সোমবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১২

চাকুরী জীবন - পর্ব - ৩

পুরুলিয়া ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত

১৯৫৯ অক্টোবর থেকে –পর্ব -৩
         
          এই সময়কার একটা অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়। আমার এক সহকর্মী আসানসোলের এক বয়োজ্যেষ্ঠ কর্মীর মেয়ের সাথে প্রেম সম্পর্ক চলছিল। এ কথাটা ও বাড়ীতে মেয়ের বাবা মা জানতেন এবং আমার বন্ধুকে হবু জামাই হিসাবে মেনে নিয়ে ছিলেন। মেয়েটি আমাকে দাদা বলে মানত। তার প্রায় সমবয়সী এক মাসী ছিলেন। হঠাত একদিন সন্ধেবেলায় ফিরে খবর পেলাম যে আমার খোঁজে একটি মেয়ে এসেছিল। বয়স প্রায় কুড়ি বাইশ হবে। বলে গেছে কাল আবার আসবে। নাম ধাম কিছু বলে নি। একাই এসেছিল। একটু চিন্তিত হলাম কেননা আমার খোঁজে মেয়ে মানুষ একা, নিশ্চয় ভাববার কথা। আরও একটু বলি, আমাদের কেউই তখন বিবাহিত নই। যথা নিয়মে পরের দিন বিকেল নাগাদ দেখি একটি সুশ্রী মহিলা, বয়স ঐ কুড়িবাইশ হবে, আমার কোয়ার্টারে এলেন। পরিচয় দেবার বদলে খালি একথা সেকথা বলে যাচ্ছেন, আমি তত শঙ্কিত হচ্ছি ,- 'এ আবার কেরে বাবা'। সন্ধের মুখে চা খাইয়ে তাকে নিয়ে রিক্সাতে তুলে দিলাম ষ্টেসনে যাবার জন্য। যাবার সময় নাম হিসাবে বললেন "আমি মাসী"। কার সে সব কিছু না। আমি ভাবতে লাগলাম এটা কি ব্যপার। আমাকে  ফাঁদে ফেলার কিছু নয় তো। বেশ কিছু দিন পরে আমার সেই আসানসোলের হবু জামাইএর সাথে দেখা। তার প্রথম কথা হল 'আমি জিতে গেছি রে'আমাকে পরে বলল যে এসেছিল সে ওর হবুর মাসী। ওর সাথে বাজী ধরেছিল যে আমাকে ঘায়েল করে দেবে আর আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খাব। সেটা হলনা দেখে কিন্তু খুবই মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ছিল। আমার সাথে ঐ মাসীর দেখা হবার পরে সেটা প্রকাশ হয়ে ছিল।
সস্রধারা প্রপাত

          একবার ঠিক হল আমরা সবাই মিলে রাচি বেড়াতে যাব। একমাত্র আমি ছাড়া বাকী সবাই আমার আদ্রার বন্ধু। পুরুলিয়ার থেকে সন্ধেবেলায় ছোট গাড়ীতে উঠলাম মাঝ রাতে মুরী। ট্রেনটা ওখানে থেমে থাকবে, ভোর বেলায় রাচী এক্সপ্রেস এলে তার যাত্রী নিয়ে ছাড়বে। আমরা কামরার দরজা ভেতর থেকে লক করে শুয়ে পড়লাম। রাত তিনটে নাগাদ দরজা ঠকঠকাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল বটে কিন্তু কে ওঠেঘুম থেকে আমরা উঠলাম প্রায় রাচির দিকে আধা রাস্তা আসার পর। সোজা রাচিতে না গিয়ে আমরা মাঝপথেই সহস্রধারা ষ্টেসনে নেমে  পড়লাম জোনহা প্রপাত দেখতে যাব বলে। ষ্টেসন থেকে কিছুটা দূরেই প্রপাতটা। এটাকে ঠিক প্রপাত না বলে ঝর্ণা বললে ঠিক হবে। উঁচু থেকে জল পড়ছে বটে কিন্তু তার হাইট অল্পই। যেখানে জল পড়ছে সেখানে আমরা জলে নেমে বেশ কিছুক্ষন মাতামাতি করলাম। জোনহাকে সহস্রধারাও বলে। সাথে একটা ছবি দিলামওখান থেকে বেড়িয়ে রাচিপরের দিন আমরা গেলাম হুন্ড্রু প্রপাত দেখতে। এটা সত্যিই একটা প্রপাত। প্রায় ২০০ ফুট উপর থেকে জল পড়ছে। আমি খুব একটা রিস্ক নিয়ে প্রপাতের ওপাশে গিয়ে জল পড়ার একটা ছবি নিয়েছিলাম। ছবিটা এখানে দিলাম। সাথে নেটের থেকে নেওয়া একটা ছবিতে আমি দাগ দিয়ে দিচ্ছি কোথা থেকে নেওয়া ছবিটা। সমস্ত জায়গাটা জলে ভিজে পেছল হয়ে ছিল, আর হাতে ক্যামেরা থাকায় ধরবার কোন সম্ভাবনাই ছিলনা। দুপুরের দিকে ঠিক হল যে আমরা সবাই নেতারহাট যাব।

হুন্দ্রু প্রপাতের চেহারা

হুন্ড্রু প্রপাতের জলধারা


          নেতারহাট বর্তমান ঝাড়খন্ডের তিন জেলা, পালামউ, হাজারীবাগ, আর রাচির সংযোগ স্থল। পাহাড়ী জায়গা। রাচি থেকে বাসে প্রায় ঘন্টা পাঁচেকের মতন লাগে। থাকার জন্য প্রতি জেলার আলাদা রেস্ট হাউস আছে। সরকারী কর্মচারীরা ডিউটিতে না এলে পরে ট্যুরিষ্টরা থাকতে পারে। সাধারণতঃ তিন জেলার সরকারী কর্মচারিরা একসাথে আসেন না কাজেই আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম যে জায়গা পাওয়া যাবেই। আমাদের এতই কপাল খারাপ, আমরা গিয়ে শুনলাম শ্রী অরবিন্দ নেতাম, যিনি পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছিলেন, সদলবলে আসছেন অতএব কোন রেস্ট হাউসেই থাকতে পারা যাবে না। নেতারহাট তখন এমন জায়গা যে বিকেলের যে বাসটা আমাদের নিয়ে সন্ধেবেলায় পৌঁছেছিল সেটাই আবার ভোর বেলায় রাচি ফেরত আসবে। এটা ছাড়া আর কোন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই। নানা রকম ভাবে মিনতি করার পরে তারা এক রেস্ট হাউসের ক্যান্টিনে সতরঞ্চি পেতে বসা/শোয়ার জায়গা দিল। পাহাড়ি জায়গা, রাতে ক্রমশঃ ঠান্ডা বাড়ছে। আমরা যে যার কম্বল গুলো পায়ের উপর চাপিয়ে সিগারেট খেয়ে গা গরম করছি আর নেতামের মুন্ডপাত করছি, যে আর আসার সময় পেলনা। এই করতে করতে ভোর হল আর আমরা কোন রকমে নেতারহাটকে টা টা বাই বাই করে রাচি রওয়ানা হলাম। কাজেকাজেই নেতারহাটে কি দেখেছ জিজ্ঞেস করলে আমাদের উত্তর হত,- ক্যান্টিনের মেঝে, রাতের অন্ধকার, ভীষন ঠান্ডা এই সব। অথচ নেতারহাট থেকে সুর্যোদয় আর সুর্য্যাস্ত একটা দেখবার মত দৃশ্য। আমার পুরুলিয়ার কাজ শেষ হবার পথে তাই আমাকে এবার চক্রধরপুরে বদলী করা হল। আমাদের কাজের কন্ট্রাক্টর ছিল এক জাপানী গ্রুপ তারাও আসতে আসতে ফিরতে শুরু করলো। এক সকালের ট্রেন ধরে আমি চক্রধরপুর রওয়ানা হলাম। সেখানকার কথা পরে লিখবো। একজন ব্যাচিলর হিসাবে পুরুলিয়াকে আমার মনে সবসময়ই মনে থাকবে। আব্রাহাম, কোনার, দিব্যেন্দু বিস্বাদ, এই সব বন্ধুরা আজ কে কোথায় আছে জানিনা। এদের সাথে যতদিন চাকরী করছিলাম কিছুটা যোগাযোগ ছিল। হয়ত কোনদিন রাস্তায় চলতে চলতে এদের কারুর সাথে দেখা হয়ে যাবে। তখন আবার প্রাণ খুলে গল্প করা হবে,সুখ দুঃখের কথা হবে। সেই আশায় থাকছি।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন