদের সাথে হাওয়া উলটো দিকে বইতে শুরু হল। উলটো দিকে ভেলা চলতে শুরু করলে, দ্বীপগুলোকে পাক মেরে তাদের পশ্চিম দিক দিয়ে দক্ষিণ সমুদ্রে ভেলা এসে পড়ল। ১৯৫৬ সাল শেষ হয়ে ১৯৫৭ সাল যখন শুরু হল, তখন ভেলা দক্ষিণ সমুদ্রে ৩৩ ডিগ্রী ধরে পুর্ব দিকে চলছে আর গন্তব্য চিলির উপকূল থেকে মাত্র ৫০০০ মাইল দূরে আছে।

এইবার  অনুকুল হাওয়া আর স্রোতের সাহায্য পেয়ে ভেলা আগে এগিয়ে চলল। ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত আবহাওয়া ভাল, কিন্তু বৃষ্টি না হওয়াতে জলের কষ্ট হতে পারে বলে মনে হচ্ছিল।  ফেব্রুয়ারি মাসের ২৩ তারিখা ভেলা তার যাত্রাপথের মাত্র আদ্ধেক রাস্তা পার হতে পেরেছে। কাজেই এই গতিতে চললে তাদের চিলি পৌছাতে পাঁচ মাসের বেশী লেগে যাবার কথা। ততদিন রসদের জোগান থাকবে কিনা সন্দেহ আছে। আর তাছাড় ভেলার সমূদ্রের জলে ইতিমধ্যেই পাঁচ মাসের বেশি হয়ে গেছে আরও মাস তিনেক টিকবে কিনা তাও একটা ভাববার বিষয়।

আশায় ভর করে যাত্রীরা ভাবতে সুরু করল যে এবার নিশ্চয়ই ভাল দিনের দেখা পাওয়া যাবে। কিন্তু উলটো হল, এবার হাওয়ার দিক ঘুরে পূর্ব দিক থেকে বইতে শুরু করল। যদিও প্রথম প্রথম ইচ্ছে ছিল যে ৪০ ডিগ্রীর গর্জনকারী চল্লিশা হাওয়ার আর স্রোতের সাহায্য নিয়ে যাওয়া হবে যেখানে বছরে সারা সময় পশ্চিম দিক থেকে হাওয়া আর স্রোত বয়ে চলে। কিন্তু  ৩৩ ডিগ্রীতে ভাল অবস্থা পেয়ে, আর দক্ষিণ দিকে নামা হয়নি। এখন সেদিকে গেলে ভেলা হাওয়ার ধাক্কা সহ্য করেতে পারবে কিনা সে সন্দেহ মনে দেখা দিতে শুরু করল।

এদিকে মার্চ মাসের প্রথম দিকে দেখা গেল তারা আবার সেই পনের দিন আগেকার অবস্থানে ফেরত এসেছে তখন যাত্রীদের মনের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে উঠল, তারা কাছের ঈষ্টার দ্বীপে যাবার কথা চিন্তা করতে লাগল। অবশ্যি এরিক কিন্তু তার মুল লক্ষ্য থেকে একফোঁটাও নড়েনি।

ভেলা আগে এগিয়ে চলেছিল। জলের অভাব মে মাসে হঠাত এক রাতে বৃষ্টি হয়ে পূর্ণ হয়ে গেল। শুকরছানার কপালটা খুবই ভাল ছিল। একদিন যখন মুরগির মাংস খেয়ে অরুচি ধরে গেছে তখন ঠিক করা হল যে পরের দিন ওটাকে কেটে রান্না করা হবে। কিন্তু ফ্রান্সিস পরে দিন একটা শুশুক ধরাতে, তার মাংস রান্না করা হল আর শুকরছানা বেঁচে গেল। পর পর দুবার এই রকম হবার পরে সেই শুকরছানাকে ধরে নেওয়া হল ষষ্ঠ সহযাত্রী, তার নাম দেওয়া হল চানচিতা এবং তাকে প্রত্যহ যোগ্য মর্যাদাতে সাথে নিয়ে খেতে বসা হত।

ম্যাস্কট  হিসাবে আরও তিন বিড়াল ছানার ভাগ্য ছিল এই যাত্রায় সঙ্গী হবার। অবশ্যি রাস্তায় তাদের একজন দেহত্যাগ করলে পরে, তার জায়গা ভর্তি করার কোন সুযোগ ছিল না বলে সেটা খালি থেকে গেছিল। আরও কিছু সঙ্গী সহযাত্রী হিসাবে সাথে যাচ্ছিলেন। ভেলা যখন ঘুরে আবার হাইতির খাঁড়িতে যায় তখন কিছু ছোট মাছ ভেলার নীচে আশ্রয় নিয়ে সাথে সাথে যাচ্ছিল।  

মে মাসের এক ঝড়ে দেখা গেল ভেলার থেকে চারটে বাঁশ খুলে ভেসে গেছে। সেগুলো ছিল প্রধান অঙ্গ ভেলার।  ঝড় চলাকালীন দেখা গেল যে আরও একটা বাশ খুলে ভেসে যেতে শুরু করেছে। সেটাকে তুলে নিয়ে দেখা গেল যে তাতে পোকার আক্রমন হয়েছে আর সেটাকে ভাঙ্গার পরে টুকরো গুলো আর ভেসে থাকার যোগ্য রইল না। তখনও গন্তব্য স্থল চিলি আরও ৮০০ মাইল দূরে ।

মে মাসের মাঝামাঝিও এক ঝড়ের সময় দেখা গেল ভেলার নাবিকেরা আর আলেক্সান্ডার শেলকার্ক  হয়ে হুয়ান ফার্ণান্দেজ দ্বীপে যেতে পারছে না, তখন বাধ্য হয়েই হাইতিতে রেডিও যোগাযোগ করা হল যাতে কোন এক জাহাজ এসে তাদের টেনে দ্বীপে পৌঁছে দ্যায়। সেখানে আবার ঠিক মতন বাঁশ লাগিয়ে মেরামতি করে আবার বাকী যাত্রাটা সম্পুর্ণ করা হবে।

মে মাসের ২২ তারিখে চিলির এক নৌবাহিনীর জাহাজের সাথে দেখা হলে তাকে অনেক বোঝানর পরে ভেলাকে টেনে কাছের দ্বীপে পৌঁছে দেবার জন্য রাজী হয়। কিন্তু এই টানাটানির সময় জাহাজের সাথে ভেলার ধাক্কা লাগলে ভেলার একদিকের কিছু বাঁশ ভেঙ্গে যায় আর ভেলা ডুবতে শুরু করে। ২৬ তারিখে যাত্রীরা  তাহিতি নুই কে বিদায় জানিয়ে নৌবাহিনীর জাহাজে উঠে পড়েন। মায় শুকরছানা এবং বিড়ালছানা শুদ্ধ। সাথে নিয়ে আসা গেল না সঙ্গী ছোট মাছের দলকে, যারা সেই সুদূর হাইতি থেকে সাথে সাথে চলছিল। তাহিতি নুইএর যাত্রা সম্পুর্ণ না হলে প্রায় কাছেই পৌঁছে গেছিল।


এরিকে এরিকের চিন্তায় কিন্তু তখনও তার সমূদ্রের যাত্রা শেষ হয়। সেই যাত্রার  বিবরন পরে দিচ্ছি।

সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

রা য়ের অভিযান আফ্রিকা থেকে আমেরিকা

ঘাসের ভেলায় সমুদ্রে পাড়ি

সময়টা ছিল ষাটের দশকের মাঝামাঝি। কনটিকির যাত্রা শেষ হবার পরে থর হেয়ারডালের চিন্তা আসে যে দক্ষিণ আমেরিকার থেকে যেমন ইনকাদের পলিনেশিয়াতে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল সেই রকম নিশ্চয়ই আফ্রিকা থেকেও ক্যারিবিয়ান দ্বীপসমুহে যাওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ইউরোপের লোকেদের ধারণা ছিল যে কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরী জাহাজের সাহায্য ছাড়া কোন মহাসাগর পারাপার করা সম্ভব নয়। আর কাঠের ব্যবহার তক্তা হিসাবে তখনই সম্ভব যখন ধাতুর ব্যবহার শুরু হয়েছে। কাজেই সাগরের পাড়ি দেবার চিন্তা থাকা ঐ প্রাগৈতিহাসিক যুগে সম্ভব ছিল না।  কিন্তু থরের চিন্তা এল নিশ্চয় কিছু গাছের মত কোন জিনিষের ব্যবহার করা হয়েছিল যেটা একসাথে করে তক্তার বদলে ব্যবহার করা  হয়েছিল।
যেহেতু আফ্রিকাতে বালসা গাছ হয় না তাই তার নজর গেল আবার ঐ দক্ষিণ আমেরিকার টিটিকাকা অঞ্চলে পাওয়া যায় টোটোরা ঘাসের  দিকে। তাদের জল নিরোধক ক্ষমতার জন্য টিটিকাকা হ্রদের উপরে উরু সম্প্রদায়ের লোকেরা এই ঘাস দিয়ে তৈরী দ্বীপের উপরে ঘাসের তৈরী বাড়ীতে বসবাস করে এবং তারা এই ঘাস দিয়ে তৈরী নৌকোতে চড়ে শিকার করে। দেখা গেল যে আফ্রিকাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায় যে প্যাপিরাস গাছ  বা ঘাস, সেটাও ঐ একই গোত্রের গাছ, কাজেই অনুমান করা হল যে তার ক্ষমতাও একই রকমের। কিন্তু  প্যাপিরাস ঘাসের বিশেষজ্ঞেরা এই ব্যপারে একেবারেই সহমত ছিলেন না। তাদের মতে এই দীর্ঘ তিন হাজার মাইলের জলযাত্রা প্যাপিরাসের পক্ষে সম্ভব নয়, কেননা স্বাদু জলেই প্যাপিরাস দিন পনেরর মধ্যেই পচে যায়্ তো নোনা জলের প্রভাব আরও ভয়ঙ্কর হবে।
ঐ  বৈজ্ঞানিকেরা একটুকরো প্যাপিরাসকে জলে ফেলে দিয়ে প্রমান করতে চাইলেন যে সেটা জলে ডোবে। তার উত্তরে থরের বক্তব্য ছিল, এই প্রমাণ দ্বারা এটাই বোঝা যায় যে লোহার তৈরী জাহাজও জলে ডোবে।
অনেক ভাবনা চিন্তার পরে মিশরের সরকার রাজী হলেন যে গিজার কাছে এই রকম একটা জাহাজ তৈরী করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। থর জোগাড় করে নিলেন চাদ এর থেকে বুদুমা জাতির আদিবাসী দের জাহাজ বানানোর জন্য। কারণ হল এই জাতির লোকেরা এখনও দক্ষিন আমেরিকার উরু জাতির মত ভাসমান দ্বীপে বাস করে। কিন্তু জাহাজ তৈরী করতে একটা নক্সা চাই, আর সেই অনুযায়ী প্যাপিরাস ঘাসের জোগাড়ও চাই।
সুইডেনের বিয়র্ণ ল্যান্ডষ্ট্রম একটা নক্সা বানিয়ে দিলেন যে কি রকম দেখতে হওয়া উচিত এই জাহাজের। হিসাব করে দেখা গেল কম করে তিন লাখের মত প্যাপিরাস ঘাসের কান্ডের দরকার পড়বে, কোথায় পাওয়া যাবে? ঠিক করে ফেললেন ইথিয়োপিয়ার টানা হ্রদে এসব গাছগুলোকে আবাদ করা হবে। কিন্তু আনা হবে কি ভাবে, কারণ তখন আরব-ইস্রায়েল যুদ্ধ চলছে সুয়েজের আশে পাশে। কিন্তু থরের মত লোক এই সব কিছুতে পিছোতে  রাজী থাকেন না। ৫০০০ বছর বাদে আবার সেই প্যাপিরাসের জাহাজ তৈরির কাজে তিনি হাত লাগালেন।  শুধু তৈরী নয়, তার পরে সেটাকে নিয়ে মরক্কোতে যাওয়া, যেখান থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেবার যাত্রা শুরু করা হবে।
এই জাহাজ তৈরির সময় থর মাঝে মাঝে গিজার সমাধিগুলোতে গিয়ে দেখে আসতেন যে তার কাজের সাথে পুরনো দিনের জাহাজের ছবির কতখানি মিল আছে।। একটা জিনিষ তাকে ভাবাচ্ছিল। পুরনো দিনের ছবিতে একটা দড়ির টানা জাহাজের সামনে থেকে পেছনের হাল পর্যন্ত দেখানো হচ্ছিল। থর বা তার কারিগরেরা কিন্তু সেটার কোন উপযোগীতা খুঁজে বার করতে পারলেন না। অতএব ওটাকে বাদ সেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। তার কারণ প্যাপিরাসের কান্ডগুলোকে তো এমনিতেই  বেঁকানো সম্ভব হয়েছে।
তারিখটা ছিল ১৯৬৯ সালের ২৮সে এপ্রিল। ঠিক বাইশ বছর আগে এমন দিনে শুরু হয়েছিল কনটিকির যাত্রা। এবার থর তার ভেলার নাম দিলেন রা, মিশরীয়  পুরাণের সূর্য দেবতা। মরক্কোতে এসে পৌছাল রা।
৪৫ ফুট লম্বা রা প্রথম। সাথে যাচ্ছে থর কে নিয়ে আট জন অভিযাত্রী। যাত্রিরা হলেন থর হেয়ারডাল, নর্মান বেকার, কার্লো মাউরি, ইউরি সেঙ্কেভিচ, সান্টিয়াগো জেনোভে, জর্জেস সুরিয়াল এবং আবদুল্লা জিব্রাইনে। আটজন আট দেশের লোক।
মরক্কোর সফি বন্দরে রা কে সমুদ্রে ভাসান হল তার সব মালপত্র ভরবার জন্য। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২৫ মে রা তার যাত্রা শুরু করল। কিন্তু প্রথম দিনেই বিপদ, থরের নজরে এল যে দিকনির্দেশের জন্য দুটো হালই ঢেউএর ধাক্কায় ভেঙ্গে গেছে। এখন আর রা কে ডাইনে বায়ে করার কোন উপায় নেই, স্রোতের উপরই এর যাত্রাপথ নির্ভর করছে। অন্য সহযাত্রীরা যদিও ভয় পেয়েছিলেন যে তাদের অভিযান হয়তো বিফল হবে, কিন্তু থরের মনে অন্য চিন্তা এসে গেল। এখন তাহলে তাদের অবস্থাটা হচ্ছে সেই প্রাচীন নাবিকদের মত, যারা ভাঙ্গা মাস্তুল আর পালের জাহাজে শুদ্ধু সমূদ্রের স্রোতের উপর নির্ভর করে তাদের প্রাণ বাচিয়েছে। তাহলে এখন রা আরও একটা পরীক্ষাতে নেমে পড়েছে,  কি ভাবে নাবিকেরা আগেকার দিনে তাদের প্রাণ বাচাত।  
   রা এর বর্তমান অবস্থা দেখে নর্মান বেকারের চক্ষু স্থির, বেচারা ফ্লুতে ভুগছিল তাও তার দায়িত্বে ছিল রা কে ডাইনে বায়ে ঘুরিয়ে চালানোর। এখন আর তার কোন কিছু করার দরকার নেই।  ঢেউ জাহাজের পাশে এসে থাপড়া মারছে আর উপর দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে। অভিযাত্রীদের অবস্থা জাহাজের যাত্রী না হয়ে জাহাজের মালপত্রের মত হয়ে গেছে।
রা এর পরের বিপদ এল আফ্রিকার উপকূলের ক্যানারী দ্বীপসমূহের পুর্ব দিকে কেপ জুবি পার হবার সময়। হাল ভাঙ্গা অবস্থাতে রা সোজা পশ্চিম দিকে রওয়ানা দিল। সোজা আটলান্টিক পার হবে বলে। মজার জিনিষ দেখা গেল যে পাল তোলা নৌকোর মতন  কিন্তু রা এর সামনের দিকটা জলের থেকে উপরে থাকছে আর শুখনো আছে, কিন্তু পেছনের দিকে মানে হাওয়া যে দিক থেকে আসছে সে দিকে সে জলের কাছে নীচু হয়ে যাচ্ছে, আর সমুদ্রের জল প্যাপিরাসের কান্ডগুলোকে ভিজিয়ে মোটা করে তুলছে। বাধ্য হয়েই সমস্ত মালপত্রকে আবার আগে পিছে করে সাজাতে হল যাতে জাহাজ আবার জলে  সমান ভাবে ভাসে।  মে মাসে ৩১ তারিকে জুবী অন্তরীপ পার হয়ে রা এগিয়ে চলল।
ইতিমধ্যে জোগাড়যন্ত্র করে একটা কাজ চালানোর মতন হাল তৈরী করা হয়ে গেছে। জাহাজের উপর দিয়ে আর জল বয়ে যাচ্ছে না। কিন্তু এই বার বোঝা গেল যে জাহাজের সামনে থেকে পেছন পর্যন্ত যে দড়িটাকে ছবি গুলোতে দেখান ছিল তার কি কাজ। ওটার কোন কাজ বুঝতে না পেরে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল।  দড়িটা জাহাজের পেছন দিকটাকে টেনে উপরে তুলে রাখে।  এখন যত দিন যাচ্ছে ততই জাহাজের পেছনের দিক জলের নিচের দিকে যাচ্ছে।
জুলাই মাসের প্রথম দিকে রা প্রায় আধাআধি রাস্তা পার হয়ে এসেছে। বারবাডোজ আর মাত্র দেড় হাজার মাইলের মত দূর। ইতিমধ্যে এটা দেখা গেছে যে এই প্যাপিরাসের তৈরী জাহাজ চালানর জন্য দক্ষতার প্রয়োজন। কিন্তু ক্রমশ রা জলে ডোবার উপক্রম হতে লাগল।
শেষে জুলাই মাসের ১৮ তারিখে রা এর উপরে আর ভরসা করা গেল না। এবার জাহাজ ছেড়ে অন্য কিছুর আশ্রয় নিতে হয়। কিন্তু কোথায় সেটা । জলে রা এর চারদিকে হাঙ্গরেরা ঘোরাফেরা করছে, অবশেষে এক ইয়াট এসে তাদের উদ্ধার করে নিল। রা প্রথম তার যাত্রা সমাপ্ত করতে পারল না।
থর কিন্তু এত সহজেই হার মেনে নেবার লোক ছিলেন না। আর যখন রা  প্রথম এর অসাফল্যের কারন জানতে পারা গেছে তখন আবার দ্বিতীয়বার অভিযান করতে বাধা কোথায়। শুরু করে দিলেন রা দ্বিতীয়ের তৈরীর ব্যবস্থা করতে। 
১৯৭০ সালে আবার থর ফিরে এলেন মরক্কোতে আর একবার সেই প্যাপিরাসের তৈরী জাহাজ নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দেবার ইচ্ছে নিয়ে, এবার আর চাদের থেকে বুদুমা আদিবাসীদের সাহায্য নয়। নৌকো তৈরী করতে সাহায্য করবে দক্ষিণ আমেরিকার সুরিকুই থেকে আসা টিটিকাকা দ্বীপের আয়মারা সম্প্রদায়ের লোকেরা, যারা এখনও তোতোরা ঘাসের তৈরী নৌকোতে টিটিকাকা হ্রদের উপরে যাতায়াত করে।  সমস্ত কাজটাই গোপন ভাবে শুরু করা হল কারণ থর জানতেন যে এবার যদি বিফল হন তবে তার নামে লোকে ধিক্কার দেবে হঠকারী বলে।  এবার আর প্যাপিরাস দিয়ে তৈরী নয় এবার বানানো হচ্ছে সেই তোতোরা ঘাস দিয়ে।
কিন্তু এই যে মাঝখানের সময়টা গেছে সেই সময় থর পুরনো সমাধির গাত্রচিত্র দেখে, আর যারা এই ধরনের নৌকো বানায় তাদের সাথে আলোচনা করে তার জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। সাথে ছিল রা প্রথমের বিপর্যয়ের থেকে শিক্ষা। এবার আর কিছুই ভাগ্যের উপরে ছাড়া হবে না এই ছিল মূল মন্ত্র।
 ১৯৭০ সালের ১৭ই মে, রা দ্বিতীয়ের যাত্রা হল শুরু। রা প্রথম থেকে ৭ ফুটের মতন লম্বায় ছোট।  জাহাজের চওড়া হচ্ছে ষোল ফিট। আর উচ্চতাতে ৬ ফিটের মত। প্রথম বারের মত এবার  ৯ জন সহযাত্রী সাথে রওনা দিলেন। এবার আর জিব্রাইনে সাথে নেই, তার বদলে এসেছেন জাপানী কার্ল ওহারা আর মরক্কোর মাদানী উহান্নী।
জলে নামানোর পরে দেখা গেল রা দ্বিতীয় রাকে  প্রথম রা য়ের চেয়ে  চালানো সহজ হয়েছে। কিন্তু মালপত্র তোলবার পরে দেখা গেল নৌকোর মাত্র তিন ফুটই  জেগে আছে জলের উপরে।
এবার আর জুবী অন্তরীপ হয়ে যাত্রা নয়।  আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেবার জন্য সোজা পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করা হল।
কিন্তু দু সপ্তাহ পেরোতে না পেরোতেই দেখতে পাওয়া গেল রা দ্বিতীয় জল সহ্য করতে পারছে না। তার তিন ফুট যে জলের উপরে ছিল তার থেকে দু ফুটের মতো এখন জলের নীচে।  এখন আছে মাত্র এক ফুটের মত উপরে জেগে।  আর এক সপ্তাহ পার হতে না হতে দেখা গেল সেটাও জলের নীচে, সমূদ্রের জল এখন নৌকোর উপর দিয়ে বয়ে চলছে। তাহলে কি রা তার দ্বিতীয়বার যাত্রা শেষ করতে পারবে না। নৌকোর ভার কমাতে যাত্রীরা তাদের মালপত্র ফেলে দিতে শুরু করলেন। এমন কি তাদের লাইফবোট কেও ফেলে দেবার কথা চিন্তা করতে লাগলেন।
এইতি মধ্যে কেপ ভার্ডে দ্বীপসমূহ কাছেই চলে এসেছে। যাত্রীরা ভাবতে শুরু কর দিলেন যে এবার তাহলে সেখানেই যাওয়া যাক। আপাতত যাত্রা পথ বদল করে জাহাজকে কিছুটা দুরুস্ত করে নেওয়া যাক।  সকালে দেখা গেল কেপ ভার্ডে দ্বীপকে দেখা যাচ্ছে সামনের দিকে একটু বা দিক ঘেসে। থর কিন্তু তার জাহাজকে সোজা পশ্চিম দিকেই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। দুপুরে দেখতে পাওয়া গেল দ্বীপ একেবারে বা দিকে মাত্র মাইল আষ্টেক দূরে। আর সন্ধ্যের দিকে দেখা গেল দ্বীপ প্রায় ষোল মাইল পেছনে পড়ে আছে।
এখন আর ফেরার উপায় নাই। যতক্ষণ ভেসে থাকার আশা আছে ততক্ষণ এই রা তেই থেকে এগিয়ে চলতে হবে। যাত্রীরা নিজেদের মধ্যে ভোট নিলেন যে যাত্রায় ক্ষান্তি দেওয়া হবে না আগে এগিয়ে যাওয়া হবে। তাতে মাত্র একটাই ভোট পড়ল যাত্রা চালিয়ে যাবার পক্ষে। কে পক্ষে ভোট দিলেন তা আর কারুর জিজ্ঞাসার ইচ্ছে ছিল না কেননা একমাত্র থরই এই রকম চিন্তা তখনও রেখে যাচ্ছিলেন।
জুলাই মাসের ১২ তারিখে তারা দূরে ডাঙ্গা দেখতে পেলেন। আর তার পরে কোন রকমে গিয়ে বারবাডোসের বন্দরে রা দ্বিতীয় পৌছাল। ৩২৭০ মাইলের যাত্রা শেষ হল। সময় লাগলো ৫৭ দিন। থর প্রমান করতে পারলেন যে মহাসাগর কোন বাধা নয়।

শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

কনটিকির যাত্রা


মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজারের মত বাসিন্দা থাকে এই দ্বীপটাতে। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের উপরে একটা বিন্দুর মতনই মনে হবে, কেননা আয়তনে হচ্ছে মাত্র ১৬০ বর্গ মাইলের মতন। কিন্তু কি তাঁর এমন মাহাত্ম্য যে ইউনেস্কো সেই দ্বীপটাকে সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহনের গরিমা দিয়েছে। হ্যাঁ, আমি বলছি রাপা নুই বা ইষ্টার দ্বীপের কথা। কি তাঁর সেই বিশেষত্ব। হ্যাঁ এইখানেই আছে সেই সব মোইএরা বা বিশাল বিশাল পাথরের খোদাই করা মানুষের মুখগুলো, যাদের নাম মোই।

 কিনতু অবাক কান্ড আরও লাগে, যখন দেখি এই বিশাল আকারের মুর্তিদের সমূদ্রের উপরে দিয়ে নিয়ে এসে দ্বীপে বসান হয়েছে। তাও এক সার  দিয়ে। এদের মুখ তাকিয়ে আছে সমূদ্র থেকে দ্বীপের ভেতর দিকে, যেন তারা নতুন  কিছু জিনিষ এই দ্বীপে আছে কিনা তাই দেখছে।

কারা এরা বা কাদের তৈরী এই সব মূর্তি গুলো।  কোন কিছু নির্দিষ্ট করে কোথাও লেখা নেই, কিন্তু বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে এই মূর্তিগুলো করা হয়েছে দ্বীপবাসীদের পূর্বপুরুষের স্মরণার্থে। কিন্তু তাহলে আজকে এরা মুখ থুবড়ে পড়ে আছেই বা কেন? মনে হয়  দ্বীপের আদিম অধিবাসীদের মধ্যে আন্তরিক বিরোধের ফলে ঐ মুর্তিগুলোকে ইচ্ছে করে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাচ্চা ছেলেরা খেলায় হেরে গেলে যেমন তাঁর খেলনা ভেঙ্গে ফেলে, সেই রকম অনেকটা।

 বিখ্যাত নরওয়েজিয়ান লেখক থর হেয়ারডাল ( ইনি বিজ্ঞানীও বটে, কিন্তু তাঁর লেখা বই তাঁকে বিজ্ঞানীর থেকে লেখক হিসাবে বেশী সম্মান দিয়েছে।  তাঁর লেখা বই তিনটি হল কন-টিকি আর আকু আকু এবং ফাতু হিভা।)  এই সম্বন্ধে কিছু লিখেছেন, যেটা তাঁর নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। ।  বছর ষাটেক আগে আমার পড়া প্রথম বই দুটো, কিন্তু তাদের আকর্ষন আমার কাছে এখনও প্রবল হয়ে আছে। দেখি তাঁর থেকে কিছু আপনাদের জন্য জোগাতে পারি কিনা।

থর হেয়ারডালের জন্ম ১৯১৪ খৃষ্টাব্দে। ভূগোল, জীব এবং প্রানী বিজ্ঞান এবং নৃতত্বের উপরে তাঁর জ্ঞানএর সাথে তাঁর এডভেঞ্চার করার নেশা তাঁকে নরওয়ে থেকে পেরু, আবার সেখান থেকে এক নৌকো তৈরী করে প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে টুয়ামোটো দ্বীপপুঞ্জে যেতে বাধ্য করে। সেই সমূদ্রযাত্রার বিবরণ তিনি দিয়েছেন তাঁর লেখা কন টিকি বইয়ে।

থর আর তার স্ত্রী লিভ যখন মারকুইস দ্বীপপুঞ্জের ফাতু হিভা দ্বীপে হনিমুন করতে চলে গিয়েছিলেন তখন থেকে এর সূত্রপাত। অবশ্যি হনিমুনের চেয়েও সেটা ছিল আধুনিক সভ্যতা আর সমাজের উপরে থরের বিরাগ। তাই একেবারে আদিম অধিবাসীদের মতন তাঁর নব বিবাহিত স্ত্রীকে সাথে নিয়ে চলে গেছিলেন ফাতু হিভায়। প্রথম অভিজ্ঞতা তাঁর এই আদিম জীবনের মধ্যে  এসে পড়ার হয় যখন তাঁর তাবুর উপরে গাছের থেকে এক পাকা নারকেলের পতন হয় এবং তাবুর সর্বনাশ হয়। বাধ্য হয়ে তাদের আশ্রয় নিতে হয় ওখানকার অধিবাসীদের মতন এক কুড়ে ঘরে, সাহায্য নিতে হয় স্থানীয় অধিবাসীদের তাদের জীবন ধারার সাথে।

 একসন্ধ্যায় সেই পলিনেশিয়ান দ্বীপে, সমূদ্রের ধারে বসে ঢেউএর ভেঙ্গে পড়া আর তার ফেনিল জলরাশি দেখতে দেখতে  আমাকে স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন,” আচ্ছা এই দ্বীপের অন্য দিকেও কি এই রকম ভাবেই ঢেউ ভেঙ্গে পড়ছে”? আমি বললাম, “ তা কেন। ওটা তো স্রোতের উলটো দিকে, মানে পশ্চিম দিকে। ওদিকের সমূদ্র শান্ত”। সামনে আমার বসে ছিল এক স্থানীয় আদিবাসী। নাম তাঁর তেই তেহুয়া। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়ল যে তোমরা কথা থেকে এসেছ যে বেড়ালের ছবি তোমাদের পুর্ব পুরুষেরা আঁকতে পেরেছে, বেড়াল তো এখানে হয় না। তখন উত্তর পাই ‘তে ফিতি” (পূর্ব দিক) থেকে আমরা এসেছি।  বালিতে আকি বুকি কাটতে কাটতে সে বলে উঠল “টিকি।  আমাদের সর্দার আর ভগবান। তিনিই আমাদের এখানে নিয়ে এসেছেন। তার আগে আমরা সমূদ্রের ওপারে এক বিরাট পাহাড়ী দেশে বাস করতাম।“ রাতে শুয়ে আমার মনে যে কথাটা বার বার আসতে লাগলো সেটা হচ্ছে যে এই মূর্তিগুলোর আদল প্রায় সেই দক্ষিন আমেরিকার জঙ্গলের আদিম মুর্তির মত, তবে কি এগুলো সেখান থেকে বা সেখানকার লোকে বানিয়েছে।

এই চিন্তা আমার মনে নাড়া দিয়ে গেল। যেখানে কোন নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায় না সেখানেই শুরু হয় কল্পনা। সমুদ্রের ওপারে মানে দক্ষিণ আমেরিকায়। কিন্তু এই দীর্ঘ ৪৫০০ মাইল চওড়া প্রশান্ত মহাসাগর তারা পার হয়েছিল কি ভাবে? তবে কি কোন স্থল যোগসুত্র ছিল এই প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ আর দক্ষিন আমেরিকা মধ্যে, যা এখান আর নেই।

বিজ্ঞানীরা যখন কোন জায়গার সাথে তাঁর বাসিন্দাদের সূত্র খোজেন তখন তারা অন্য জীব জন্তুর সাথে আশপাশের জায়গার মিল খুজতে থাকেন। এইখানে কিন্তু দেখা গেল যে দ্বীপে সে সমস্ত জন্তুর হাড় পাওয়া যাচ্ছে সেটা হচ্ছে ইদুরের, যে ধরনের ইদুর পেরুতে পাওয়া যায়। তাছাড়া স্থানীয় অধিবাসীদের চেহারা, হাওয়াই দ্বীপ বা অস্ট্রেলীয় চেহারার সাথে না মিল রেখে ইনকাদের সাথে কিছুটা মিল পাওয়া যাচ্ছে।  দ্বীপপুঞ্জের অন্য দ্বীপের লোকেদের বংশ পরম্পরা, তারা  ইনকাদের মত দড়িতে গিঁঠ গুনে গুনে বলতে পারছিল। তবে কি ওরা ইনকাদের থেকেই এসেছে।

আফ্রিকার থেকে দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব উপকূল, আবার তার পরে আমেরিকার পশ্চিম উপকূল থেকে পলিনেশিয়ান দ্বীপগুলোর দিকে এক স্রোত প্রতিনিয়ত বয়ে চলেছে। এটা ভর করে লোকে তো জাহাজেও আসতে পারে। কিন্তু কাঠের জাহাজের প্রচলন কলম্বাসের আমেরিকা আসার আগে হয়নি। কিন্তু তাঁর আগেও তো লোকে সমূদ্রে যাত্রা করেছে। কি ভাবে দেখতে গিয়ে দেখা গেল যে বালসা কাঠের ভেলা বানিয়ে তাতে করে সমূদ্রে যাত্রা করার কথা ইতিহাসে আছে। বালসা এক ধরণের গাছ, যার কাঠ হয় অত্যন্ত হাল্কা, আগে এরোপ্লেন বানানোর কাজে এর ব্যবহার খুব ছিল। হাল্কা ধাতু আবিস্কারের পরে আর এটা ব্যবহার হয়না, তবুও কিছুদিন আগে পর্যন্ত খেলনা প্লেন (মডেল এরোপ্লেন) তৈরী হত এই কাঠ দিয়ে।

যখন ইউরোপীয়েরা এই সব দ্বীপগুলোকে আবিস্কার (?) করল তখন কিন্তু দেখা গেল যেসব জায়গাতে মানুষেরা আছে, সেখানে কিন্তু লোকে চাষ আবাদ করছে, জন্তু জানোয়ার অন্য জায়গার মতনই পোষ মানিয়ে, তাদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। তবে এটা কিসের আবিস্কার। যারা এখানে আছে তাঁর তো এই ইউরোপীয়দের আগেই এসে এটাকে আবিস্কার করেছে।

এটা দেখা গেছিল যে এই দ্বীপগুলোতে ৫০০ থেকে ১১০০ খৃষ্টাব্দের মধ্যেই বসতি হয়েছে তাঁর আগে এই দ্বীপগুলোতে মানুষেরা থাকত না। এর আদিম বাসিন্দাদের চেহারার সাথে কিন্তু পলিনেশীয়, বা নিগ্রয়েড অথবা মোঙ্গলয়েড জনগোষ্ঠির মিল নেই। বরং এদের সাথে মিল খুজে পাওয়া গেছে ভারতের (সিন্ধু নদের অববাহিকা র এলাকা) লোকেদের সাথে আর ইনকাদের সাথে। কিন্তু ভারতের থেকে এখানে কোন জনজাতির আসা সম্ভব বলে মনে হয়না।

ঘুরে ফিরে যখন সেই নিশানাটা ইনকাদের দিকেই যাচ্ছে তখন দেখা গেল যে স্পেনীয়দের আসার আগে যে ইনকাদের পিরামিড, নগর সব পাহাড়ের উপরে ছিল সেগুলো কিন্তু এই প্রজন্মের ইনকাদের তৈরী নয়। এগুলো তৈরী করে গেছেন তাদের আগের কোন এক প্রজন্ম যাদের সাথে এই প্রজন্মের ইনকাদের চেহারার মিল খুব বেশী নেই।
“এরা উত্তরদিক থেকে এসেছিলেন, আর আমাদের কি ভাবে কি  কি করতে হয়, এই সব ইঞ্জিনিয়ারিং, স্থাপত্যকলা শিক্ষা দিয়ে গেলেন। লম্বা দেখতে, মুখে সাধারণত দাড়ি থাকত আর দেখতে ফর্সা রঙ। তাঁর পর তারা আবার পশ্চিম দিকে সমূদ্রের ওপারে হঠাত চলে গেলেন”। এই খবরই কিন্তু জিজ্ঞাসা করে পাওয়া গেছিল পরের প্রজন্মের ইনকাদের কাছ থেকে। কিন্তু পেরুর পশ্চিমে তো প্রশান্ত মহাসাগর। তবে কি তারা সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন। ওদিকে পলিনেশীয়ান দ্বীপগুলোতেও দেখা গেল লোকেরা বেশ ফর্সা, লম্বা এবং সাধারনত দাড়ি যুক্ত মুখমন্ডল।

তাহলে এই টিকি কে, যিনি তাঁর সাথে সারা অনুগামীদের নিয়ে এই রাপা নুইতে চলে এসেছিলেন। খুজতে খুজতে পাওয়া গেল পেরুতে ইনকাদের সুর্যের দেবতা ভিরোকচার নাম। অবশ্যি ভিরোকচার আদি নাম ছিল টিকি কন টিকি বা ইল্লা টিকি। এও কথাতে পাওয়া গেল যে এই কন টিকির অনুগামীদেরকে টিটিকাকা হ্রদের ধারে এক কারি সম্প্রদায় যুদ্ধে হারিয়ে দ্যায়। এই টিটিকাকা হ্রদের পাড়েই কনটিকির তৈরী বিশাল বিশাল মনুমেন্ট আজ দেখতে পাওয়া যায়। যুদ্ধে হেরে কন টিকি তাঁর অনুগামীদের যাদের বাঁচাতে পেরেছিলন তাদের নিয়ে সাগর পার হউএ পূর্ব দিকে চলে যান। তাহলে বোঝা যাচ্ছে কনটিকি হছে সেই সুর্যদেবতার প্রধান পুরোহিত।
থরের একটা লক্ষ পূরন হল কিন্তু যতক্ষন না কেউ সাহস করে এই দীর্ঘ সাডে চার হাজার মাইলের সমূদ্রপাড়ি না দিচ্ছে ততক্ষন ঐ  কন টিকির কথা আর কেউ বিশ্বাস করবে না। শুরু হল তাঁর প্রস্তুতি। সমূদ্র পার হয়ে পলিনেশিয়ান দ্বীপে যাবার।


কিন্তু তাঁর আগে তিনি যে তাঁর যুক্তি দিয়ে যে প্রস্তাবনা লিখেছিলেন আর বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের কাছে পাঠিয়ে ছিলেন তাদের কাছ থেকে বিশেষ কিছু উৎসাহ পান নি। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপের এদিক থেকে ওদিকে ধ্বংসলীলা চালিয়ে বেড়াচ্ছিল।  যখন নরওয়ের উপর জার্মান সৈন্য বাহিনী হামলা করে দখল করে নিল থর তাঁর সব কিছু বন্ধ করে সেই যুদ্ধে যোগ দিলেন।

১৯৪৫ সালে যুদ্ধ থামার পরে আবার থর তাঁর ঐ পুরনো ভাবনা নিয়ে চিন্তা শুরু করলেন। থাকছিলেন তখন নিউইয়র্কের নরওয়েজিয়াব নাবিকদের জন্য তৈরী আবাসে, যেটা সস্তা  এবং নরওয়েজিয়ান খাবার পাবার একটা ভাল জায়গা।

এক বিখ্যাত বিজ্ঞানীর কাছ থেকে তিনি তাঁর পান্ডুলিপি ফেরত পেলেন আর তাঁর সাথে আখ্যা পেলেন যে প্রমাণ না দিয়ে এই সব প্রস্তাবনার কোন দাম নেই। থর নিরাশ হলেন কিন্তু হাল ছাড়লেন না,। এক দিন আর এক বন্ধু, যার সারা জীবন প্রায় সমূদ্রের উপরেই কেটেছে, তাঁর সাথে বিকেলের চায়ের সময় কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেই ফেললেন যে বালসা কাঠের ভেলাতে করে কি আমেরিকা থেকে পলিনেশিয়া যাওয়া সম্ভব। বন্ধুর কাছ থেকে হ্যাঁ উত্তর তাঁকে যে কতটা খুশী করেছিল তা কিন্তু তিনি তাঁর বইএ লিখেছেন।
 কিন্তু যখন তিনি বললেন যে তিনি ভাবছেন এই রকম একটা ভেলাতে চড়ে যাবেন তখন কিন্তু বন্ধু তাঁকে বারণ করলেন। বললেন যদিও তিনি বিশ্বাস করছেন যে ইনকাদের দল এই রকম বালসা কাঠের ভেলাতে চড়ে মহাসাগরে পাড়ি দিয়েছিল, কিন্তু তারা গেছিল দল বেঁধে। একটা ভেলা ডুবে গেলে অন্য ভেলার লোকেরা এদের বাঁচানোর কাজ করেছে।

এই রকম সময়ে তাঁর সেখা হল ন্যুট ওয়াটজিঙ্গারের সাথে। ন্যুট পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, কথায় কথায় তাঁকে থর বললেন এই ব্যপারে। ন্যুট তাতে বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। থর তাঁর আগেই, অভিযাত্রী হিসাবে নিউইয়র্কের এক্সপ্লোরার ক্লাবের সদস্য হয়ে গেছিলেন। সেখানে পিটার ফ্রুসেনের সামনে একদিন এয়ার মেটেরিয়াল কমান্ড থেকে যুদ্ধে ব্যবহৃত এবং পরে তাঁর উপরে আরও উন্নতি করে জিনিষ গুলোকে দেখান হচ্ছিল।

অভিযাত্রীদের কাছে এই জিনিষগুলোর উপকারিতা নিয়ে হেরমানের সাথে কথা হতে হতে হারমান প্রস্তাব দিল তাহলে চল না আমিও সাথে যাই। কি কি জিনিষের দরকার তাঁর একটা লিষ্ট তৈরী হতে লাগল।
অভিযানের জন্য মূল দরকারী জিনিষ টাকা। এক জায়গাথেকে আশার খবর পেলেন যে সমস্ত খবভর তাদেরকেই একমাত্র দিলতে হবে সে সুবাদে তারা তাকা দেবেন। কিন্তু কয়েকদিন বাদে সে টাকাও পাওয়া গেল না । ভদ্রলোক তাঁর কথার খেলাপ করলেন। শেষ পর্যন্ত নরওয়ে সরকারের কাছ থেকে ধার হিসাবে থর কিছু টাকা পেলেন।

নরওয়ের দূতাবাস থেকে আমেরিকার পেন্টাগনের কাছে লেখা চিঠি নিয়ে থর আর হারমান দেখা করতে গেলেন এই সামরিক দফতরে।  বিশাল দফতর যেখানে প্রায় ৩৫ হাজারের উপর লোকে কাজ করেন আর বাড়ীটাতে মাইল ষোলর মতন হবে বারান্দার লম্বাই। কিন্তু আসল কথা হল যে তারা সৈনিক দফতর থেকে তাদের দরকার মতন, আপতকালীন উদ্ধারের জিনিষপত্র, টিন বন্ধ খাবার ইত্যাদি পেয়ে গেলেন।

এবার দরকার দুটি জিনিষের। প্রথম  হচ্ছে বালসা গাছের গুড়ি প্রয়োজন  মত লম্বা। ইনকাদের সময়ে লোহার ব্যবহার ছিল না কাজেই বালসা কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি করা যাবে না। কিন্তু পেরুতে গিয়ে দেখা গেল সে জিনিষের অসুবিধা। প্রথমত পেরুর জঙ্গল থেকে সমূদ্র উপকুলে ঐ গাছের গুঁড়ি আনতে গেলে অন্য দেশ ইকোয়েডরের উপর দিয়ে আসতে হবে। ইনকাদের থেকে একটা বেশি অসুবিধা কেননা তখনতো আর সীমান্ত রক্ষার জন্য কোন কাঁটা তারের ব্যপার ছিল না।

তাঁর চেয়েও বেশী অসুবিধা সামনে নিয়ে এল সদ্য শেষ হওয়া বিশ্বযুদ্ধ।  উপকুলের কাছের সমস্ত এলাকার বালসা গাছ কেটে এরোপ্লেন তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়ে গেছে। দরকার মত লম্বা গুঁড়ি অমিল। আন্ডিজ পাহাড়ের নীচের দিকে ঘন জঙ্গলে হয়ত পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু বর্ষা নেমে গেছে বলে সেখান যাওয়া প্রায় অসম্ভব। সবাই মত দিল বর্ষা থামলে যত চাই তত বালসা পাওয়া যাবে। থরের সেটা অপছন্দ।

থর ভাবলেন বৃষ্টির জন্য উপকুলের দিক থেকে, মানে গুইয়াকুইলের দিক থেকে জঙ্গলের রাস্তা অগম্য হয়ে থাকতে পারে কিন্তু আন্ডিজ পাহাড়ের উপর থেকে অত অসুবিধা হবার কথা নয়। চলে গেলেন পাহাড়ের উপরে শহর কুইটোতে। সেখান থেকে এক মার্কিন সেনা বাহিনীর জিপে করে কখন পাহাডী গলিপথ ধরে, আবার কখনবা স্রেফ পাকদন্ডীর মতন রাস্তা দিয়ে এলেন বালসার জঙ্গলে। কাঠের সমস্যা মিটল।

আর দ্বিতীয় চিন্তা ছিল সহযাত্রী নির্বাচনের। আনুমানিক হিসাবে তাদের লাগার কথা তিন মাস, বাড়িয়ে নিয়ে সেটা চার মাস। এই দীর্ঘ সময় সহযাত্রীদের মধ্যে একটা সামাজিক সদ্ভাব না গড়ে উঠলে তাদের টিকে থাকা সম্ভব নয়। অনেক হিসাব করে নুট তাঁর যুদ্ধের সময়কালীন সাথী টরষ্টেইন আর হ্যাগল্যান্ডকে আসতে বললেন।

ভেলা বানানোর জন্য থর সাহায্য নিয়েছিলেন স্পেনীয় চিত্রকরদের যারা  ইনকাদের কাছ থেকে তাদের ভেলার চেহারাটা দেখে চিত্রবদ্ধ করেছিলেন। যাত্রার পথে প্রত্যেক চার ঘন্টা অন্তর একজন যাত্রীর জেগে থাকবার কথা, কাজেই সব শুদ্ধ যেকোন এক সময়ে পাঁচ জনের শোয়ার  জায়গা থাকা দরকার, তা ছাড়া তাদের সাজসরঞ্জাম, রশদ ইত্যাদি রাখার জায়গা দরকার। কাজেই ভেলার আয়তন করা হল ৪৫ ফুট(প্রায় ১৩ মি) লম্বা আর ১৮ ফুট (সাড়ে ৫ মি) চওড়া।  লম্বা দিকে ৯টা বালসা কাঠের গুঁড়ি, ২ ফুট (৬০ সেমী) বেধের এক সাথে বাঁধা  হল শনের দড়ি দিয়ে। প্রায় সোয়া ইঞ্চি (৩ সেমী) মোটা দড়ি নেওয়া হল। ভেলার আড়ের দিকে তাকে শক্তপোক্ত করার জন্য ১৮ ফুট (সাড়ে ৫ মি) লম্বা আর ১ ফুট (৩০ সেমি) বেধের গুঁড়ি ৩ ফুট (প্রায় ১ মি) দূর দূরে  দডি দিয়ে বাঁধা হল। ম্যানগ্রোভ গাছের কাঠ দিয়ে একটার সাথে আর একটাকে বেঁধে  ২৯ ফুট উচু (প্রায় ৯ মিটার) মাস্তুল বানাল হল যার পায়া দুটি ভেলার দুদিক থেকে উঠে ইংরাজী A মত চেহারার হল। ভেলার বালসা গুড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে দু ফিট চওড়া পাইন গাছের তক্তাগুলো গুজে দেওয়া হোল। ভেলাকে জলের সাথে সমান্তরাল রাখার জন্য। ভেলার সামনের দিকে জলের ঢেউএর জন্য বেড়ার বন্দোবস্ত করা হল।

থাকার জায়গার জন্য মাস্তুলের গায়েই বাঁশের দর্মা দিয়ে একটা সাধারণ ঘরের মাপে ১৪ ফুট লম্বা আর ৮ ফুট চওড়া ঘর তৈরী করা হল। তাতে  কলাপাতার ছাউনী দেওয়া হল, দেয়াল হল ৪/৫ ফিটের মত উচু।
এক ১৯ ফুট লম্বা ম্যানগ্রোভের কাঠে ফার গাছের তক্তা লাগিয়ে তৈরী করা হল দিশা বদল করার জন্য হাল।  স্রোতের সাথে সাথে বাতাসের সাহায্যের জন্য একটা বড় পালের ব্যবহার করা হল। ১৬ ফুট চওড়া আর ১৮ ফুট উচু পাল লাগান হল। তাতে আঁকা হল কনটিকি বা সূর্য দেবতার ছবি।


সমস্ত ভেলাটা আজ কনটিকি যাদুঘরে রাখা আছে।   যাত্রীদের কেউই আজ আর জীবিত নেই। একমাত্র যাত্রী যিনি এই অভিযান সম্পূর্ণ করে উঠতে পারেন নি তিনি হলেন এক টিয়া পাখী, লরিটা। পথে এক বিশাল ঢেউ তাকে ভেলার থেকে টেনে কোথায় নিয়ে চলে যায়। তাঁর দেহের কিছু পালক আজ ঐ যাদুঘরে রাখা আছে ভেলার সাথে।
কিন্তু ঐ আন্ডিজ পাহাড়ের উপরে আর ভেলা বানানো যাবে না। কাজেই এই গুড়িগুলোকে পাঠান হল লিমার নৌসেনার জাহাজ বানানোর কারখানাতে। সেখানেই আস্তে আস্তে তৈরী হতে লাগল কন টিকি। ন্যুট অবশ্যি একটা বিষয়ে সাহস দেখান নি যে শুধুমাত্র ছবি অনুযায়ী ভেলা বানিয়ে তাতেই যাত্রা শুরু করবেন। বহুবার তাঁর পরীক্ষা জলের উপরে করেছেন যাতে তিনি নিজে নিশ্চিত হন যে ভেলাটা সমূদ্রযাত্রার জন্য উপযোগী হচ্ছে।
ইতিমধ্যে তাঁর সহযাত্রী নির্বাচন সম্পুর্ণ করা হয়েছে। প্রথম সহযাত্রি হলেন হেরম্যান ওয়াটজিঙ্গার। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, কোম্পানির কাজে নিউইয়র্কে এসেছিলেন আর আচমকাই তারা সাথে থরের আলাপ পরিচয় তাকে এই অভিযানে সামিল করে নেয়। তাঁর সাধের চাকরী আর পরিবার পরিজন নরওয়েতে ছেড়ে অভিযানে যোগ দিলেন।
দ্বিতীয় আর তৃতীয় সহযোগী হিসাবে এলেন ন্যুট হ্যাগল্যান্ড আর টরষ্টেইন রাব্বি। এদের দুজনের সাথ থরের পরিচয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে। দুজনেই রেডিও সম্প্রচারের ব্যাপারে বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত আর জার্মান সেনাদের লুকিয়ে জাহাজ বিসমার্কের খবর পাঠানর কাজ ছিল এঁদের।
আর চতুর্থ সহযাত্রী হলেন থরের বাল্যবন্ধু এরিক হেসেলবার্গ। দক্ষ নাবিক, এর আগেই তাঁর বার কয়েক সারা পৃথিবী জাহাজে ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা আছে। তাঁর চেয়ে বড় কথা ইনি ছিলেন একজন  শিল্পী। কনটিকি ভেলার পালের উপরে আঁকা সুর্যদেবের মুখের ছবি ইনিই একেছিলেন।
আর শেষজন হলেন বেঙ্গট ড্যানিয়েলসন, উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসীদের সম্বন্ধে তাঁর গবেষনা চলছিল। হঠাত তিনি এসে থরের সাথে যোগাযোগ করে এই যাত্রায় সহযোগী হবার ইচ্ছে প্রকাশ করেন আর যোগ দেন। হয়ে গেল মোট ছজন অভিযাত্রীর পরিচয়।
হ্যাঁ আরও একজন ছিলেন যাত্রা শুরুতে, তিনি হলেন টিয়া পাখী লরিটা। তাঁর পক্ষে এই যাত্রা সম্পূর্ণ করার সৌভাগ্য হয় নি।
তারিখটা ছিল ১৯৪৭ সালের ২৮সে এপ্রিল।   লিমার শহরতলীর নৌসেনার আড্ডা কাল্লাও  থেকে কনটিকির যাত্রা শুরু হল। উপকূলের কাছে অন্য জাহাজ বা নৌকোর সাথে টক্কর না লাগে সে জন্য সমূদ্রের মধ্যে ৫০ সামুদ্রিক মাইল দূর পর্যন্ত তাকে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল। এইবার কনটিকি তাঁর নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে চলতে শুরু করল।  দীর্ঘ ১০১ দিন বাদে ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসের ৭ তারিখে  টুয়ামোটো  দ্বীপপুঞ্জের রাওরিয়াতে এসে পাড়ে ধাক্কা খেল। ক্ষতি হল মাস্তুলটা ভেঙ্গে ড্যানিয়েলসনের উপরে পড়া। ভারতের স্বাধীনতার আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি ছিল। পৌছনোর ৪ দিন বাদে পাশের দ্বীপের অধিবাসীরা এসে তাদের আর কনটিকি ভেলাটাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
কনটিকির যাত্রা সমাপ্ত হল। থর প্রমান করে দিলেন যে পলিনেশিয়ার দ্বীপ সমূহের সাথে দক্ষিণ আমেরিকার যোগাযোগ ছিল। যদিও তাঁর মূল বক্তব্য সঠিক ভাবে এখনও প্রমানিত হয়নি, কিন্তু তাকে নস্যাত করাও যায়নি।
যাত্রার পূর্ণ বিবরণ আর তাঁর সাথে তোলা ছবি নিয়ে পরে বই বার হল কনটিকি। আমার লেখা পড়ে বইখানা অন্তত লাইব্রেরি থেকে এনে পড়লে আমার আনন্দ বাড়বে। যাত্রার বিবরণ এখন কপিরাইট আইনের আওতায় থাকার জন্য দিতে পারছি না। ছবি যা কিছু দিচ্ছি  উইকিমিডিয়ার সৌজন্যে।
কনটিকির দেখাদেখি আরও অনেক সমুদ্রে অভিযান হয়েছে।  কনটিকির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এবং তাঁর সাথে পলিনেশিয়া থেকে আমেরিকায় আসার  জন্য  এক বিশেষ ডাক টিকিট বার করাও হয় ১৯৬২ খৃষ্টাব্দে।
এইখানে বলে রাখি প্রখ্যাত সাতারু মিহির সেনের উতসাহে পশ্চিমবঙ্গের অভিযাত্রিক ক্লাবের পরিচালনায় দাঁড় টানা নৌকোতে গঙ্গাসাগর থেকে আন্দামান দ্বীপের যাত্রা হয়েছিল। তাঁর পরে কথা ছিল পরাদীপ থেকে বালী পর্যন্ত এক অভিযানের। ঠিক জানা নেই সেটা হয়েছিল কিনা।


শুক্রবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

ব্যাঙ বন্ধু দুজনের গল্প


অনেক দিন আগের কথা। জাপানের ওসাকা শহরের এক নালার মধ্যে থাকত এক ব্যাঙ। আর আর এক ব্যাঙ থাকতো কিয়োটো শহরের পাশ দিয়ে যে ছোট্ট জলের ধারা বয়ে যায় তারই পাশে এক মাঠের মধ্যে।। কেউ কাউকে চেনেও না, কেননা তারা তো আর বাইরের শহরে যায় নি। কিন্তু মজার ব্যপার হল এই যে দুজনের মনেই একই সাথে কি এক অদ্ভুত চিন্তা এল, যে পৃথিবীর অন্য জায়গাগুলো একবার না হয় ঘুরেই দেখা যাক। কিয়োটোর ব্যাঙ ভাবল ওসাকা গেলে কি রকম হয়, আর ঠিক সেই সময়েই ওসাকার ব্যাঙ্গের ইচ্ছে হল যে কিয়োটো গিয়ে মিকাডোর প্রাসাদের চেহারাটা একবার দেখেই না হয় আসা যাক।

আর এক শুভ সকালে তারা নানান দিক বিচার করে দিল রওয়ানা, দুজনে দেশের দুই প্রান্ত থেকে। সেই রাস্তা ধরে যেটা ওসাকা থেকে কিয়োটো পর্যন্ত টানা চলে গেছে। অনেক দূরত্ব কিন্তু দুটো শহরের মধ্যে।  আর ব্যাঙ্গের ব্যপারতো। ছোট ছোট লাফ মেরে তারা আর একবারে কতইবা দূরে যেতে পারবে। শুধু তাই নয়। তাদের একটা পাহাড়ও পেরোতে হবে যে।

কিন্তু সব ভাল যার শেষ ভাল। এক সময়ে তারা সেই রাস্তা ধরে চলতে চলতে সেই পাহাড়ের মাথায় গিয়ে পৌছাল। আরও অবাক হল তারা যখন দেখতে পেল সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারই মতন আর একজন ব্যাঙ। একজন অন্য জনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কোন কথা নেই।

তার পরে দুজনেই একসাথে বলে ঊঠল, আমি দূরের শহরটাকে দেখতে বেড়িয়েছি। আর এই উচু পাহাড়টা চড়তে গিয়ে বেশ হাফিয়েও গেছি। একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক।

বসে গেল দুজনে একটু গড়িয়ে নিতে। আমাদের মতন বিছানা নেই তাই ঘাসের উপারেই। একথা ওকথা হতে হতে দুজনের মনের কথাটা বেড়িয়েই পড়ল। “হায়রে যদি আমরা এর একটু বড় হতাম, একটু মাথায় উচু হতাম, তবে এখান থেকেই সামনের শহর দুটোকে দেখতে পেতাম। আর তাহলে আমরা বুঝতে পারতাম যে কষ্ট করে যাবার কোন দরকার আছে কিনা।

কিয়োটোর ব্যাঙ বলে খুব সোজা আমরা একজন পেছনে পায়ে ভর দিয়ে দাডাই আর আরেকজন তাঁর ঘাড়ের উপরে পেছনএর পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াক। তাহলে আমরা অনেক লম্বা হয়ে যাব আর দেখতে পাব।
বুদ্ধি টা ওসাকার ব্যাঙ্গের মাথায় চড়াং করে খেলল, খুব ভাল আইডিয়া তো। অতএব তাই তারা করল, ওসাকার ব্যাঙ কিয়োটোর দিকে মুখ করে আর কিয়োটোর ব্যাঙ ওসাকার দিকে মুখ করে খাড়া হয়ে গেল। আর তখুনি তারা দূরে একটা শহর দেখতে পেল।

মজার ব্যাপার হল ব্যাঙ্গের চোখ তো পিঠের দিকে থাকে, তাই ওসাকার ব্যাঙ কিয়োটোর দিকে মুখ করলেও দেখল তার ওসাকা আর সেই রকম কিয়োটোর ব্যাঙ দেখল কিয়োটো।

দুজনেই তারা সমস্বরে বলে উঠল আরে বাস। ওসাকা তো দেখতে একেবারে কিয়োটো আর অন্য জনে বলে উঠল আরে কিয়োটো তো দেখতে একেবার ওসাকা।


দুজনেই ভাবল, তাহলে আর গিয়ে কি লাভ। এত দূরের শহর যদি আমার শহরের মতই হয় তবে আর কষ্ট করে লাভ কি। দুজনে একে অন্যের সাথে গলা মিলিয়ে আবার নিজের শহরের দিকে ফেরত রওয়ানা দিল। মনে মনে বলতে লাগল বেকার এত কষ্ট করলাম। একেবারে এক রকমেরই দেখতে ঐ শহরটা। আমার শহরেই আমি ভাল আছি।