১৯৫৯ অক্টোবর থেকে
এর
আগে আমি পুরুলিয়াতে চলে আসার কথা বলেছিলাম।পুরুলিয়া একটা ছোট শহর যদিও জেলার সদর
দফতর এখানে। অবশ্যি আমরা পুরুলিয়ার কথা পঞ্চন শতাব্দীর জৈন ভগবতী সুত্রে পাই।
পুরুলিয়া জেলা আগে জঙ্গল মহল জেলা বলে জানা যেত। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই জঙ্গলমহল
জেলাকে দু ভাগ করে মানভূম জেলার পত্তন করা হয়। ১৯৫৬ সালে রাজ্য পুর্ণগঠনের সময়
মানভূম জেলাকে দুভাগ করে পুরুলিয়া জেলা তৈরী করা হয়। বাকী ভাগটা বিহারের সাথে যোগ
করে দেওয়া হয়।
আসানসোল
থেকে টাটানগর যাবার রেলপথে পুরুলিয়া পড়ে। আগে এখান থেকে ছোট লাইনের গাড়ি মুরী হয়ে
রাচি যেত। নয়ত হাওড়া থেকে মুরী এসে গাড়ী বদল করে ঐ ছোট লাইনের গাড়ী ধরে রাচি যেতে
হত। পুরুলিয়ার কাছেই ছররা স্টেশন, যেখানে যুদ্ধের সময় বিশাল এয়ারবেস তৈরী করা
হয়েছিল। আমার কথা বলা সময়ে সেই এয়ারবেসের লম্বা রানওয়ে খালি পড়ে থাকত। এখন কথা
হচ্ছে আবার এই রানয়েকে কাজে লাগানোর।
পুরুলিয়া
আর আদ্রার মাঝে পড়ে জয়চন্ডী পাহাড়। একটা উঁচু ন্যাড়া পাহাড় যাতে এখন রক ক্লাইম্বিং
শেখান হয়। লোকে বলে আগের দিনে রাজা কাউকে মৃত্যুদন্ড দিলে তাকে এর উপর থেকে ফেলে
দেওয়া হত। পাহাড়টার একটা ছবি দিলাম। ছবিটা শ্রী অরবিন্দমনির সৌজন্যে পাওয়া নেটের
থেকে।
জয়চন্ডী পাহাড় |
কাসাই
বা কংসাবতী নদী পুরুলিয়ার পাশ দিয়েই বয়ে গেছে। একমাত্র বর্ষাকাল ছাড়া বালির মাঝ
দিয়ে একটুকরো ফিতের মত জলের রেখা দেখা যায়। অবশ্যি কাছের অযোধ্যা পাহাড়ের থেকে এর
শুরু কাজেই জল ধরার জন্য সে বিশেষ জায়গা এর মধ্যে পায়নি। আমার কোয়ার্টারটার পাশেই
ছিল একটা জলের ট্যাঙ্ক। কাসাই থেকে জল পাম্প করে ওতে তোলা হত আর স্টোর করা জল সারা
রেল কলোনিতে দেওয়া হত। টিলার উপরে ট্যাঙ্ক থাকাতে আর পাম্প করার দরকার হত না,
কেননা বাকী কোয়ার্টারগুলো নীচের লেভেলে ছিল।
আমার
পাশের ইউনিটটাতে থাকত এম পি আব্রাহান, আর একদিকেরটাতে থাকত অসিত কোনার। কোনার আমার
সহকর্মী। আব্রাহাম আসিস্ট্যান্ট ব্রিজ ইন্সপেক্টর। ওর অফিসটা ছিল কোয়ার্টারের
পাশেই। লাইনে যাতায়াতের জন্য আমাদের প্রত্যেকের কাছে পাচজন ট্রলীম্যান থাকত, যাদের
কাজ ছিল ট্রলী ঠেলা। এ কাজটা চারজনেই হয়ে যেত বলে একজন আমাদের ঘরদোর সামলানোর কাজে
লেগে যেত। প্রধানতঃ রান্নার ভার নিয়ে নিত। আর তাতে আমরা খুব খুসী থাকতাম। তবে বিপদ
একটা ছিল। যেদিন আমাদের লাইনে যেতে হত না সেদিন রান্নাঘরে পাচজনের উপস্থিতি, হয়
নুন নয় লঙ্কার পরিমানে গড়বড় করে দিত, আর খাওয়াটা মাঝপথেই থামিয়ে দিতে হত। তার উপর
আমি আর আব্রাহাম একসাথে মেসের মতন করে ছিলাম অতএব সময় সময় আমাদের রান্নাঘরে দশজন
রাধুনী যে কি করত তা কল্পনা করে নিতে হবে। বাধ্য হয়ে আমাদের ফরমান জারী করতে
হয়েছিল যে রান্নাঘর খালি একজনই ঢুকবে। এর পরে খাবার গুলো খাওয়ার যোগ্য হত। আমরা
নিজেদের নামগুলকে একটু ছোট করে নিয়েছিলাম। আমার ব্যানার্জী থেকে ব্যান আর
আব্রাহামের জন্য আবু থেকে বু। বিপদ হল আন্য সহকর্মীরা আমাদের ব্যানবু বা ব্যাম্বু
বলে ডাকতো।
একবার
সখ হল পাখী পুষতে হবে। দুজনে দুটো টিয়া ধরে তার ডানা ছেটে খাচায় পুরে রাখা হল। দুই
সিগারেটখোরের পোষ্যদেরও সিগারেট চাই অতএব কয়েকদিন পরেই আমাদের সিগারেটের ধোঁয়া নাক
দিয়ে পাখী দুটো নেওয়া শুরু করলো। আমারটার নাম দেওয়া হয়ছিল গ্লুটন আর আবুরটা
গ্র্যান্ড। ওদের ঐ নামে ডাকা হলে ওরাও গুটি গুটি এসে কাধের উপর চড়ে বসত আর মজাসে
ধূম্রপান করত। প্রথম প্রথম ওদের খাচাতে রাখা হলেও পরে ওরা দরজার পাল্লার উপরেই রাত কাটাত।এই সময়
আমাকে প্রায় প্রতি সপ্তাহে চক্রধরপুরে যেতে হত আর দুতিন দিন থাকতে হত। একবার আমি
এইরকম যাওয়ার পরে তিন দিন বাদে ফিরেছি। আবু আমাকে দেখেই বলল, দেখ তো গ্লুটন দুদিন
ধরে কিছু খাচ্ছেনা। আমি ডাকতেই এসে আমার কাধে চড়ে বসে অভ্যাস মতন আমার কানের
পাতাটাকে ঠোট দিয়ে চুলকোতে শুরু করলো। একটু বাদে নেমে এসে হাতের উপর বসলো। পিঠের
উপর হাতটা রাখার পর হঠাত অসাড় হয়ে পড়ে রইল। বুঝলাম আমাকে ছেড়ে আমার গ্লুটন চলে
গেছে। সেই রাতেই বাড়ীর পাশে একটা নিম গাছের গোড়ায় ওকে পুতে দিলাম। আবু তার
গ্র্যান্ডকেও আকাশে উড়িয়ে দিল। মজার কথা এতদিন কিন্তু গ্লুটন আর গ্র্যান্ড কেউই
খাচায় থাকত না কিন্তু উড়ে যাবার চেষ্টা করেনি। আমি এর পরে আর কোন পাখী পুষবোনা বলে
ঠিক করে ফেললাম।
আমাদের
সময় কাটত সকাল আটটা থেকে বিকেল পাচটা পর্যন্ত লাইনের কাজে ার তার পরে সন্ধে বেলায়
ইন্সটিটিউটে গিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলে। গরমের দিনে আর খেলা যেত না তখন শহরের রাস্তায়
একটু টহল মারা বা সিনেমা দেখা। সিনেমা বলতে তখন একটাই মাত্র হল ছিল। রিক্সাতে মাইক
লাগিয়ে কি সিনেমা চলছে তা জানান দিয়ে যেত। দাদার তখন সবেমাত্র বিয়ে হয়েছিল। আমি
বাবার পুরনো ঘিড়িটা ব্যবহার করছিলাম। সেটা গল্ড কেসের সাইমা ঘড়ি কিন্তু পুরনো
কাজেই কেসটাতে এক্টা ফুটো হয়েগিয়েছিল। দাদা একথে জানতেই তার হাত থেকে বিয়ের ঘড়িটা
খুলে আমায় দিয়ে দিল। বলল কলকাতাতে ঘড়ির প্রয়োজন হয় না। রাস্তাঘাটে ঘড়িই ঘড়ি। একদিন
ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়ে র্যাকেটে লেগে ঘড়িটা চুরমার হয়ে গেল। সযতনে তার পার্টস
তুলে দেশলাইএর বাক্সে ভরে কলকাতায় নিয়ে এসে সারাই করানর পরে দাদা জানতে পারে।
পুরুলিয়ার
লোকেদের অর্থনৈতিক অবস্থা তখন খুব খারাপ ছিল। একে পাথুরে লালমাটী তার উপরে বৃষ্টির
অভাব। কোনরকমে একটাই ফসল হত। কাজেই শহুরে বাবুরা এদের খুবই বঞ্চনা করত। আমি দেখেছি
দু টাকার বদলে একজন স্ত্রী তার ইজ্জত বেচে দিচ্ছে। একজন পুরুষ দুটাকার বদলে
একবস্তা চাল সাইকেলে করে ৫০ মাইল দূরে পৌঁছে দিয়ে আসছে। তখন একজন মজুরের দিনের
মাইনে ছিল একটাকা চার আনা (পাঁচ সেন্টের মতন)। একবেলা খাবার জন্য খুব বেশী হলে এক
সেন্টের মতন খরচ হত। আমার সংসার (মেস), দিনে পাঁচ প্যাকেট ক্যাপষ্টান সিগারেট,
ইম্পোর্টেড কেম্ব্রিকের শার্ট ইত্যাদিতে খুব বেশী হলে মাসে পঞ্চাশ টাকা ( দু
ডলারের মতন) খরচ হত। কিন্তু সাধারণ লোকেরা অত্যন্ত সৎ ছিল। একবার আমার মাইনের
টাকাটা বাড়ীতে মনিঅর্ডার করবো বলে বাইরে রেখে কথা বলতে বলতে আমি আদ্রার জন্য
রওয়ানা হয়ে গেছি। দু দিন বাদে ফেরার পরে আমার খালাসী আমাকে ডেকে টাকা গুলো কাগজের
তলা থেকে বার করে গুনে নিতে বলল। সে যদি টাকা নিয়ে পালিয়ে যেত তবে আমি কিছুই করতে
পারতাম না।
--- --- পরের পর্বে
চলবে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন