ষোড়শ শতাব্দীতে রাণী ভিক্টোরিয়ার কাছ থেকে ইষ্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানি ব্যবসার যে ছাড়পত্র পায় সেটা এ
দেশে মুঘল, আফগান, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ফরাসীদের মতন দেশের কিছু অংশের উপর আধিপত্য
বিস্তারের ছাড়পত্র ছাড়া আর কিছু ছিল না।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যবসায়ী থেকে শাসক হিসাবে
রূপান্তরিত হয়ে যায়।
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারবর্ষে তিন জায়গা, মুম্বাই,
মাদ্রাজ এবং কলকাতায় তিনটি ব্যবসায়ের কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা চিন্তা করে।
গঙ্গার নাব্যতা, গুদাম বানানোর জন্য জায়গা কলকাতাকে কেন্দ্র হিসাবে স্থির
করে দেয়। লালদিঘির সুপেয় জল এবং দিঘির
চারদিকের জায়গা, এখানেই তাদের কেন্দ্র গরে
তোলায় প্রোৎসাহন দেয়। ঈষ্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানি আসলে ব্যবসায়ের নামে এক দখলকারী সংস্থা ছিল। এর কর্মচারীদের মধ্যে
সৈনিকদের সংখ্যাই ছিল প্রধান যাতে এরা স্থানীয় লোকেদের উপর জবরদস্তি করে ব্যবসা
এবং সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারে।
১৬৯০ নাগাদ পুরনো কেল্লা বা ফোর্টের আওতার মধ্যেই ইষ্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানির জুনিয়র ক্লার্ক বা করণিকরা মাটির তৈরী কাঁচা বাসাতে থাকতো। ১৬৯৫ সালের
জুন মাসের শেষের দিকে এক ঝড়ে এই সমস্ত কাঁচা বাড়ী ভেঙ্গে যায়। তখন ফোর্টের ভেতরেই
আবার তাদের জন্য বাসা বানান হয়। আজকে যেখানে জি পি ও আছে সেখানে থেকে ফেয়ারলি
প্লেস পর্যন্ত জায়গাতে এই বাসা বাড়ির জায়গা বানান হয়।
১৭৭০ সাল নাগাদ যখন বৃটিশরা আমেরিকা থেকে বিতারিত হল তখন তাদের
নজর আবার পূর্ব দিকে সরে এসেছিল। ভারতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যবসা করছিল বটে কিন্তু সেটা ছিল
লোকসানের ব্যবসা। কারণ কোম্পানি চালানোতে দক্ষতার অভাব এবং চুরি।। তাই ১৭৭৩ সালে
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে ঢেলে সাজান হল। একজন গভর্ণর জেনারেল নিয়োগ করা হল যাতে
তিনি লাভের দিকে বিশেষ ভাবে নজর দেন।তা ছাড়া
ইতিমধ্যে যে সমস্ত জায়গা বৃটিশ শাসনে এসেছিল সেখান থেকে যাতে কোন রকম কুশাসনের কথা বৃটেনে না পৌছায় সেটাও
দেখার দায়িত্ব তাকে দেওয়া হল।
ওয়ারেন হেষ্টিংস চীনে আফিং রপ্তানি করে লাভ বাড়ালেন আর তার সাথে
শক্ত হাতে শাসন চালু করলেন। এ কাজের জন্য তার দরকার ছিল একদল লোক যারা হিসাব
নিকাশে দক্ষ, যারা ভারতীয় ভাষায় কথা বলতে পারে। এরা হল করণিক অথবা ক্লার্ক বা
রাইটার্স। কিন্তু এদের থাকা্র জন্য একটা বন্দোবস্ত করতে হয়। আগে যে জায়গা ছিল
সেগুলো কাঁচা ছিল। তাই ফর্টন্যাম নামে এক সিভিল আর্কিটেক্ট আর টমাস লায়ন নামে এক
ছুতোর মিস্ত্রীদের ভার দেওয়া হল রাইটার্স বিল্ডিঙ্গের নক্সা তৈরী করতে। এদের
নক্সাতে তৈরী হল রাইটার্স বিল্ডিঙ্গের আদি রূপ
যেটা আদতে মিলিটারী ব্যারাকের আদলে তৈরী।
হেষ্টিংস যখন গভর্নর তখন রিচার্ড বারওয়েল ছিলেন
কাউন্সিলের মেম্বার। পুরনো ভাঙ্গা সেন্ট অ্যান চার্চের জমির সাথে পাশের জায়গাটিকে
মিলিয়ে বারওয়েলের তরফে টমাস লায়নকে দেওয়া হল যাতে তিনি ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্লার্কদের(করণিক)
থাকার জায়গা বানাতে পারেন। এই ক্লার্কদের রাইটার্স বলা হত বলে বিল্ডিঙ্গের নাম হল
রাইটার্স বিল্ডিং। এটা হচ্ছে ১৭৭৬ সালের ঘটনা। সেই সময়ে কলকাতার প্রথম তিনতলা বাড়ি
হল এই রাইটার্স বিল্ডিং। তৈরী করা হয়ে গেলে ১৭৮০ সালে রিচার্ড বারয়েল ইষ্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানীকে তাদের করনিকদের থাকার জায়গা হিসাবে পাঁচ বছরের জন্য বাৎসরিক ৩১৭০০
টাকাতে লীজ দেন।
কুড়ি বছর বাদে ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ এই সমস্ত
করনিকদের ভারতীয় ভাষা শেখানর জন্য এই রাইটার্স বিল্ডিঙে শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা
চালু করেন। পরের কুড়ি বছরে ক্রমে এখানে
ছাত্রদের জন্য হোস্টেল, ক্লাসরুম, লাইব্রেরী, পরীক্ষার জন্য আলাদা জায়গা তৈরী করে
নেওয়া হয়।
১৮২১ সালে দোতলা এবং তিনতলাতে ১২৮ ফুট লম্বা বারান্দা
তৈরী করা হয় আর ৩২ ফুট উচু থাম তৈরী করা হয়। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ১৮৩০ সালে
এখান থেকে স্থানান্তকরন হলে রাইটার্স বিল্ডিং ব্যক্তিগত মালিকানাতে চলে যায় এবং রিচার্ড
বারওএলের ছেলেরা এক ট্রাষ্ট তৈরী করে বাড়িটা আবার কোম্পানি কে লীজে দেন। সেই সময়
কোম্পানির ক্লার্কেরা রাইটার্স বিল্ডিং কে তাদের থাকার জায়গা ছাড়াও মস্তির জা্যগা
হিসাব ব্যবহার করেছিল। যার যেমন দরকার লোকেরা তাদের ইচ্ছে মতন দোকান, গুদাম,
বাসাবাড়ি বানিয়ে নিয়েছিল। গভর্ণমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং
কলেজও কিছুদিনের জন্য এখানে কলেজ করেছিল। লোকে রাইটার্স বিল্ডিংকে একটা ভাঙ্গা
হাসপাতালের সাথে তুলনা করত।
১৮৩৬ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক এই সমস্ত ইচ্ছে মত বাড়িটাকে
বদলে নেওয়াকে আইন করে বন্ধ করে দেন।
এর বছর চল্লিশ বাদে ১৮৭১ নাগাদ লেফটেন্যান্ট গভর্নর জর্জ
ক্যাম্পবেল দেখলেন তার অফিসের জন্য কিছু জায়গার দরকার। ভাবা গেল এই রাইটার্স
বিল্ডিঙ্গের কথা। কিন্তু ইষ্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানি এই রাইটার্স বিল্ডিঙ্গের
বেশ কিছু জায়গা দখল করে ছিল আর তাদের অফিসের জন্য নতুন জায়গা পাচ্ছিল না। বছর
তিনেক বাদে ১৮৭৭ নাগাদ লেফটেন্যান্ট
গভর্নর অ্যাসলী ইডেনকে বলা হল সাডার স্ট্রিটে আর চৌরিঙ্গীতে যে সমস্ত অফিস ছিল
সেগুলোকে তুলে রাইটার্স বিল্ডিঙে নিয়ে আসতে। জায়গার অভাবে দেখা গেল। তাই ১৮৮২ র
মধ্যে তিনটে নতুন ব্লক তৈরী করা হল। বলে রাখি আগে রাইটার্স বিল্ডিঙ্গের সাথে
অনেকটা ফাঁকা জায়গা পড়ে ছিল। এর পরে আরও
দুটি ব্লক তৈরি করে সমস্ত অফিস গুলিকে একসাথে করা হল। দুটি লোহার তৈরী সিড়ি দেওয়া
হল যাতে এই ব্লকগুলিতে যাওয়া যায়। ১৮৮৩ নাগাদ রাইটার্সের উপরে দেবী মিনার্ভা এবং
আরও চারটি মুর্তি ( বিচার, বানিজ্য, বিজ্ঞান এবং কৃষি)(জিউস, হারমিস, এথেনা এবং
ডেমেটার) প্রতিষ্ঠা করা হল। এগুলির ভাস্কর হলেন উইলিয়াম ফ্রেডেরিক উডিংটন। একই সাথে মাঝখানে পোর্টিকো করা হল।এর গায়ে করা হল লাল রঙ
যার জন্য একে অনেকে লালবাড়ি বলে থাকে।
আপাতত রাইতার্সে সর্ব মোট ১৩ট ব্লক আছে তার মধ্যে রোটান্ডার সাথে প্রধান পাঁচটি
ব্লক হেরিটেজ বিল্ডিং এর আওতায় পড়ে।
স্বাধীনতার আন্দোলনে ১৯৩০ সালের ৮ই ডিসেম্বর, বিনয় বসু,
বাদল গুপ্ত আর দীনেশ গুপ্ত তখনকার প্রচন্ড অত্যাচারী পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনেরাল
কর্ণেল এন এস সিম্পসনকে এই রাইটার্স
বিল্ডিঙে গুলি করে মারেন। গুলি চালনার পরা তারা বিরাট পুলিশ বাহিনীর সাথে মোকাবিলা
করতে করতে যখন দেখেন তারা কোন ঠাসা হয়ে পড়েছেন তখন
বাদল গুপ্ত পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। বিনয় বসু এবং দীনেশ
গুপ্ত তাদের রিভলভার থেকে নিজেদের উপর গুলি করেন। এর পাচদিন বাদে হাসপাতালে বিনয়
বসু মারা যান,দীনেশ গুপ্তকে বৃটিশ সরকার ফাঁসি দেন। আজ সমগ্র ডালহাউসী এলাকা {এই
তিনজনে নামার আদ্যাক্ষর নয়ে তৈরী বি(নয়), বা(দল) দী(নেশ)} বিবাদী বাগ বলা হয়।
রাইটার্স বিল্ডিং ভুত? আজ্ঞে হ্যাঁ বিল্ডিঙ্গের প্রহরীদের মতে আছে।
যদিও তারা কারুর কোন ক্ষতি করেনি কিন্তু রাতে রাইটার্স বিল্ডিঙ্গের অলিন্দে তাদের
পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে রাইটার্সদের হল্লা হুল্লোরের আওয়াজ শুনতে পাওয়া
যায়। কেউ কেউ আবার কান্নার আওয়াজ পেয়েছেন। রাতে প্রহরী ছাড়া এখানে কেউ থাকেন না।
.
আমার নতুন ব্লগ dilip1935.blog.com গিয়ে দেখবেন এবং মতানত জানাবেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন