আমার যৌবন
১৯৫৪-৫৯
১৯৫৪ এ কর্পোরেশনে এপ্রেন্টিস হিসাবে শুরু করার পড়ে প্রথম পাঁচ বছরের ডিউটি ছিল সোম আর মঙ্গলবার সকালে শেয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে যাদবপুর যাওয়া। বড় মামার সম্পত্তি হিসাবে তাঁর ড্রয়িং বক্স আর টি বাড়ীতে ছিল। ১৯৩১-৩২ সালে ট্রেনে লোকের ভীড় হতনা তাই বিশাল টি নিয়ে যাতায়াত করতে কোন অসুবিধা ছিল না। কিন্তু ২২ বছর বাদে, ওটাকে নিয়ে বাস বা ট্রেনে চড়া বেশ কষ্টকর ছিল। আজকের মত ফোল্ডিং টি বা ছোট টি ছিল না। কোয়ার্টারলি সীজন টিকিট কেটে যাতায়াত করতাম। কলেজের উল্টোদিকে ষ্টেশন রোডের উপর চায়ের দোকানে পাউরুটি আর আলুর দম ছিল টিফিন। যদি ড্রয়িং ক্লাস না থাকতো তা হলে বাসেও যেতাম। বাড়ীর বাছে বিবেকানন্দ রোড থেকে ৮বি দোতলা বাস সোজা যাদবপুরে নিয়ে যেত। অন্য কদিন ঐ ৮বি ধরেই এন্টালী মোড়ে নেমে ওয়ার্কশপ। সকাল ৮ টা থেকে বিকেল পাচটা। মজার কথা আমরা এপ্রেন্টিশ হলেও আমাদের জন্য কোন মেশিন খালি ছিল না। আর ওয়ার্কারদের আউটপুট এর উপর বোনাস হত বলে তারা মেশিন ছাড়তেও নারাজ থাকত। দাদা কাকা বলে তেল মেরে মেশিন পেতাম। এটা ম্যানেজারকে বলেও কোন সুরাহা হয় নি।
যেহেতু সকাল বেলায় লাঞ্চের বদলে হেভী ব্রেকফাস্ট করে যেতাম তাই টিফিন ব্রেকে ক্যান্টীন থেকে সাধারণত পাউরুটী আর আলুর দম দিয়ে টিফিন হত। যখন ওয়ার্কাররা আমাদের হাতে কাজ দিত না তখন আমাদের জন্য একটা কমন রুমের মত ঘরে টেবল টেনিস খেলায় সময় কাটত। কলেজে প্রত্যেক বছর একটা করে এক্সিহিভিশন হত। একবার ঠিক করলাম ওয়ার্কিং মডেলে লোহা গলানর কিউপোলা ফারনেস তৈরী করে দেখাব। ওয়ার্কশপে একটা বড় কিউপোলা ছিল। আমরা তার একটা ডাইন সাইজ ভার্সন তৈরী করলাম। প্রত্যেক দিন (বিকেল ৩টে থেকে রাত ৯টা পর্য্যন্ত সেটাতে প্রায় ৫০ কেজীর মতন ঢালাই করে দেখান হত। এর মধ্যে ছাঁচ তৈরিও দেখান হত। এই সময়ের একটা মজার ঘটনা বলি। একটা জলের ট্যাপকে ক্ল্যাম্পে লাগিয়ে তার মুখে এমটা ভিনাইল পাইপ লাগান হল আর তা দিয়ে টেবিলের নীচে থেকে জল পাম্প করে পাঠানোতে সেই জলটাই নলের মুখ দিয়ে নীচে পড়তে লাগলো। ট্যাপের পেছন দিকে কিছু লাগান না থাকায় লোকেরা ভাবল হাওয়া থেকে জল ধরে ট্যাপে দেওয়া হয়েছে। সাথে লেখা হয়েছিল নিউটনের ফোর্থ ল থেকে এই কাজটা করা হচ্ছে। আসলে ফোর্থ ল বলে কিছু নেই। নানা জায়গা থেকে এ সম্বন্ধে বিস্তারিত জানানোর জন্য অনুরোধ এসেছিল। শেষ পর্য্যন্ত লিখে দিতে হল এটা একটা চোখের ভ্রম।
১৯৫৪-৫৯
১৯৫৪ এ কর্পোরেশনে এপ্রেন্টিস হিসাবে শুরু করার পড়ে প্রথম পাঁচ বছরের ডিউটি ছিল সোম আর মঙ্গলবার সকালে শেয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে যাদবপুর যাওয়া। বড় মামার সম্পত্তি হিসাবে তাঁর ড্রয়িং বক্স আর টি বাড়ীতে ছিল। ১৯৩১-৩২ সালে ট্রেনে লোকের ভীড় হতনা তাই বিশাল টি নিয়ে যাতায়াত করতে কোন অসুবিধা ছিল না। কিন্তু ২২ বছর বাদে, ওটাকে নিয়ে বাস বা ট্রেনে চড়া বেশ কষ্টকর ছিল। আজকের মত ফোল্ডিং টি বা ছোট টি ছিল না। কোয়ার্টারলি সীজন টিকিট কেটে যাতায়াত করতাম। কলেজের উল্টোদিকে ষ্টেশন রোডের উপর চায়ের দোকানে পাউরুটি আর আলুর দম ছিল টিফিন। যদি ড্রয়িং ক্লাস না থাকতো তা হলে বাসেও যেতাম। বাড়ীর বাছে বিবেকানন্দ রোড থেকে ৮বি দোতলা বাস সোজা যাদবপুরে নিয়ে যেত। অন্য কদিন ঐ ৮বি ধরেই এন্টালী মোড়ে নেমে ওয়ার্কশপ। সকাল ৮ টা থেকে বিকেল পাচটা। মজার কথা আমরা এপ্রেন্টিশ হলেও আমাদের জন্য কোন মেশিন খালি ছিল না। আর ওয়ার্কারদের আউটপুট এর উপর বোনাস হত বলে তারা মেশিন ছাড়তেও নারাজ থাকত। দাদা কাকা বলে তেল মেরে মেশিন পেতাম। এটা ম্যানেজারকে বলেও কোন সুরাহা হয় নি।
যেহেতু সকাল বেলায় লাঞ্চের বদলে হেভী ব্রেকফাস্ট করে যেতাম তাই টিফিন ব্রেকে ক্যান্টীন থেকে সাধারণত পাউরুটী আর আলুর দম দিয়ে টিফিন হত। যখন ওয়ার্কাররা আমাদের হাতে কাজ দিত না তখন আমাদের জন্য একটা কমন রুমের মত ঘরে টেবল টেনিস খেলায় সময় কাটত। কলেজে প্রত্যেক বছর একটা করে এক্সিহিভিশন হত। একবার ঠিক করলাম ওয়ার্কিং মডেলে লোহা গলানর কিউপোলা ফারনেস তৈরী করে দেখাব। ওয়ার্কশপে একটা বড় কিউপোলা ছিল। আমরা তার একটা ডাইন সাইজ ভার্সন তৈরী করলাম। প্রত্যেক দিন (বিকেল ৩টে থেকে রাত ৯টা পর্য্যন্ত সেটাতে প্রায় ৫০ কেজীর মতন ঢালাই করে দেখান হত। এর মধ্যে ছাঁচ তৈরিও দেখান হত। এই সময়ের একটা মজার ঘটনা বলি। একটা জলের ট্যাপকে ক্ল্যাম্পে লাগিয়ে তার মুখে এমটা ভিনাইল পাইপ লাগান হল আর তা দিয়ে টেবিলের নীচে থেকে জল পাম্প করে পাঠানোতে সেই জলটাই নলের মুখ দিয়ে নীচে পড়তে লাগলো। ট্যাপের পেছন দিকে কিছু লাগান না থাকায় লোকেরা ভাবল হাওয়া থেকে জল ধরে ট্যাপে দেওয়া হয়েছে। সাথে লেখা হয়েছিল নিউটনের ফোর্থ ল থেকে এই কাজটা করা হচ্ছে। আসলে ফোর্থ ল বলে কিছু নেই। নানা জায়গা থেকে এ সম্বন্ধে বিস্তারিত জানানোর জন্য অনুরোধ এসেছিল। শেষ পর্য্যন্ত লিখে দিতে হল এটা একটা চোখের ভ্রম।
ওপরের ছবিটি ফ্লোরা ফাউন্টেনের ১৯৫৮ সালে গেভাবক্স ক্যামেরাতে
ওপরের ছবিটি মুম্বাইএর গেটয়ে অফ ইন্ডিয়ার ১৯৫৮ সালে গেভাবক্স ক্যামেরাতে তোলা
ছবি দুটি অজন্তার গূহার গায়ে পাথর খোদাই করে সৃষ্টি করা
ওয়ার্কশপের পাশেই ছিল ফিলিপস কোম্পানির এসেম্বলী শপ। সমস্ত কর্মীই মেয়ে। ফিলিপস ছুটী হত আমাদের ছুটীর আগে। কাজেই আমাদের কাজ ছিল কমন রুমের জানলা থেকে তাদের দেখা। এই প্রথম মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করলাম। আমার এই সময় সুমীল বসু, আর নিশীথ পাল নামে দুই সহপাঠীর সাথে গভীর বন্ধুত্ত গড়ে ওঠে। '৫৬এর পুজার সময় আমি আর সুমীল দুজনে মিলে ঠিক করলাম একটু বম্বে ঘুরে আসব। পুনেতে ওর দিদি জামাইবাবু থাকে পুজার কদিন ওখানে কাটিয়ে ফেরার সময় বম্বে ঘুরে ফিরে আসব। পুনার পৌঁছনর পরে ওর দিদি জামাইবাবু সুমীল কে আটকাতে পারলেও আমি একাই ফেরার জন্য বেড়িয়ে পড়লাম। এই প্রথম একেবারে একা ঘুরছি সকালে বম্বে নেমে এলিফ্যান্টা দেখে সারা দিন প্রায় কেটে গেল। সন্ধেবেলা মেরিন ড্রাইভ ইত্যাদি ঘুরে পরের দিন বম্বের ফ্লোরা ফাউন্টেন দেখে বম্বের বিখ্যাত ট্রামে চড়ে ফ্লোরা ফাউন্টেন (কালা ঘোড়া) থেকে মহালক্ষী পর্য্যন্ত ঘুরে এলাম সাথে আমার গেভাবক্স ক্যামেরা। তখনকার বম্বে (বর্তমান মুম্বাই) এর কতকগুলো ছবি দিলাম। তখন যদি জানতাম যে বম্বে থেকে ট্রাম তুলে দেওয়া হবে তবে তার ছবিও তুলে রাখতাম। রাখার ঠিক সুবিধা না থাকায় সাদা কাল ছবি গুলো আর তত পরিস্কার নেই। তবুও কয়েকটা ছবি সাথে দিলাম। রাতের ট্রেন ধরে মানমদ ষ্টেশনে গাড়ী চেঞ্জ করে আউরঙ্গাবাদ। গন্তব্য স্থল অজন্তা গুহা আর ইলোরার স্থাপত্য।
সকাল বেলা আউরঙ্গাবাদ ষ্টেশনে নেমে আশ্রয় নেয়া গেল কাছেরই এক ধর্মশালায়। এক ট্যুরিস্ট পার্টীর সাথে আলাপ, তারাও অজন্তা আর ইলোরা ঘুরতে যাবে। আউরঙ্গাবাদ থেকে ইলোরা প্রায় ৫০ মাইলের মত দূরে। একটা বাস ঠিক করে হল। সেটা আমাদের অজন্তা নিয়ে যাবে আর ফেরার পথে দৌলতাবাদের দুর্গ দেখিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।। সকাল আটটা নাগাদ বাস এসে হাজির। আমরা বাসে করে রওয়ানা দিলাম। পাহাড়ী রাস্তা ধরে প্রায় ঘন্টা দুয়েক চলার পড়ে আমরা পৌঁছলাম অজন্তার পাহাড়ের নীচে। সিড়ি ধরে উপরে উঠে পরপর ৩১টা গুহা। প্রথম দিকের গুহাগুলি ভাস্কর্য্য ও চিত্রকলায় অপুর্ব।অজন্তা দেখে আমরা ফেরের জন্য রওয়ানা দিলাম। পথে পড়ল দৌলতাবাদ কেল্লা
এই সেই পাহাড়ের উপরের অজেয় দুর্গ, যার প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন মুহম্মদ বিন তুঘলক, যখন তিনি তার সাম্রাজ্যের রাজধানী দিল্লী থেকে দৌলতাবাদে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। পাহাড়ের গায়ে সুরঙ্গ কেটে ভেতরে যাবার রাস্তা। ঘুটঘুটে কাল অন্ধকার, পা কোথায় ফেলছি তা দেখা যায় না। গাইড বলল, এই রাস্তাতে শত্রুর আক্রমণের সময় লোহার তৈরী কাঁটা ছড়িয়ে দেওয়া হত। কাটাগুলোর একটা দিক সব সময়ই ওপরদিকে মাথা করে থাকে যাতে সেটার ওপর পা পড়লেই পায়ে ঢুকে যাবে। রাস্তায় এদিক ওদিক থেকে গলি করা আছে। ঠিক রাস্তায় না চললেই সোজা পাহাড়ের নীচে। আমাদের গাইড মশাল জ্বেলে রাস্তা দেখিয়ে উপরে নিয়ে গেছিল। সুরঙ্গটা সোজা নয় একেবেঁকে গিয়েছে যাতে ঠিক রাস্তা বার করতে অনেক সময় লেগে যাবে। রাতে আউরঙ্গাবাদে পৌঁছনর আগে আমরা বিবি-কা-মকবরা দেখতে গেলাম। সম্রাট আউরংজেব দাক্ষিণাত্যে অভিযান করার সময় ত্তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয় মধ্যপ্রদেশের বুরহানপুরে। পরে আউরঙ্গাবাদে পৌঁছে তিনি তাজমহলের কপি করে তার স্ত্রীর জন্য এক সমাধিসোঁধ বানান আর বুরহানপুর থেকে মৃত স্ত্রীর দেহ তুলে নিয়ে এসে এই খানে সমাধিস্থ করেন। পরেরদিন সকালে আমরা চললাম ইলোরার ভাস্কর্য্য দেখতে। পাহাড়ের গা কেটে তিনতলা গুহা বানানো সামনে ঐ তিনতলার সমান উঁচু এক স্তম্ভ যার গায়ে অদ্ভুত কারুকার্য। এই গুহার নাম কৈলাস।। এর লিখে বিবরণ দেওয়া আমার সাধ্যের বাইরে। কিছু ফটো দিলাম আপনরাই বিচার করবেন। রাতের ট্রেন ধরে সোজা কলকাতায় ফেরত।
দীর্ঘ পাঁচ বছর পড়ে পাশ করার পরে শুরু হল আমার কর্মজীবন, তারিখ টা ছিল '৫৯ সালের সেপ্টেম্বার মাস। কর্মজীবনের কথা কারুরই ভাল লাগবে না, কেননা দলাদলি, খোসামোদি, বদলী, বিবাহত্তোর সংসার, ছেলেমেয়েদের মানুষ করা প্রত্যেকের জীবনেই আছে। তাই আমার কথার এখানেই ইতি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন