ইতিমধ্যে আমার আবার ট্রান্সফার হবার সময় এসে গেল। মানে
চার বছর এক জায়গাতে রয়ে গেছি আর কি কারুর সহ্য হয়। পাঠান হল আমাকে বিশাখাপত্তনমে
বা রেলের ভাষায় ওয়াল্টেয়ারে। সেটা হল ৭৭ সালের মার্চ নাগাদ। গিয়ে দেখি আমার
পূর্বসুরী, রেলের চাকরী ছেড়ে বেসরকারী কোম্পানিতে যোগ দিচ্ছেন, আমাকে তার জায়গা
নিতে হবে। কাজ হচ্ছে লোহার আকর জাপানে রপ্তানী করার জন্য যে কোত্তাভালাসা-কিরুন্ডুল
লাইন তৈরী হয়েছিল সেটার বৈদ্যুতিকরণ।
এই লাইনটার একটা বিশেষত্ব ছিল। পুর্বঘাট পর্বতমালা (অনন্তগিরি
রেঞ্জ) পার হয়ে এটা উড়িষ্যার ভেতর দিয়ে মধ্যপ্রদেশের বাস্তার (বর্তমানে ছত্তিশগড়ে)
এলাকায় কিরুন্দুলের বৈলাডিলা পাহাড়ের লৌহআকর রপ্তানীর জন্য তৈরী করা হয়েছিল।
সাধারণত পাহাড়ী এলাকাতে রেলের লাইন পাতার কাজে ছোট গেজ (ন্যারো) এর প্রয়োগ করা হয়,
কিন্তু এখানে বড় সাধারণ (ব্রড) গেজের ব্যবহার করা হয়েছিল কারণ এক সাথে অনেক মাল
বহন করা যাবে।
ওয়াল্টেয়ার আর ভিজিয়ানাগ্রামের মাঝামাঝি জায়গা
কোত্তাভালাসা থেকে এই লাইনটা পাহাড়ের দিকে ঘুরে গেছে। আর কিছুটা যাবার পরেই আসে
শৃঙ্গভরপুকোটা বা রেলের ভাষায় এস কোটা। এখান থেকে আরাকূ পর্যন্ত পাহাড়ী রাস্তা,
তার পরে কোরাপুট পর্যন্ত প্রায় সমান জমি। কোরাপুট পার হবার পরে অল্প কিছুটা পাহাড়
বেয়ে লাইন নীচে নেমেছে তার পরে মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে জগদলপুর হয়ে
দান্তেওয়ারা হয়ে কিরিন্দুল পৌঁছেছে।
আরাকু আসার আগেই রাস্তায় পড়ে বোড়াগুহালু ষ্টেশন। একটু
দূরে বোড়া গুহা। এক বিরাট গুহা যাতে উপর থেকে জল চুইয়ে পড়ে চূনাপাথরের স্তম্ভ
সৃষ্টি করেছে, নাম বৈজ্ঞানিকদের ভাষায় ষ্ট্যালাকটাইট আর ষ্ট্যালাগমাইট। লোকে
শিবলিঙ্গ ভেবে পূজোআচ্চাও করে। পরে পড়বে মাচকুন্ডের বাঁধ, আর তার কাছেই কিছু পুর্ব
বাংলার বাস্তুহারাদের কলোনি, কোরাপুটের কাছে সুনাবেড়াতে হিন্দুস্তান এরোনটিক্সের
কারখানা। কোরাপুট পার হবার পরে বড় জায়গা আসে জগদলপুর।
জগদলপুরের আগে আসে মালিগুড়া রেঞ্জ ফরেষ্ট। সন্ধ্যের পরে
যদি রাস্তা ধরে গাড়ীতে এই জঙ্গল পার হওয়া যায় তবে বাঘ দেখার সম্ভাবনা আছে। আমি বাঘ
দেখতে পাই নি কিন্তু নীলগাইকে কিছু হিংস্র জন্তু তাড়া করায় সে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য
হয়ে রাস্তা পার হচ্ছে দেখেছি। রেলের লাইনের আশপাশে তো ভাল্লুকের আনাগোনা লেগেই
থাকত। আমি নিজেও ভাল্লুক দেখছি। জগদলপুর পার হবার পরে আসে গিদাম, দান্তেওয়ারা
যেখানে সেই অবুঝমারের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এখানে রেলের লোকেরা রাত লাইনে
কোন কাজে (যেমন সিগনালে আলো লাগানো) জানোয়ারের
আক্রমণের ভয়ে যেতে চাইত না। বলা হয় এ জায়গা এখন মাওবাদীদের আস্তানা।
যদিও লাইনটা কিরিন্দুল পর্যন্ত গেছে লৌহ আকরের জন্য তবুও
এই আকর পাওয়া যেত বাচেলী আর কিরিন্দুলের মাঝ থেকেই। বড় বড় রোটারী এক্সকাভেটর দিয়ে
পাথর কাটা হচ্ছে আর তার পর তাকে নদীর জলে ধুয়ে মাটী সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। নদীর জল এই
ময়লা নিয়ে লাল হয়ে গেছে, মাছ আর পাওয়া যায় না, কিন্তু তার কোন খেয়াল নেই। বৈদেশিক
মুদ্রা রোজগার হচ্ছেত। এই প্রসঙ্গে বলি, আজকাল জাপানে আর আকর রপ্তানী হয় না। সমস্ত
আকর ভিশাখাপত্তনমে যে ইস্পাত কারখানা হয়েছে তাতে ব্যবহার করা হয়।
সাধারণত ব্রড গেজের লাইনের ঢাল (গ্রেডিয়েন্ট) প্রতি ১০০
ফুটে ১ ফিটের চেয়ে বেশি করা হয় না, এখানে প্রতি ৪০ ফিটে ১ ফিট ঢালে লাইন পাতা
হয়েছে, যার ফলে ৪০/৪২টা ৯০ টন আকর ভর্তি করার
ক্ষমতার খালি ওয়াগনকে টানতে তিনটে ইঞ্জিন কোন রকমে পেরে উঠত। আর যখন মাল ভর্তি করে
নামত, তখন ওয়াগনগুলো ঢালের মুখে পড়ে গতি পেলে ঐ তিনটে ইঞ্জিন লাগত তাদের টেনে
ব্রেক করে রাখার জন্য।
লাইনে বাঁক ছিল অসংখ্য আর টানেল ছিল মনে হচ্ছে ছিল ৫৮ টা। এই রকম ইঞ্জিনিয়ারিঙের একটা নিদর্শনে
দুর্ঘটনাও হত আকচার। তা ছাড়া পুর্বঘাট পর্বতমালার পাহাড়ে বঙ্গোপসাগরের ঘুর্ণিঝড়
প্রায়ই প্রচুর বৃষ্টিপাত করে ধ্বস নামিয়ে দিত, যার ফলে বর্ষাকালে ট্রেন চলাচল
অনিয়মিত থাকত।
রেলের একটা নিয়ম আছে য্ত।কোন লাইন যদি ১০০০ মিটার পার
করে, তবে তার পরের অংশটাতে যে সমস্ত কর্মচারী কাজ করেন তাঁদের পাহাড়ী ভাতা দিতে
হয়। রাস্তায় কিছুদূর যাবার পরে একটা ষ্টেশন আসে শিমিলিগুডা। দেখা গেল লাইনের উচ্চতা
হয়ে যাচ্ছে ১০০৪ মিটার। এই ষ্টেশনের পরে
লাইনটা কিন্তু নীচের দিকে নেমে গেছে এবং আগে কোথাও আর ১০০০ মিটারের উচ্চতা পার
হয়নি। কিন্তু এই শিমিলিগুডা থেকে যেতে হবে আরও প্রায় ৩৫০ কিলোমিটারের মত।
তবে কি সেই সমস্ত ষ্টেশনের কর্মচারীদের ঐ পাহাড়ী ভাতা
দিতে হবে। উপায় একটাই। ঐ শিমিলিগুডা ষ্টেশনের সমস্তটা আর দুপাশে আরও এক কিলোমিটারের
মতন জায়গাতে পাহাড় কেটে ১০০০ মিটারের নীচে নামিয়ে আনা হল। ষ্টেশনের বাকী সব জায়গা,
যেমন ষ্টেশন বিল্ডিং, ষ্টাফ কোয়ার্টার সব ১০০০ মিটারের বেশী উচুতে। কিন্তু যেহেতু
লাইন আছে ৯৯৬ দশমিক কিছু মিটারে, তাই আর ভাতা দেবার দরকার পড়ল না।
আমার আইনত অফিস হল আরাকুতে, মানে ওয়াল্টেয়ার থেকে ১০০
কিলোমিটার দূরে, কিন্তু যেহেতু সমস্ত সমন্বয়ের কাজ ওয়াল্টেয়ারে, তাই আমার
অফিসের নাম হল আরাকু এট ওয়াল্টেয়ার, মানে আমি ওয়াল্টেয়ারে থাকব কিন্তু প্রায় একদিন
বাদে বাদেই আমাকে লাইনে যেতে হবে। অসুবিধার মধ্যে যাতায়াতের জন্য প্যাসেঞ্জার ট্রেন
ছিল দিনে একটি। সকালে ওয়াল্টেয়ার ছাড়ে, আরাকু পৌছতে লাগে পাঁচ থেকে ছ ঘন্টা আর
ফেরার ট্রেন আরাকুতে রাত দুটোর সময়। সকাল আটটার পরে এসে ওয়াল্টেয়ারে পৌছবে।
আরাকু জায়গাটা অদ্ভুত, সারা দিনে তিনটে ঋতুকে উপভোগ করা
যেতে পারে, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ভ্যাপ্সা গরম, প্রায় গ্রীষ্ম কাল, বিকেলের
দিকে বৃষ্টিতে বর্ষাকালের আনন্দ আর রাত পড়লেই ঠান্ডা, শীতকালের মত। সারা বছর রাতে
গরম জামা পড়ে থাকতে হবে। আমার হল মুশকিল, ওয়াল্টেয়ার থেকে যখন বার হই তখন ওখানে
বেশ গরম থাকে। অবশ্যি ওয়াল্টেয়ার সমূদ্রের ধারে হবার জন্য একমাত্র বর্ষাকালেই একটু
ঠান্ডা বোধ হয়, নইলে বাকী সব সময় গরম। স্নান করে গা মোছা শেষ হতে না হতেই আবার
মুছতে হয়, তবে এবার জল নয়, ঘাম।
লোকেদের কথ্য ভাষা তেলেগু। এর আগে শুনিইনি। বাসে নম্বর
রোমান অক্ষরে কিন্তু গন্তব্যস্থল তেলেগু ভাষায় লেখা। বাসে কন্ডাক্টরের ভাষা
তেলেগু। দোকানে কিছু জিনিষ কিনতে গেলে বিপদ, কি করে জিনিষের নাম বোঝাব? উপায় একটাই
স্যাম্পল হাতে নিয়ে বাজারে যাওয়া। কিন্তু সব্জী কেনার বিপদ অনেক, কায়লু আর পান্ডুর মধ্যে তফাৎ (মানে কাঁচা আর
পাকা) বোঝাতে হবে। তবে বাজারে গেলে যেহেতু সব্জী চিনি, তাই কেনার সময় নামটা শুনে
মুখস্থ করতে হত। মাছ কেনার সময় বিপদ ছিল, কেননা চপ্পল হল চপলু আর মাছ হল চ্যাপলু। দোকানীকে
আঙুল দিয়ে দেখিয়ে কথাটা বলার চেষ্টা করা হত।
পাহাড়ী এলাকা কাঠাল গাছে ভর্তি ছিল, তবুও সাধারণ লোকে
এঁচোড় (ওদিকের ভাষাতে পনসকায়) খেতে জানত না। মানে আমাদের মত গাছ পাঁঠা তৈরী করে
খাওয়ার মেথডে। ওদের এঁচোড় খাবার মেথড ছিল খোসা বাদ দেবার পরে একেবারে সব শুদ্ধ
কুচিকুচি করে কেটে রান্না করা। কলাগাছ থাকলেও থোড় বা মোচা, খাবার
হিসাবে গণ্য হত না। আমার সহকর্মী, যে এস কোটাতে থাকত তার কাছে বলা ছিল যে
কাঁচাকলার গাছ না হলে থোড় আর মোচা আমাকে পাঠাতে। মাসে এই রকম বার দুয়েক সাপ্লাই
এসে যেত। লাউ খাওয়া হবে কিন্তু লাউডগা তো গরুর খাদ্য।
ভাষা বিভ্রাটের আর একটা উদাহরণ দিচ্ছি। একবার আমার এক
খালাসীকে বলেছি বস্তা করে গুল (মানে গুড়ো কয়লার ব্রিকেট, তখনও ওয়াল্টেয়ারে গ্যাসের
সাপ্লাই চালু হয়নি) নিয়ে আসতে। এখন বোড়া হিন্দি মানে বস্তা, কিন্তু তেলেগুতে বোড়া মানে মাথা বা বড়টা। গুল
বদলে গেছে তার কাছে গুডলুতে মানে ডিমে। লোকটা অবাক, মাথা ভর্তি ডিম আনতে বলে কেন?
চিন্তা করতে হবে যে আমার অফিসে তখন প্রায় শ চারেকের মত
লোক, ফিটার থেকে খালাসী মিলিয়ে ছিল আর তার মধ্যে অন্য ভাষাভাষী কেউ নেই। দোভাষির
কাজে আমার দুই সহকারী তেলেগু ষ্টাফ, যারা খড়গপুরে বছর ছয়েক কাটিয়েছে। এরা দুজনে
যদিও আরাকুতে থাকত, আর এত সুন্দর বাংলা বলত যে আমার কেন আমার এবং আমার ফ্যামিলির
কারুর অসুবিধা হত না।
কিন্তু আমাকে এর রাস্তা খুঁজে বার করতে হল। প্রথমে
সিনেমার পোষ্টার দেখে অক্ষর চেনা। তার পরে পেদ্দা শিক্ষা মানে বড়দের জন্য শিক্ষা
বইটা জোগাড় করে পড়া, আর লোকেদের হুকুম দেওয়া যে আমাকে তারা তেলেগু ছাড়া অন্য কিছু
(সাইন ল্যাঙ্গুয়েজও না) বোঝানর জন্য
ব্যবহার করবে না। ফল দিল। আমি তেলেগু বই পড়তে শিখে গেলাম আর কথাও বলতে। আজ অবশ্যি বছর
ত্রিশ পয়ত্রিশ বাদে চর্চার অভাবে পড়তে পারিনা, কিন্তু ভাঙ্গা ভাঙ্গা বলতে পারি।
এই লাইনটা তৈরী করার সময় প্রজেক্টটা ছিল ডি বি কে
(দন্ডকারণ্য, বোলাঙ্গীর কিরিবুরু) প্রজেক্ট নামে। ষ্টাফেদের জন্য একটা কলোনীও তৈরী
ছিল। বাড়ীগুলো তৈরী ছিল পাথর দিয়ে, যাকে ইঞ্জিনিয়ারিং ভাষায় বলা হয় র্যান্ডম রাবল
ম্যাসনারী। ছাদ থেকে জল চুইয়ে আসার সম্ভাবনা খুব থেকে যায়। প্রথমে আমার আস্তানা
পাওয়া গেল এই রকম এক কোয়ার্টারে। আমি বিলাসপুর গিয়ে মালপত্র বুক করে এলাম আর বিশেষ
খেয়াল রাখা হল যাতে ওয়াগন এসে পৌছয় তিন সাতেকের মধ্যে। মালপত্র পৌছলে তবে ফ্যামিলী
নিয়ে আসা হবে। এবার আর মালপত্র এসে পৌঁছতে দেরি হয়নি।