সোমবার, ২ মার্চ, ২০১৫

কৃতজ্ঞতা (জাপানী রূপকথা)

 কোন এক সময়ে জাপানের হিতাচীতে নামইকাটা নামে একটা জায়গায় এক পন্ডিতমশাই থাকতেন। বয়স তার ছিল অনেক আর তার কোন ছেলেপিলেও ছিল না যারা তাঁকে খাবার তৈরী করে দেবে। পন্ডিতমশাই তার রান্নাবান্না নিজেই করে নিতেন আর দিন রাত মনদিয়ে প্রার্থনা করতেন, “ নামু আমিদা বুতসু “ মানে হচ্ছে, ওম মনিপদ্মে হুম। কাছের গ্রামের লোকজনেরা তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করত আর শাক সব্জী, কলাটা মুলোটা দিয়ে যেত। এমনকি তার ঘরের মেরামতীর দরকার পড়লে তারাই এসে সেটা করে দিত। এক শীতের রাতে যখন বাইরে খুব ঠান্ডা পড়েছে, তখন পন্ডিতমশাই শুনলেন কে যেন তাঁকে বাইরে ডাকছে, “পন্ডিতমশাই, পন্ডিতমশাই”। উঠে দরজা খুলে দেখেন বেজীর মতন একটা জন্তু দরজাতে দাঁড়িয়ে আছে। নাম তার ছিল ব্যাজার। রাতবিরেতে এই রকম একটা জন্তুকে দরজাতে দেখলে লোকে সাধারনত ভয় পাবে, কিন্তু পন্ডিতমশাই ভয় পেলেন না। বরঞ্চ জিজ্ঞেস করলেন কি চাই তার। ব্যাজার বলে, “প্রভু আমি এতদিন পাহাড়ে থাকতাম কিন্তু এখন বয়স হয়েছে ঠান্ডায় বড্ড কষ্ট পাচ্ছি। আপনি যদি দয়া করে আমাকে আপনার ঘরে একটু জায়গা দেন আর আপনার ঘরের একটু আগুন পোহাতে দেন, তবে আমি একটু গরম থাকতে পারি”। পন্ডিতমশাইয়ের দয়া হল, আহারে বেচারা ঠান্ডায় কষ্ট পাচ্ছে। তাই বললেন, “এটা আর কি এমন কথা। চটপট ঘরে ঢুকে এস, আর আগুনের পাশে বসে যাও”। ব্যাজার ঠিক এই রকম আশা করেনি। তবুও পন্ডিতমশাই বলামাত্র সে ঘরে ঢুকে এল আর আগুনের পাশে বসে গেল। পন্ডিতমশাই দরজা বন্ধ করে লেগে গেলেন আবার প্রার্থনা করতে। ঘন্টা দুয়েক বাদে ব্যাজার যখন বুঝতে পারল যে তার গা বেশ গরম হয়ে গেছে তখন সে পন্ডিতমশাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিল। তার পর থেকে সে রোজই রাতে পন্ডিতমশাইয়ের ঘরে আসতে শুরু করে দিল। আসার সময় ব্যাজার কিছু শুখনো ঘাস পাতা আগুনের জন্য নিয়ে আসত। এটা পন্ডিতমশাইয়ের অভ্যাসে মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছিল। যদি কোনদিন ব্যাজারের আসতে দেরী হত তো পন্ডিতমশাই ভাবতে থাকতেন কেন এত দেরী হচ্ছে। শীত চলে গেলে বসন্তকাল এসে পড়ল আর তখন ব্যাজার পন্ডিতমশাইয়ের কাছে আসা বন্ধ করে দিল। কিন্তু আবার ঘুরে শীত পড়তেই ব্যাজার এসে হাজির। আবার সেই আগের মতন ব্যাজার রোজ রাত্রে এসে পন্ডিতমশাইয়ের কাছে থাকে। এভাবে দশ দশটা বছর কেটে গেল। ব্যাজার বলে, “পন্ডিতমশাই আপনার দয়ায় তো আমার শীতগুলোতে কোন কষ্ট হয়নি। কিন্তু আপনার এই উপকারের বদলে আমি কি করতে পারি। আপনি বললে পরে সেটা না হয় আমি চেষ্টা করে দেখব”। পন্ডিতমশাই বলেন, “নারে ভাই, আমার কাছে তুমি বরাবর এই রকম ভাবে প্রতি শীতে আস সেটাই আমার সবচেয়ে ভাল লাগবে”। প্রত্যেক বছরই ব্যাজার পন্ডিতমশাইকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। শেষে এক দিন পন্ডিতমশাই বললেন, “দেখ ভাই। আমি তো সারাদিন প্রার্থনা করেই কাটাই, আর আমার জন্য প্রত্যেক দিনে যা যা দরকার, তা তো গ্রামের লোকেরাই আমাকে দিয়ে যায়। তাই বিশেষ কিছুর দরকার আছে বলে তো মনে হয় না। হ্যাঁ, তবে তুমি যখন এত কথা বলছ, তখন যদি আমাকে তিন রিয়ো সোনা দিতে পার তবে ভাল হয়। মানে আমি তো বুড়ো হয়েছি, যে কোনদিন মারা যেতে পারি। এখন ঐ তিন রিয়ো সোনা আমি যদি কোন মন্দিরে দান করি, তবে তারা আমার নির্বাণের জন্য ভাল করে প্রার্থনা করবে”। পন্ডিতমশাই যতক্ষণ এই কথাগুলো বলছিলেন ততক্ষণ ব্যাজার কে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। তাই দেখে পন্ডিতমশাই বললেন, “যাকগে, তোমায় এ নিয়ে চিন্তিত হতে হবে না কেননা নির্বাণের পথে যাচ্ছি যখন, তখন আমার হয়ে কেউ প্রার্থনা করে কি না করে তাতে কিছু এসে যায় না”। কিন্তু তার পরে ব্যাজার আর আসে না। পন্ডিত মশাই ভাবেন কি হল রে বাবা, নিশ্চয় টাকা জোগাড় হয়নি বলে আসছে না, আর নয়ত টাকা জোগাড় করতে গিয়ে কিছু দুর্ঘটনা হয়ে বেচারা মারা গেছে। এই ভাবেন আর নিজের উপরে রাগ করেন যে কেন তার ঐ সোনার কথা বলতে গেলেন। আর বেশী করে ব্যাজারের জন্য প্রার্থনা করতে থাকেন। এই রকম ভাবে তিন তিনটে বছর কেটে গেল। হঠাত এক রাতে পন্ডিত মশাই একটা ডাক শুনতে পেলেন, “গুরুদেব, ও গুরুদেব”। গলার আওয়াজ ব্যাজারের মতো লাগছে মনে হল। আনন্দে পন্ডিত মশাই এক লাফে উঠে দরজা খুলেই দেখেন সত্যি তো ব্যাজার দাঁড়িয়ে আছে। তিনি আনন্দে বলে উঠলেন, “কোথায় ছিলে এত দিন। এদিকে আমি চিন্তায় মরি তোমার কিছু বুঝি হল”। ব্যজার ঘরে ঢুকে বলে, “গুরুদেব, আপনি আমাকে যে সোনার কথা বলেছিলেন সেটা যদি কোন অসৎ কাজের জন্য হত তবে তো আমি যে কোন জায়গা থেকে চুরি করে আনতে পারতাম। কিন্তু যখন আপনি বললেন যে ওটা কোন মন্দিরে দেবেন, তখন আমি ভাবলাম চুরি করে তো কোন মহৎ কাজ হবে না। তাই আমি চলে গেছিলাম সাডো দ্বীপে। সেখানে খনির মজদুরেরা যে সমস্ত মাটী আর বালি খুঁড়ে সোনা নিয়ে বাকিটা ফেলে দ্যায় সেই গুলোকে গালিয়ে তার থেকে কিছু কিছু করে সোনা বার করেছি। সেই জন্যই এত দেরী হয়ে গেল”। এই বলে একটা কাপড়ের পুটুলী খুলে পন্ডিত মশাইকে দেখাল। হ্যাঁ সত্যি তো সোনাই দেখা যাচ্ছে। পন্ডিতমশাই সেটাকে তুলে নিয়ে বললেন, “তাহলে সত্যি তুমি আমার একটা কথার জন্য এত কষ্ট করলে, তোমাকে যে আমি কি বলব তা ভেবে পাচ্ছি না”। ব্যাজার বলে, “গুরুদেব, আমি আমার কর্তব্য করেছি, ওটা তো আমার করা উচিতই ছিল। দয়া করে একথা আপনি আর কাউকে বলবেন না”। পন্ডিত মশাই কথাটা শুনে বললেন, “কিন্তু না বলে তো থাকা যাবে না। কারণ আমার ঘরে এটা রাখলে পরে চোরে চুরি করে নিতে পারে। আর যদি মন্দিরে এখন দিই তবে লোকে ভাববে কোথা থেকে এই পন্ডিত ভিখিরীর এত টাকা হল যে সোনা দান করছে। অবশ্যি আমি বলতে পারি যে আমাকে তুমি দিয়েছ। তাতে একটা বিপদ হতে পারে যে তোমার উপরে লোকে হামলা করবে। তবুও যতদিন আমি বেঁচে আছি, ততদিন তুমি মাঝে মাঝে এসে আমার সাথে দেখা করে যেও”। তার পর থেকে যতদিন পন্ডিতমশাই বেঁচে ছিলেন, ততদিন ব্যাজার প্রতি শীতে তার ঘরে এসে রাত কাটাতেন। কিন্তু তোমরা এর থেকে কি শিখতে পারলে, দেখলে তো একটা জন্তুও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ইচ্ছে আর ক্ষমতা রাখে।

from Spicydilip http://ift.tt/1wYA6xU

via IFTTT

1 টি মন্তব্য: