আমার
চাকুরী জীবন
১৯৫৯
সালের জুন মাসে আমার কর্পোরেশনের এপ্রেন্টিসশিপ শেষ হলে চাকরী খোঁজা শুরু হল।
অবশ্যি ৫৮ সালেই ইউপিএসসি ত্রিপুরা
পলিটেকনিকের একটা ডিমন্সট্রেটর পদের জন্য যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল তাতে আমি দরখাস্ত
দিয়েছিলাম আর দিল্লীতে ইন্টারভিউ দিতে ডাক এসেছিল। আমার সাথে আমার এক সহপাঠী দুজনে
গিয়েছিলাম দিল্লীতে। ঢোলপুর হাউসে আমাকে খালি জিজ্ঞাসা করা হল কলকাতাকে কেন সিটি
অফ প্রসেশন বলা হয়। এর সোজা মানে, আমাদের লোক ঠিক করা আছে, তুমি বাড়ী যেতে পার।
যাতায়াতের জন্য ট্রেনভাড়া দিয়েছিল এটাই ভাগ্যি। চেকটা হাতে নিয়ে সোজা বাড়ীর দিকে
রওয়ানা হতে হবে। ইতি মধ্যে আমাদের দিল্লী
ঘুরে দেখাও হয়েছে। আমরা গিয়ে উঠেছিলাম দিল্লী কালীবাড়ীতে। একটা ঘরে আমরা দুজনে।
খাওয়া কালীবাড়ীর ক্যান্টীন থেকে। যতদূর মনে পড়ছে মিল প্রতি এক টাকা নিত। মাহের
ঝোল, ডাল, ভাত, চাটনী, বেগুন বা আলু ভাজা, একেবারে পেট ভরে খাওয়া। রেড ফোর্ট,
কুতুব মিনার দেখে আমরা দুজনেই কলকাতায় ফিরলাম। চেকটা ভাঙ্গাতে কষ্ট পেতে হয়েছিল
কেননা আমার বা বাবার ব্যাঙ্ক একাউন্ট ছিল না। সাথে আমার সাথী গেভাবক্স ক্যামেরা,
সাদা কাল ফিল্ম । কুতুবের একটা ছবি এখানে দিলাম। দীর্ঘ ৫০/৫৫ বছরের কালের প্রকোপ
ছবিতে পড়েছে। তাকে বাচাতে পাড়িনি।
ছবিটা গেভাবক্স ক্যামেরাতে তোলা। ফিক্সড লেন্স আর ফিক্সড স্পীড।
এই
সময় বড়মামার সহপাঠী বীরেন ব্যানার্জীর একটা কনষ্ট্রাকশন কোম্পানিতে একটা অফার এল।
ওরা তখন দুর্গাপুর ইস্পাতের কারখানা তৈরির কাজে ব্যস্ত। আমার সাথে (মাকে বলেছিল)
মাইনে বা স্টাইপেন্ড হিসাবে মাসে ১০০ টাকা দেবার কথা হয়েছিল। এর সাথে থাকার জন্য
জায়গা। এক সন্ধেবেলা আমি আর বীরেন ব্যানার্জী( তিনু মামু বলে ডাকতাম) দুর্গাপুরের
জন্য ট্রেনে রওয়ানা দিলাম। আমি গিয়ে উঠলাম একটা টিনের শেডে (ডর্মিটরী)। সাথে একটা
কম্বল ছিল। সেটা জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। পরের দিন আমার সহকর্মী আমাকে সকাল ৬টা তে ডেকে দিল।
কাজে বেরতে হবে। পায়ে গামবুট, হাটু অবধি কাদা তার মধ্যে প্রায় দেড়/দু কিলমিটার
হেটে সাইটে পৌঁছলাম। আমার কাজ হল রোলিং মিলের
বেসমেন্টে কেবল লাগান কাজের সুপারভাইস করা। দিন চারেকের মধ্যে আমাকে বলা হল
কোক ওভেন প্ল্যান্টে কেবল লেয়িং আর জয়ন্টিং এর কাজ সুপারভাইস করতে। সকাল ৭টা থেকে
কাজ শুরু। দুপুরে ১২টা থেকে ১টা লাঞ্চ ব্রেক। (খেতে যেতে হবে প্রায় দু থেকে আড়াই
কিলমিটার দূরে, হেটে) বিকেল পাচটায় ছুটি। কিন্তু লেবাররা ওভারটাইম করবে তাই আমাকেও
থেকে যেতে হবে। যেহেতু কাজটা পছন্দের ছিল তাই এত কষ্ট সহ্য করেও টিকে থাকব ঠিক করেছিলাম।
কিন্তু আমার সব চেয়ে খারাপ লাগছিল যে রেগুলার যারা কোম্পানিতে ছিল তাদের মাইনে ছিল
১৫০ টাকা তার সাথে থাকা ও খাওয়া ফ্রি। সাইটে যাওয়া আর আসার জন্য গাড়ী দেওয়া হবে।
তা ছাড়াও কোম্পানির অন্য ডাইরেক্টর আমাকে মামার কনেকশন তুলে খোঁটা দেওয়াতে আমি
সোজা ২৪ ঘন্টার নোটিশ দিয়ে চাকরী ছেড়ে ফিরে এলাম। মোট হয়ত ১ মাসের মতন চাকরী
করেছিলাম। তিনু মামু যদিও আমার বড়মামার সহপাঠী ছিলেন তবুও তার একটু উন্নাসিক ভাব
যেটা আমাকে চাকরী দিয়ে দেখাতে চেয়েছিলেন সেটা প্রকাশ পেয়েছিল।
জুলাই
মাসে আমি বাড়ী ফিরে এলাম আর প্রায় সাথে সাথে রেলের থেকে আমার টেস্টের জন্য কল এল। ইন্টারভিউতে
কিছু টেকনিকাল প্রশ্ন করা হয়েছিল তার পর আমাকে মেডিকাল টেস্টে পাঠান হল। তখন
ভারতীয় রেল তার বৈদ্যুতীকরনের কাজ শুরু করেছে। এর আগে মুম্বাইতে আর মাদ্রাজে ট্রেন
বিদ্যুতে চলত। কলকাতায় হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল সবে চালু হয়েছে। প্রথমেই প্রায় ১২০০
কিলমিটার রেল বৈদ্যুতীকরণের কাজ নেওয়া হল। এটা তখন মালগাড়ী চালানর দিকে জোর দিয়ে
দুর্গাপুর থেকে গয়া,আর টাটানগর থেকে রাউরকেলা এবং ডাঙ্গোয়াপোসী পর্যন্ত করা শুরু
হল। এর সাথে আসানসোল থেকে চক্রধরপুর যোগ করে দেবার কাজ নেওয়া হল। সমস্ত কাজটাই
দুর্গাপুর, রউরকেলা কারখানাতে কাঁচা মাল আনা নেওয়ার সুবিধার জন্য করা হচ্ছিল। এখানে
বলে রাখি এই বৈদ্যুতীকরণের কাজ এখনও চলছে যাতে সারা ভারতে রেলে খালি বিদ্যুতই
ব্যবহার করা হয়। আমাকে পোষ্টিং দেওয়া হল আদ্রাতে। প্রথম বাড়ী থেকে এতটা দূরে চাকরী
নিয়ে এলাম। বাড়ী থেকে সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখে রাতে রওয়ানা দিয়েছিলাম। ভাদ্র মাস
বলে মা একটু আপত্তি করেছিল। সকালে জইন করে দেখলাম স্টেশনের ধারেই অফিস। থাকার জন্য
একটা তিন কামরাওয়ালা খালি কোয়ার্টারে জায়গা দেওয়া হল। আমাকে নিয়ে তখন ওখানে ১০ জন
ছেলে হয়ে গেল। আমাদের ডিউটি রেল লাইনের ধারে ধারে কাজ দেখার। সকাল সাড়ে পাচটায়
ট্রেন যাবার জন্য, আর ফেরার জন্য ট্রেন এসে পৌছবে সন্ধে সাড়ে সাতটার পরে। কোয়ার্টারে
জল আসবে বেলা দশটায় যখন জল ভরার জন্য কেউ থাছে না। তাই আমরা সকালে স্টেশনের জলে
দাত মেজে মুখ ধুয়ে চা বিস্কুট খেয়ে কাজে রওয়ানা দিতাম। দুপুরে লাইনের ধারে কোন পুকুরের
জলে স্নান করে কিট ব্যাগ থেকে পাউরুটি আর জ্যাম বার করে খাওয়া হত। রাতে ট্রেন থেকে
নেমে সোজা এক হোটেলে, যেখানে ভাত-ডাল তরকারী পাওয়া যেত। তাই খেয়ে পরের দিনে জন্য ওয়াটারবটলে
জল ভরে সেই কোয়ার্টারে ফেরা। ততক্ষণে শরীর ক্লান্তিতে ভারাক্রান্ত তাই বিছানায়
শোয়া মাত্র ঘুম। এই ভাবে চলল প্রায় দেড় মাসের মত। কাজ তখন চলছিল পুরুলিয়ার কাছে।
খবর পেলাম ওখানে কোয়ার্টার খালি আছে। এক রবিবার দেখে আমি আমার জিনিষপত্র নিয়ে পুরুলিয়াতে
চলে এলাম। আর সকাল পাচটার আগে উঠতে হবে না। খাবার নিজেই বানিয়ে নেবার সময় পাওয়া যাবে।
লাইনের ধারে একটা টিলার উপর পাশাপাশি চারটে কোয়ার্টার। পাশেই পুরুলিয়ার রেল কলোনীর
জলে সাপ্লাই করার জন্য ট্যাঙ্ক। আমাদের এই চারটে কোয়ার্টার ছাড়া বাকী সব কোয়ার্টারই
ছিল নীচে যাতে জলের প্রেশারের জন্য এই টিলাটাকে ব্যবহার করা হয়েছিল। কোয়ার্টারগুলোতে
ইলেক্ট্রিক ও জলের কনেকশন নেই। সাথী হিসাবে পেলাম এম পি আব্রাহাম, অসিত কোনার এবং আর
কে সিনহাকে। একমাত্র আব্রাহাম ছাড়া বাকীরা আমারই সহকর্মী। আব্রাহামের অফিস ছিল এই
কোয়ার্টারের পাশেই। আরও একটা কথা বলে রাখি লাইনে ট্রলী ঠেলার জন্যে পাচজন লোক
আমাদের সাথে থাকত। প্রথম প্রথম এদের মধ্যে যে কেউ একজন আমার দুবেলার রান্না করে
দিত। পরে অবশ্যি আমার আর আব্রাহামের একসাথে রান্না হত। তাতে দুজনেই সুবিধা ছিল।
পুরুলিয়ার কথা পরের পর্বে
লিখছি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন