বৃহস্পতিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

একটি প্লটের প্রসব গাথা


একটি প্লটের প্রসবগাথা

আমার আজকের কাহিনীর পাত্র পাত্রীদের পরিচয় প্রথমে দেওয়া যাক। নায়ক অনিকেত, ছোট গল্পের খ্যাতনামা লেখক, তার স্ত্রী শর্বরী, অনিকেতের বন্ধু শ্যামল, শ্যামলের স্ত্রী রাণী। স্থান অনিকেতের বাড়ির ড্রয়িং রুম। সময়  ধরা যাক রাত আটটার একটু ওপারেই। অনিকেতের হাতে বিয়ারের গ্লাস। শ্যামল একেবারে টিটোটালার, ও যে কি করে অনিকেতের এত গভীর বন্ধু হতে পারে সেটা ভাববার বিষয়। শর্বরী আর রাণী বিয়ার তেতো লাগে বলে খায় না। আজকে ওরা মকটেল হিসাবে টমাটো জ্যুসের সাথে স্প্রাইট মিশিয়ে  ব্লাডি মেরীর আদলে ব্লাডি পমি বানিয়ে নিয়েছে। ওদের মধ্যে আজকের আলোচনার বিষয়, অনিকেতের নতুন গল্পের প্লট ঠিক করা। আগে লেখকরা তাদের কাহিনীর প্লট নিজের মাথা থেকেই বার করে আনত। আজকাল ট্রেন্ড হচ্ছে একটু আলোচনা করে নিলে সব উদ্ভট কল্পনা গুলো বাদ দেওয়া যেতে পারে। বাইরে রিমঝিম করে বৃষ্টি পড়ছে। একটু ঠান্ডা হাওয়াও দিচ্ছে।
বিয়ারের গ্লাসে একটা সিপ দিয়ে অনিকেত বলল-" আজকের প্লটটা আমি ভাবছি একটু প্রেমের ওপরেই বানাব"।
"উহু, তোমার সেই ভুতুড়ে আবহাওয়াতে ঘোড়ার গাড়িতে যাবার বিষয়টাকেই নিয়ে গল্প বানাও" শর্বরী বাধা দিয়ে বলে উঠল।
"তার চেয়ে ভাল দুটোকে পাঞ্চ করে দে। ভুতুরে প্রেমের গল্প ভাবা যাক" শ্যামলের মন্তব্য।
তোর মাথায় এই সব গাঁজাখুরি প্লটের কথা গজায় কি করে রে। তুই তো মালও টানিস না। আজকাল কি লুকিয়ে লুকিয়ে গাঁজার ঠেকে বসছিস নাকি ভাই" অনিকেত বলল।
"কি কথা। রাণি যেন জানতে পারবে না, পারলেইতো তুলকালাম বাধাবে। তোমার মতন ও সাতারও কাটে না আর ধোয়াও ওড়ায় না।" শর্বরীর গলা।
কেন ভুতেরা কি প্রেম করে না, মানে প্রেমিকরা কি মরে ভুত পেত্নী হয় না? এতক্ষনে রাণীর গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। "পরশুরাম ভুশুন্ডীর মাঠে লেখেন নি।
"আরে বাবা, কোথায় পরশুরাম আর কোথায় এই গয়ারাম। ভুতেদের কি দেখেছি যে তাদের নিয়ে গল্প লিখব? প্রেমিক প্রেমিকা জ্যান্ত থেকে প্রেম করে তা জানি। সেটা লেখা যায়। আমাদের নিজেদের কথাটাই একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে লিখতে পারা যাবে। মড়ার পরে ওরা কোথায় যাবে কে বলতে পারে? আর তা ছাড়া ধর একজন হিন্দু তাকে পোড়ান হবে। আর অন্য জনকে যদি কবর দেওয়া হয় তবে? তারা ভুশন্ডীর মাঠে যাবে কি করে? এমনকি একটাকে নিমতলায় আর একটাকে কাশীতে নিয়ে গিয়ে পোড়ালে, ধোঁয়াগুলোও একসাথে মিশতে পারবে না।" অনিকেতের গলা।
          রাণি তার মতটা নাকচ হচ্ছে দেখে বলল," ঠিক আছে, তা হলে আপনাদের প্রেমের কথাটাকেই গল্প হিসাবে চালান। রিয়াল প্রেম, রিয়ালিটির ছোঁয়া থাকবে। আজকাল তো সবই রিয়ালিটিতে চলছে। নাচ, গান এবার প্রেমের গল্পে  আসল প্রেম।"
          এবার শর্বরীর মুখ লাল। কলেজে পড়ার সময়ের প্রেম। এখন মনে পড়লে গায়ে শিহরন জাগে। শ্যামল আর রাণী না থাকলে পরে ও হয়তো অনিকেতকে জড়িয়েই ধরত। " না না। তুমি সব কথা লিখবে না। আমাদের কথা ফাঁস হয়ে গেলে লজ্জায় পড়তে হবে"মুখ নীচু করে শর্বরী বলল।
          " আরে তোমায় ও সব ভাবতে হবে না। আমি কি বুদ্ধু যে নিজের কথা ঠিকঠাক পয়েন্ট বাই পয়েন্ট কার্বন কপি করব। ওখানে তুমি হবে ষোড়শী থেকে অষ্টাদশীর মধ্যে। স্কুল ফাইনাল দিচ্ছ। আর আমি সবে ভাল করে শেভ করা শুরু করেছি। বেকার, গ্র্যাজুয়েশন করছি, বাপের হোটেলে খাই আর তোমার সাথে প্রেম করি। তোমার সাথে আমার অ্যাকচুয়াল প্রেম শুরু তুমি তখন গ্র্যাজুয়েশনের ফার্স্ট ইয়ারে, আর আমি  এম এ ফাইনাল দিচ্ছি। তাও দেখতে দেখতে পাঁচ সাত বছর পেড়িয়ে গেল"।  আলতো করে পিঠে একটা চাপড় মেরে শর্বরীকে সান্তনা দিয়ে গ্লাসে আর একটা সিপ দিল
"তাহলে শুরু করা যাক। হুররে" একটা সমবেত কোলাহলে রুমটা ভরে গেল।
"প্রথমে প্রেমিকদের দেখা হবে। আমাদের দেখা হয়েছিল ক্যান্টিনে। স্কুলের ছাত্রী ক্যান্টিন কোথায় পাবে? ওদের আলাপ করিয়ে দিই সরস্বতী পুজার প্যান্ডেলে। প্রেমিকার নাম কি দেব? ইচ্ছে তো করছে তোমার নামটাই দেবার কিন্তু লোকে চিনে ফেলবে। ঠিক আছে। ওর নাম থাক পাখী। (এ নামে শর্বরীকে অনিকেত একান্তে ডাকে)"।
"প্রেমিকের নাম দাও সুনু। (এটা অনিকেতের নাম, শর্বরীর দেওয়া) ওকে একই পাড়াতে থাকতে দাও, যাতে তাড়াতাড়ি প্রেমটা জমে ওঠে। আজকাল যা রাস্তাঘাটের অবস্থা। আলাদা জায়গাতে থাকলে সময়ের গন্ডগোল হয়ে যাবে। আমাদের মতন আলাদা আলাদা এসে ভিক্টোরিয়ার পাশে দেখা করতে পারবে না"
"পাখীকে দিয়ে প্যান্ডেলে গানের একটা সিন দে। তখন তোমার একুশ বছর বোধ হয় আমি তখন অষ্টাদশীর ছোঁয়ায়। সাথে সুনুকে প্রথমে বেঞ্চি টানা প্রেমিক বানা। পড়ে আস্তে আস্তে প্রমোশন দিবি। লাভ এট ফার্স্ট সাইট করে শুরু করবি। ফাটাফাটী সিন। সাথে একটু পাখীর বাড়ী থেকে আপত্তিও জুড়ে দিতে পারিস।" শ্যামলের সাজেশন।
"আপত্তি খালি যেন মেয়ের দিক থেকেই আসে? কেন, সুনুর বাপের আপত্তিও তো থাকতে পারে।। তার চেয়ে দুই বাড়ী থেকেই আপত্তি থাকুক। ওরা লুকিয়ে লুকিয় প্রেম করুক। একটু অ্যাডভেঞ্চার মত হবে।" রাণীর বক্তব্য।
"কতদিন ওদের প্রেম চলবে" ?
"মানে"?
"মানে কতদিন বাদে ওরা এক হতে পারবে"?
"এক হতে হবে এর কোন মানে আছে? ট্রাজেডী তো হতে পারে"
"ঠিক আছে। ওদেরকে এক দেড় বছর প্রেম করতে দিই। তার পর পাখীর বিয়ের কথা পেরে দেব। ব্যর্থ প্রেমিক হয়ে সুনুকে দেবদাস বানানো চেষ্টা করব"
"হবে না। তার মানে আমাদেরও কি জীবনটা ট্রাজেডী হবে? এটাকে কমেডী বানাও। টানতে না চাও তো পাখীকে বাড়ী থেকে সুনুর সাথে পালাতে দাও। ওরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করুক"
"আজকালকার ছেলেমেয়েরা বিয়ে করে না। ওরা লিভ ইন থাকে"
"অসভ্য। এদিকে বলছ আমাদের কে মডেল করে গল্প বানাচ্ছ, ওদিকে লিভ ইন। আমরা তো বিয়ে করেছি। ওরাও করবে"
শর্বরী আর অনিকেতের এই খুনশুটিওয়ালা ঝগড়া শ্যামল আর রাণী উপভোগ করতে পারে না  ইনফ্যাক্ট ওরা প্রথমে মাস ছয়েক লিভ ইন ভাবেই ছিল, পরে বিয়ে করে নিয়েছে।
"ঠিক আছে। দেখা হবার বছর দেড়েকের মধ্যে পাখী পালাবে। সুনুকে তার আগে কোথাও কিছু টাকা জোগাড় করে দিতে হবে। আচ্ছা লটারীতে টাকা পাইয়ে দেব"?
"না না। ও সব আনরিয়ালিস্টিক। বরং ওকে দিয়ে ট্রেনে হকারী করিয়ে দে। তাতে বোঝাতে পারবি সুনু প্রেমের জন্যে যে কোন অবস্থা ফেস করতে পারবে। পাখীও বুঝুক কত ধানে কত চাল হয়। প্রেম করলেই হল। হিম্মত না থাকলে প্রেমে সফল হওয়া যায় না। তুই ওকে হয় ট্রেনে হকার নয়তো...  পেয়েছি, পেয়েছি, ওকে টিউশনি করতে দে। পাখীর কম্পিটিটর দাঁড় করিয়ে দে।"
"হ্যাঁএখানে ওখানে প্রেমের দোকান খোলো। কে আছিস রে আমায় প্রেম করতে দে। পাখী ওয়ান অ্যান্ড অনলি ওয়ান। নো কম্পিটিটর। তার পর প্রেমের জন্যে চুলোচুলি, সেটা মোটেই জমবে না। রাণি, শ্যামল কি তোর কোন কম্পিটিটর দাঁড় করিয়াছিল"?
রাণীর মুখ লাল। শ্যমলের জন্য সে সব কিছু ছেড়েছে। তার গানের ক্লাশ, টিউশনি, বাবা মা, আত্মীয় স্বজন। সব ঐ লিভ ইনের জন্য। শ্যামল সেই সময় ভাল রোজগার করত না। অনেকগুলো টিউশনি ছিল আর বেশীর ভাগই ছাত্রী। সেই জন্যই রাণী শ্যামলের কাছে চলে এসেছিল।
প্রত্যেকের গ্লাশ প্রায় খালি। এমন কি শ্যামলের জলের গ্লাশটাও।
অনিকেত বলে উঠল,  "বাস। প্লট রেডী। পাখী আর সুনু। ক্লাস টেন আর গ্রাজুয়েসন।এক পাড়ায় বাড়ী।। সরস্বতী পুজাতে দেখা। প্রথম দেখাতেই প্রেম। দুদিকের বাড়ীতেই আপত্তি। পাখী পালাতে চায়। সুনু ওকে অপেক্ষা করতে বলে। টাকার জন্য টিউশনি নেয়। পাখীর আপত্তিতে সবই ছাত্র, ছাত্রী একটাও না। একটু টাকা জমানোর পরেই পাখী পালাল। বিয়ে করলো। এক বছর বাদে ওদের বাবা মা ঘরে ফেরত নিল। কি রকম"?
"ফাইন। সুপার ফাইন"একসাথে সমবেত আওয়াজ।
আওয়াজ শুনে অনিকেত বুঝল প্লটের নিরাপদে প্রসব হয়ে গেছে।
   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন