বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আমার ছোটবেলা

১৯৩৫ থেকে ১৯৪৪

আমার নিজের কথা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে আমি কি একটা কেষ্টবিষ্টু লোক যে লোকে আমার কথা নিজের সময় খরচ করে পড়বার জন্য তৈরী থাকবে। কিন্তু যদি ৫০ বছর পুরনো জিনিষ অ্যান্টিক হিসাবে লোকে খুজে বেড়ায় তবে আজ থেকে ৭০/৭৫ বছরের কথাও তো লোকেদের কাছে ভাল লাগতে পারে। অতএব কাজের শুরু করে দিলাম।
সময়টা ১৯৩৫ সাল। কলকাতার বউবাজারের লেডী ডাফরিন হাসপাতালে আমার জন্ম হয়েছিল। বাবা মার আমি দ্বিতীয় জীবিত সন্তান।
তখনকার দিনে হাতে বার্থ সার্টিফিকেটের চলন ছিল না বলে আমি আমার ঠিক জন্ম সময়টা জানি না, তবে সেটা যে একটা স্পেশাল মোমেন্ট হিসাবে মানা যেতে পারে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার কারণ প্রায় প্রতি সেকেন্ডে একজন মানুষের জন্ম হচ্ছে কিন্তু নিজের কথা লেখার মতন দুঃসাহস কজনের আছে। অবশ্যি দিগিন পাঠক নামে এক শুভচিন্তক (বাবার সহকর্মী) লম্বা হাতে তৈরী কাগজে আমাদের ভাইদের একটা করে ঠিকুজী তৈরী করে দিয়েছিলেন, সেটা আমি বড় হয়েও দেখেছি। কিন্তু ওটাকে গুরুত্ব দেওয়ার মত ইচ্ছে আমাদের বাড়ীতে কারুরই ছিল না।
বাবা সারদাচরণ ছিলেন নদীয়া জেলার শান্তিপুরের ভেরীপাড়ার বীরেশ্বর ব্যানার্জীর তৃতীয় পুত্র। আমার বড়জ্যেঠা কৃষ্ণচরন বৃটিশ সরকারের বিশিষ্ট চাকুরে হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতা আন্দোলনে বাবা জড়িয়ে পড়েন। ১৯১৩/১৪ সালের কথা। বাবা দিল্লীতে তাঁর বড় ভাইএর চাপে একটা সরকারী চাকরী নেন, কিন্তু বৃটিশ সরকারের অধীনে কাজ করব না মনস্থির করে সেটা ছেড়ে দিয়ে শান্তিপুরে ফিরে আসেন। এই সময় নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অমর মুখোপাধ্যায়, এবং আরও কিছু লোকেদের সাথে অনুশীলনগ্রুপে যোগ দেন। আমার বড় পিসীর বাবার সমবয়সী বড় ছেলে, ধীরেন চ্যাটার্জীও বাবার সাথে যোগ দেন। এর পরের ১০/১২ বছর সম্বন্ধে আমি বিশেষ কিছুই জানি না, বাবাকে জিজ্ঞেস করেও ডিটেইল কিছু পাই নি, খালি এটুকু জেনেছি যে ঢাকাতে একটা দোকান খুলে বাবা বিপ্লবীদের চর হিসাবে কাজ করতেন।এই সময় আমার মার সাথে বাবার পরিচয় হয়। মা, আশালতা, পূর্ব বাংলার ঢাকা জেলার বাঘিয়া গ্রামের কামাখ্যা চরণ গুপ্তের দ্বিতীয়া কন্যা। পরিচয়ের সূত্র ছিল চট্টগ্রাম বিপ্লবীদের মাধ্যম। আমার দিদিমা, হিরণবালা গুপ্তর বাডীটা ছিল এই সমস্ত বিপ্লবীদের সাময়িক আস্তানা।
 
আমি শুনেছি, ঘরে যখন পুলিশে তল্লাশী চালাচ্ছে তখন উনি আঁচলের তলায় লুকিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র অন্য জায়গাতে সরিয়ে ফেলের সাহস রাখতেন ও করেছেন। এই পরিচয় এত গভীর ছিল যে আমি বড় হবার পরে বাড়ীতে লোকনাথ বল, অনন্ত সিং, জীবনলাল চ্যাটার্জী, কল্পনা যোশি, এদের আসতে যেতে দেখেছি। পুর্ব বাংলার সাংসদ পুর্নেন্দু দস্তিদারের দুই পুত্র আমাদের বাড়ীতে থেকে তাদের কলকাতার পড়াশুনা করেছে। এই সময় বাবাকে পুলিশের কাছ থেকে আত্মগোপন করে ঢাকা থেকে পায়ে হেটে উত্তরবঙ্গ হয়ে বিহার হয়ে কলকাতায় আসেন।
কলকাতায় আসার আগে মা ঢাকাতে টীচার্স ট্রেনিং করেছিলেন এবং বাবা ও মা দুজনেই কলকাতা কর্পোরেশনের প্রাথমিক স্কুলে মাস্টার হিসাবে কাজ করেন। স্কুলটা ছিল ১০ নং সিমলা স্ট্রীটে, একতলায় ছেলেদের জন্যে আর উপরের তলায় মেয়েদের জন্যে। ক্লাশ ফোর পর্যন্ত এবং অবৈতনিক। বাবার স্কুলের হেডমাস্টার কে ছিলেন ঠিক মনে নেই কিন্তু সহকর্মী হিসাবে বৈদ্যনাথ মন্ডল, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী নাম মনে আছে। মার স্কুলে হেডমিস্ট্রেস ছিলে অংশুলেখা বন্দ্যোপাধ্যায়, এ ছাড়া বিজলী বিশ্বাস, পরিমল সেন,এদের নাম ও চেহারাটা মনে আছে।
 
স্কুলে ভর্তি হবার আগে একবার পুর্ব বাংলার ঢাকা জেলার বাঘিয়াতে মামা বাড়ীতে গিয়েছিলাম। অবশ্যি তার আগেই ওখান থেকে আমার মামা আর দিদিমা কলকাতায় চলে এসেছিলেন কিন্তু মার আত্মীয়রা ওখানে ছিলেন। যতদূর মনে পড়ে বাড়ীর পাশেই একটা খালের মতন ছিল যাতে নৌকা চলতো। এর পরে আর কোন দিন ওদিকে যাওয়া হয়ে ওঠে নি।
আমার প্রথম স্কুল হল জীতেন্দ্রনারায়ণ ইনফ্যান্ট নার্সারী স্কুল। কলকাতায় ডাফ স্ট্রীটের উপরে একটা একতলা বড় বাড়ীতে। বলতে গেলে আমরাই এই স্কুলের প্রথম ছাত্র। ১৯৪০/৪১ সালে। স্কুলের প্রতিষ্ঠাত্রী মৃন্ময়ী দেবী তার একমাত্র মৃত পুত্রের স্মৃতিতে এই স্কুলের স্থাপনা করেন। পরে দাদা ও আমার মাসতুতো দিদি স্কুলের প্রথম ব্যাচ আর আমি এবং আমার মাসতুতো দাদা দ্বিতীয় ব্যাচ। পড়ে এই স্কুলটা রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীটে নিজস্ব বাড়িতে উঠে চলে যায়।কলকাতায় এই সময় ভাড়াটিয়া এবং বাড়ীওয়ালার মধ্যে ক্লাশ ডিফারেন্স থাকলেও বাড়ি পাবার কোন অসুবিধা না থাকায় আমরা কোন বাড়ীতেই বেশীদিন থাকতাম না। আমার স্মরণে ৩৯ থেকে ৪২ এর মধ্যে প্রথমে বিবেকানন্দ রোড, সুকিয়া রো, সুবল চন্দ্র বসু লেন, রঘুনাথ চ্যাটার্জী স্ট্রীটে দুটি বাড়ী, মোট পাঁচবার বাড়ীবদল করেছি।
৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে প্রথমে কলকাতায় যুদ্ধের আঁচ বিশেষ বোঝা যায় নি। সিঙ্গাপুরের পতনের সময় থেকেই বার্মায় বসবাসকারী বাঙ্গালীরা হাটাপথে ভারতে চলে আসতে শুরু করেন। নিজের প্রাণ বাচানোর তাগিদে অসুস্থ পরিজনকে রাস্তার ধারে ফেলে রেখে সুস্থ লোকেরা আগে এগিয়ে এসেছে। কলকাতার লোকেরা শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে। লোকে অবস্থা বুঝবার চেস্টা না করে তাদের পৈত্রিক বাড়ীঘর জলের দামে বেচে দিয়ে পশ্চিমের দিকে পালাতে শুরু করেছিল। সেই সব সম্পত্তি কেনবার জন্য এগিয়ে এসেছিল কলকাতার মারওয়ারী সম্প্রদায়। ১৯৪২ সালে আমরা কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটে একটা বাড়ীতে উঠে আসি। আমরা যে বাড়ীতে এসে উঠলাম সেটার উপর নীচ দুতলায় মোট ৩ + ৩ = ৬টা ঘর,রান্নাঘর এবং বড় রাস্তার উপর বিশাল ছাদ এর সাথে। ভাড়া ছিল ২২ টাকা প্রতি মাসে। বাড়ীর সামনের রাস্তা দিয়ে ট্রাম চলতো, গ্যালিফ স্ট্রীট আর বেলগাছিয়াতে ট্রামের ডিপো ছিল, শ্যামবাজারে ট্রামের টারমিনাস ছিল। ট্রাম চলতো শ্যামবাজার থেকে এসপ্লানেড বা ডালহৌসি স্কোয়ার (এখনকার বিবাদী বাগ) পর্যন্ত। এসপ্লানেডের থেকে বালীগঞ্জ, টালীগঞ্জ, খিদিরপুর, বেহালা পর্যন্ত যাওয়া যেত। দুপুরের সময় লোকেদের ডাকার জন্য মিড-ডে কনশেসন চালু হয়ত, তখন ট্রামের সামনে একটা বোর্ডে মিড-ডে ফেয়ার লেখা থাকত। সরকারী বাস ছিল না ,বাগবাজার থেকে বালীগঞ্জের গোল পার্ক পর্যন্ত বেসরকারী দোতলা বাস চলতো।
 
বাড়ীর উল্টোদিকে শ্রীমাণী বাজার। দুতলা বাড়ির পেছন দিকটাতে সব্জী এবং মাছ মাংসের দোকান। রাস্তার উপরের পোর্শনটাতে দোকান ঘর। যতদূর মনে পড়ছে দক্ষিণ দিক থেকে শুরু করলে প্রথমে একটা মিস্টির দোকান তারপর হোমিয়োপ্যাথী ওষুধের দোকান,পরে সিগারেট, জুয়েলারী, চা, মুদী, কাপড়,স্টেশনারী, ওষুধ এর দোকান ছিল। সকাল সন্ধ্যা দুবেলা মিউনিসিপ্যালিটির লোকে রাস্তার ধারের গঙ্গাজলের হাইড্র্যান্ট খুলে রাস্তা ধুয়ে দিত। সন্ধ্যার সময় লোকে ছোট বাঁশের মই ঘারে করে এসে রাস্তার ধারের গ্যাস বাতির ম্যান্টল গুলো দেশলাই জ্বেলে জ্বালিয়ে দিত আবার ভোর বেলায় এসে নিভিয়ে দিত। যুদ্ধ ততদিনে ঘারের উপর এসে পড়েছে। বার্মা থেকে লোকেরা পালিয়ে আসতে শুরু করেছে। রাস্তায় মিলিটারীর আনাগোনা সব সময়। বড় রাস্তার থেকে ডান বাঁ দিকে যে সব রাস্তা গুলো ছিল তাদের গায়ে কাঠের উপর রঙ দিয়ে আউট অফ বাইন্ডস মার্ক করে দেওয়া হয়েছিল যাতে সেই সব রাস্তায় সোলজাররা না যায়।
এর আগে আমরা নার্সারী স্কুলে রিকশাতে যেতাম। এখন স্কুলটা দূরে হওয়াতে আর ঐ স্কুলে যাওয়া হয়নি। ইতিমধ্যে ,৪২ এর আগস্ট বিপ্লব কলকাতায় শুরু হয়ে গেছে। ৯ তারিখে সকাল বেলায় রাস্তার উপরের ছাদ থেকে দেখলাম কিছু যুবক কংগ্রেসের পতাকা নিয়ে রাস্তার ট্রাম চলায় বাধা দিচ্ছে। তারা ট্রামের ইলেকট্রিকের কানেকশনের ডান্ডাটাকে (আমরা বলতাম টিকি) উপরের তার থেকে সরিয়ে দিতে লাগল। ঐ টিকিটাতে একটা দড়ি বাঁধা থাকত যাতে কোন সময় টিকিটা তার ছেড়ে দিলে তাকে আবার টেনে বসান যায়। এরা কিন্তু ঐ দড়িটাকে কেটে দেওয়াতে আর ঐ টিকিটাকে তারে বসান সম্ভব হচ্ছিল না। মইগাড়ি এনে, কারেন্ট বন্ধ করেই ওটা করা সম্ভব হচ্ছিল। পুলিশ এসে এদেরকে লাঠি নিয়ে তাড়া করে ভাগাতে শুরু করলো। যতক্ষণ পুলিশ সামনে আছে ততক্ষণ এরা লুকিয়ে পড়ত আর পুলিশ চলে গেলেই আবার রাস্তায় এসে অবরোধ সৃষ্টি করত। বিকেলের দিকে লালপাগড়ি পুলিশের বদলে এংলো-ইন্ডিয়ান সার্জেন্ট এসে তাদের রিভলবার থেকে গুলি চালাতে সুরু করে। এবং বিপ্লবীদের উপর কাছের থেকে বুকের উপরে গুলি করে মারা সুরু করে। জানলার খড়খড়ি ফাঁক দেখলে সেদিকেও গুলি চালান সুরু হয়।
৪২সালের ২০শে ডিসেম্বর রাতে কলকাতায় প্রথম জাপানী বিমান হানা হয়। এর পরে আবার ২৪শে রাতেও কলকাতায় বোমা পড়ে। আমরা বাড়ির একতলায় একটা ঘরে আশ্রয় নিতাম। এখন ভাবি সেখানে বাড়ী ভাঙ্গা চাপা পড়ে মরবার সম্ভাবনা বেশীই ছিল। চাদনী রাতে জাপানী প্লেনগুলোকে স্পষ্ট দেখা গেলেও মিত্রপক্ষের থেকে কোন বিমানকে প্রতি-আক্রমণ করতে দেখা যায়নি
ঘুরে ফিরে এরা কলকাতায় বোমা ফেলে ফিরে গেল। বাড়ির কাছে হাতীবাগান বাজারের উপর একটা বোমা পড়েছিল, আর তার বিস্ফোরণে আমাদের বাড়ীটা কেঁপে উঠেছিল। কলকাতায় তখন গঙ্গার উপর এপার-ওপার করার জন্য একটা পন্টুন ব্রিজ ছিল। নৌকা জাহাজ ইত্যাদি যাতায়াতের জন্য এই ব্রিজ টা মাঝে মাঝে খুলে দেওয়া হত। পাশের ছবিটা ইন্টারনেটের সৌজন্যে পাওয়া, কলকাতার দিক থেকে তোলা।কলকাতার পন্টুন ব্রিজের ক্ষমতা কম এবং নৌকা জাহাজ যাতায়াতের জন্য একে মাঝে মজে খুলে দিতে হছে বলে একটা লোহার ব্রিজ বানাবার চিন্তা হচ্ছিল। যুদ্ধের তাগিদে সেটা তাড়াতাড়ি তৈরী করে নেওয়া হল আর ৪৩এর ফেব্রুয়ারিতে খুলে দেওয়া হল।
আমরা শেষ পর্যন্ত ১৯৪৩ এর প্রথম দিকে কলকাতা থেকে পশ্চিমে গ্রামের দিকে যাওয়া ঠিক করলাম। বাবার সহকর্মী বৈদ্যনাথ কাকুর গ্রাম ছিল বর্ধমান- কাটোয়া লাইনে শ্রীখন্ড স্টেসন থেকে কিছু ভেতরে লক্ষীপুর নামে এক গ্রামে। হাওড়া থেকে ট্রেনে কাটোয়া গিয়ে ছোট লাইনের গাড়ী চড়তে হল। শ্রীখন্ড স্টেশনে নেমে প্রায় ৪ কিমি পথ ধান ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে গরুর গাড়ীতে গিয়ে আমরা গ্রামের বাড়ীতে পৌঁছলাম। যেহেতু জাত বিচারে কাকুরা আমাদের থেকে নীচে, তাই আমাদের রান্না ওঁরা কেউ করতে পারবেন না। ব্রাহ্মণদের কি করে মন্ডলদের রান্না খাবার দেওয়া যায়। অতএব আমাদের জন্য আলাদা রান্নাঘর। সেই প্রথম আমি মাটীর তৈরী দোতলা বাড়ী দেখি। উপরের ছাদ খড় দিয়ে ছাওয়া। গ্রামের সাথে সেই আমার প্রথম পরিচয়। ধানের মরাই, ঢেকিতে ধান ভানা, গরুর গাড়ীর দৌড়, এগুলো এর আগে কোনদিন দেখিনি। স্কুলের পড়ার কোন বালাই নেই, সমবয়সী গ্রামের ছেলেদের সাথে খেলা করা দিন গুলো বেশ ভালই কাটছিল
 
ইতিমধ্যে বাবা কলকাতায় ফিরে এসেছেন। গ্রামে গরম পড়তে শুরু হয়েছে, আর তার সাথে জলাভাব। খাবার জন্য কুয়োর জল, আর অন্যান্য কাজের জন্য পুকুরের জলের ব্যবহার হত। হঠাৎ গ্রামে কলেরার প্রকোপ দেখা দিল। মা কলেরাতে আক্রান্ত হলেন। গ্রামের ডাক্তার তার যথাসাধ্য চেষ্টা করে সুস্থ করে তুললেন। কিন্তু গ্রামে একের পর এক লোকেরা কলেরাতে ভুগতে শুরু করলো। গ্রামীন বিশ্বাস অনুযায়ী পুজাপাঠ শুরু হল, এবং দেবীকে তুষ্ট করতে ছাগ বলি করা হল। ছাগ বললে ভুল হবে বরং ছাগলের পাল বলা ঠিক হবে, কেননা বলির রক্তে একটা নালা তৈরী হয়ে গিয়েছিল। আমরা ঠিক করলাম লক্ষীপুর ছেড়ে দেশের বাড়ি শান্তিপুরে গিয়ে থাকব। আবার ট্রেনে কাটোয়া হয়ে কালনা, সেখানে গঙ্গা পার হয়ে শান্তিপুর। আমাদের সাথে দিদিমা থাকতেন বলে তার পক্ষে জামাইএর বাড়ীতে থাকা অসুবিধাজনক হচ্ছিল। তাই শান্তিপুরের কাশ্যপ-পাড়াতে একটা বাড়ী ভাড়া নেওয়া হল। বাড়ির মালিক পি এম বাগচী (কালির বড়ী)
এখানে বলে রাখা ভাল যে ফাউন্টেন পেন জিনিষটা তখন একটা বিলাশিতা বলে মানা হত। পেনের কালি ভারতে তৈরী হত না। বিলাতী পার্কার কালি পেনে ব্যবহার হত। সাধারণ লেখার জন্য জলে কালির বড়ি গুলে কালি তইরি হত, আর তাতে কলম ডুবিয়ে লিখতে হত। কলকাতার অবস্থা তখন বেশ অস্থির। ৪২ সালে যুদ্ধের ভয়ে বৃটিশ সরকার পুর্ব বাংলার সমস্ত নৌকা বাজেয়াপ্ত করে দেওয়াতে গ্রামের লোকেদের যাতায়াত এবং রুজিরোজগারের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া সমেত আনাজ যাতে শত্রুপক্ষের হাতে না পড়ে তাই সেটাও বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর জন্য গ্রামের লোকেরা অনাহারে এবং অপুষ্টিতে দিন কাটাচ্ছিল। তাদের আশা ছিল যে কোন রকমে যদি কলকাতায় পৌঁছান যায় তবে খাবারের জোগাড় হয়ে যাবে। তারা কলকাতায় দলে দলে আসতে শুরু করলো। কলকাতায় তখন রেশন ব্যবস্থা চালু হওয়াতে লোকের কাছে এদের খাবার মতন কিছুই দেবার ছিলনা। প্রথমে ভিক্ষা করে ভাত, পরে ভাতের মাড় (ফ্যান) খেয়ে দিন কাটাতে শুরু হল। রাস্তার ধারে প্রায় প্রতিদিন অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা দেখতে পাওয়া যেত। কিন্তু এরা না খেয়ে মরেছে, তবুও দোকান লুঠ করেনি। একদিকে লোকেরা খেতে পাচ্ছেনা, অন্যদিকে যুদ্ধের মাল সাপ্লাই করার দৌলতে লোকের হাতে দেদার পয়সা আর তার জোরে পার্টির মচ্ছব চলেছে। 
এর মধ্যেই ৪৩ সালের ডিসেম্বর মাসে দিনদুপুরে কলকাতায় বোমা পড়ল। বেলা ১২টা নাগাদ খিদিরপুর ডকে বিমান আক্রমণ হল। কলকাতা বাসীর ভাগ্য ভাল যে বোমার নিশানা ভুল হয়ে গেছিল নয়ত যে যুদ্ধ জাহাজের উপর নিশানা হয়েছিল সেটা ঠিক হলে বিরাট ক্ষতি হত। সেটা ছিল গোলাবারুদ ভর্তি। তবুও এই বিমানহানায় বেশ কিছু মৃত্যু হয়েছিল। মজার কথা এই যে আমরা বোমার ভয়ে কলকাতা ছেড়ে পালালাম কিন্তু সেই বোমা কিন্তু আমরা ফিরে আসার পড়েই পড়ল। ৪৪ সাল পরতেই আমাদের আবার স্কুল ভর্তি হবার চিন্তা সুরু হল।
 

1 টি মন্তব্য: