রবিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৫

আমার দেখা সত্তরের দশক

৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ শেষ হল। পূর্ব পাকিস্তানে যত পাকিস্তানী সেনা ছিল, তাঁদের যুদ্ধ বন্দী হিসাবে ভারতে নিয়ে আসা হল। বিলাসপুর আর রায়পুরের মাঝে একটা সাময়িক আস্তানা খোলা হয়েছিল, যেখানে তাঁদের বন্দী করে রাখা হয়েছিল। অবশ্যি মাত্র পাঁচ মা্সের মধ্যেই তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত পাঠান হয়। এই যুদ্ধের আর্থিক ক্ষতিপূরণ, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পরোক্ষ কর হিসাবে নেওয়া হল। পাঁচ পয়সার রিফিউজী রিলিফের ষ্ট্যাম্প, সমস্ত ডাক বিভাগীয় কাজ কর্মে লাগানো বাধ্যতা মূলক হয়ে গেল। ঐ সময় থেকে মুল্যবৃদ্ধির সূত্রপাত হল যেটা আজকেও কমে নি।

রায়পুরের পাশেই ভিলাইয়ের ইস্পাত কারখানা, আর তার জন্য মালের আনা নেওয়ার জন্য তৈরী হয়েছিল বিশাল এলাকাতে ভিলাই রেলের ইয়ার্ড। নাম ভিলাই মার্শালিং ইয়ার্ড। আর এত রেলের কাজ হচ্ছে, অতএব তার জন্য চাই কর্মীদলের থাকার জায়গা। ঐ ইয়ার্ডের পাশেই তৈরী হল এক বিশাল রেল কলোনী, নাম হল চারোদা বা বি এম ওয়াই, অর্থাৎ ভিলাই মার্শালিং ইয়ার্ড। চারোদা ছিল পুরনো ঐ জায়গার গ্রামের নাম।

ইয়ার্ডে লাইন বদল করার জন্য আর যাতায়াতের সুবিধার জন্য জায়গায় জায়গায় কেবিন ছিল। সাধারণত কোন ষ্টেশনে দুটির বেশী কেবিন হলে এ, বি, সি, ডি এই রকম ভাবে নাম রাখা হয়। এখানে এম পর্যন্ত চলে গেছিল বলে এরা নিজেদের পরিচয় অন্য ভাবে দিত। যেমন এইচ কেবিন নাম নিয়েছিল হাওড়া, ডি কেবিন দিল্লী, জি কেবিন গোন্ডিয়া, কে কেবিন কানপুর এই রকম। কিছু নাম ঐ ইংরাজী বর্ণমালা দিয়েও রেখে দেওয়া হয়েছিল।

দূর্গ-রায়পুর-বিলাসপুর অঞ্চলটাতে আমি যখন প্রথম যাই তখন রেলের লাইনের পাশে ধান, আর গমের ক্ষেত দেখতে পাওয়া যেত। কুড়ি বছর বাদে যখন আবার গেছি তখন সে জায়গাতে একের পর এক কারখানা তৈরী হয়ে গেছে, ধান ক্ষেতগুলো আর নেই। সাথে ধানের মিল গুলোর সংখ্যাও কমে গেছে। রায়পুরের পাশের ষ্টেশন ছিল সারোনা, যেখানে টি বি হাসপাতাল ছিল। হাসপাতালের চার দিকে বিরাট খোলা মাঠ আর ক্ষেত। এবার গিয়ে দেখতে পেলাম লাইনের পাশে হাসপাতালের ঠিক অপর পারে একটা স্পঞ্জ আয়রণের কারখানা হয়েছে। বায়ু দূষণের কথা চিন্তা করা হয় নি।

সারোনা থেকে আর একটু দূরে কুমহারী ষ্টেশন, ষ্টেশনের এক পাশে সালফ্যুরিক এসিড তৈরির কারখানা। অন্য পাশে কাপড়ের হোলসেল ভান্ডার। নানান জায়গা থেকে কাপড় আসে, পলিথিনে মুড়ে। আর সেই পলিথীনের সীট গুলো ছিড়ে কাপড় দোকানে দোকানে পাঠানর পরে সারা মাঠ ভরে থাকে ঐ পলিথীনে।

তার পরে ভিলাইয়ের ইস্পাত কারখানা, আর সাথে অনুসঙ্গী কাজের জন্য আরও কিছু কারখানা তৈরী হয়ে গেছে, এই সব জায়গাতে কাজের জন্য লোকের  দরকার অতএব তাঁদের বাসস্থান তৈরি হয়ে গেছে। আসলে দূর্গ থেকে রায়পুরের মধ্যে লাইনের পাশে খোলা জমি এখন আর দেখতে পাওয়া যাবে না।

আমি যখন ওখানে ছিলাম, তখন মান্ধার বলে একটা জায়গাতে এ সি সি র সিমেন্টের কারখানা তৈরী হল। টাকা বাঁচাতে তার চিমনীতে ডাষ্ট প্রেসিপিটেটর লাগানো হল না। ফল, কারখানার চারদিকে অন্তত তিন কিলোমিটার ব্যাসার্ধের জায়গাতে সিমেন্টের একটা আস্তরণ পড়ে গেল। প্রথমে কোম্পানি থেকে গ্রামের লোকেদের বলা হয়েছিল এই সিমেন্টের আস্তরণ ফলন বাড়াবে। কিন্তু পরে লোকে বুঝতে পেরে আন্দোলন করায় প্রেসিপিটেটর লাগানো হল। কিন্তু ততদিনে কাছের জমিগুলো আর চাষের যোগ্য রইল না।

টিলডা ষ্টেশনের কাছে সেঞ্চুরী সিমেন্টের কারখানা হবে, জমি চাই। এই জমি সংগ্রহের কাজে ছিলেন আমার চেনা এক ভদ্রলোক। কেউ জমি না দিতে চাইলে বা দামে না পোষালে, তার জমির চার দিকের জমি কিনে নেবার কাজ চালু হয়ে যেত আগে। কারণ তখন সেই অনিচ্ছুক চাষী তার জমিতে যাবার রাস্তা পাবে না। বাধ্য হয়েই আরও কম দামে সে এবার জমি বেচে দেবে।

ছত্তিশগড়ে যে উগ্রবাদী আন্দোলন এসেছে তার প্রধান কারণ হল এই রকম জোর করে গরীব চাষীদের ঠকিয়ে তাদের সম্পত্তি নেবার ইতিহাস। আমি ৭৭ সালে ছত্তিশগড় ছেড়েছি, তার পরেও এই আন্দোলন আরও উগ্ররূপ নিয়েছে। যদি সময় হয় তবে নব্বইয়ের দশকের কথাতে এই ব্যপারে লিখব।

রেলের যে বৈদ্যুতিকরনের কাজটা হচ্ছিল সেটাতে যদিও বেশীরভাগ কাজে কন্ট্রাক্টর নিযুক্ত থাকত তবুও রেলের নিজস্ব ভাবে কিছু কাজ করার জন্য সব সময়ই বেশ কিছু লোক লাগত। ৫৮ সাল থেকে এই যে সমস্ত লোকের দরকার হত তাদের কোন স্থায়ীত্ব ছিল না। কাজ শেষ তো ঘর যাও। অবশ্যি যে হেতু কাজ কোথাও না কোথাও হচ্ছে তাই এই সমস্ত শ্রমিকেরা দেশ দেশান্তরে ( এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে) ঘুরে ঘুরে কাজে যোগ দিত। কিন্তু সবাই তো আর যেতে পারেনা, তাই কেউ খুশী হয় আর কেউ না। 

৭১ সালের আগে থাকতেই এই শ্রমিকেরা একটা দাবী রেখেছিল যে তাঁদের অন্তত প্রাথমিক ভাবে এই সব কাজে অগ্রাধিকার দেওয়া হোক। এত দিন এই অগ্রাধিকারের ব্যপার ছিল না। সুপারভাইসরদের চেনা শোনার উপর এটা নির্ভরশীল ছিল। সেটা পাচ্ছে না বলে এরা এইবার ষ্ট্রাইক করে বসল।

আমাদেরও চাকুরী তখনও স্থায়ী হয় নি,  কাজেই আমাদের অবস্থা ওদের মতন না হলেও এমন একটা কিছু আলাদা ছিল না। ওদের আর আমাদের মধ্যে  একটা বিভাজন বরাবরই ছিল। তাই ওদের প্রথম রাগটা এসে পড়ল আমাদের উপরে। কাজে যাবার পথে আমাকে রাস্তায় কিছু শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হল। আমার ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলে একটা ফ্র্যাকচার এল।

রেলের তরফ থেকে তারা একটা সুযোগ পেয়ে গেল, আমাকে শহীদ বানানোর চেষ্টা হল। আমার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চারজন বন্দুকধারী আর পি এফ, ২৪ ঘন্টার জন্য মোতায়েন হয়ে গেল। রাতে আমার কোয়ার্টারের সামনে তাঁরা পাহারা দ্যায়। দিনে আমি কাজে গেলে সাথে যায়। কারুর সাথে মন খুলে কথা বলে যাবে না এই রকম অবস্থা করে দিয়েছিল।বন্ধু বান্ধবের আমার বাড়ী আসা বন্ধ হয়ে গেল।

বাধ্য হয়েই আমার বসের বসকে বলতে হল, ঘাট হয়েছে আমার,এবার তো কমলি হটাও। আমার আর কোন নিরাপত্তার দরকার নেই। ততদিনে অবস্থাও শান্ত হয়েছে দেখে পুলিশ পার্টীও তুলে নেওয়া হল। আমার বন্ধুরা আবার বাড়ীতে আসা শুরু করল।

এই সময় কাজের চাপটাও খুব বেড়ে গেছিল। তার কাটা, লাইনে দুর্ঘটনা লেগেই ছিল। এক দুপুরে হঠাত এই রকম দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আমি বেড়িয়ে গেছি। ঘরে এক বন্ধুর দুপুরে খাবার কথা আছে। আমার আশা ছিল যে সন্ধ্যের মধ্যেই ফিরতে পারব, কেননা তখনও খবর আছে যে বিশেষ কিছু হয় নি।

গিয়ে দেখি একটা ছোট ব্রিজের উপরে মালগাড়ী উল্টেছে, আর কম করে এক কিলোমিটারের মত জায়গাতে তার ছিঁড়ে একাকার কান্ড। লোকজন লাগিয়ে ঠিক করতে করতে লেগে গেল প্রায় ৪০ ঘন্টার মত। আমি ফিরলাম পরের পরের দিন সকালে। ঘরে কোন খবর দেবার উপায় ছিল না কারণ তখন মোবাইলের চলন হয় নি। বন্ধু এসে খেয়ে দেয়ে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করে তার ঘরে ফেরত গেল।

কাজের জন্য সকালে কাজে বেড়িয়ে যাই আর ফিরতে ফিরতে সেই মাঝ রাত হয়ে যায়। দুই ছেলেকে নিয়ে তাঁদের মা সংসার টেনে চলে।  এই অবস্থাতে সংসারের আয়তন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবার সম্ভাবনা হল। কিন্তু তার ফল হল অন্য ধরণের। আমার অনুপস্থিতিতে তার মানসিক টেন্সন বৃদ্ধি পেল। 


ভাবী আগন্তুক তার মাকে বেশ কিছু ভয় দেখানতে ডাক্তার বলে দিল হাসপাতালে ভর্তি করুন। অনেক রিকোয়েষ্টের পরে কমপ্লিট বেডরেষ্ট হবে, এই করারে বাড়িতে থাকার অনুমতি দিয়েছিল। পরে আর কোন  গণ্ডগোল না করে কন্যা সন্তান কোলে এলেন। 


1 টি মন্তব্য: